চট্টগ্রামের মেয়ে চেমন আরা ভাষার জন্য ঢাকায় মেয়েদের সংগঠিত করেন
১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনের সময় চেমন আরা ঢাকা ইডেন কলেজে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। ১৯৪৮ সাল থেকেই তিনি 'তমদ্দুন মজলিস' এর সাথে যুক্ত হয়ে এই আন্দোলনে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন।
তিনি ছিলেন আন্দোলনের সূতিকাগার অধ্যাপক আবুল কাসেমের ১৯নং আজিমপুরের বাসার অন্যতম কর্মী।
সেই সময়ের ঘটনা স্মরণ করে অধ্যাপিকা চেমন আরা এক সাক্ষাৎকারে বলেন, "কাসেম ভাই ছিলেন চট্টগ্রামের ছেলে। আমার বাবা তাকে খুব পছন্দ করতেন। বাসায় মাঝেমধ্যে আসতেন। যোগাযোগ ছিল ভারত ভাগের আগ থেকেই। সদ্য কলকাতা থেকে এসে আমরা দুই বোন যখন পুরান ঢাকার মুসলিম গার্লস স্কুলে ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছি তখন তমদ্দুন মজলিস প্রতিষ্ঠার সূচনাতেই কাসেম ভাই বাবার অনুমতি নিয়ে আমাদের দুই বোনকে তমদ্দুন মজলিসের খুদে কর্মী বানিয়ে নিলেন।"
১৯৪৭ সালে ভাষা সৈনিক আবদুল গফুরের ছাত্রী নিলুফার ছিলেন মুসলিম গার্লস স্কুলের ছাত্রী ও চেমন আরার বান্ধবী। তমদ্দুন মজলিস প্রতিষ্ঠার পর থেকে অধ্যাপক আবুল কাসেমের ১৯ নম্বর আজিমপুরের বাড়িটি নানা বয়সী লোকজনের আগমনে সব সময় সরগরম থাকত। কর্মসূচির ছোট ছোট কাজে সাহায্য করার জন্য চেমন আরা, তার বোন আর নিলুফারের ডাক পড়তো প্রায়ই । তাদের তিনজনের ওপর পোস্টার সাঁটা ও ব্যানার লেখার দায়িত্বই বেশি থাকত।
১৯৪৯ সালে বাংলা ভাষাকে আরবি হরফে লেখার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে অনুষ্ঠিত সভা-সমাবেশেও তিনি যোগদান করেন। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রশ্নে ইডেন মহিলা কলেজের ছাত্রীদের অগ্রণী ভূমিকা ছিল। বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলনে ইডেন কলেজের ছাত্রীদের সংগঠিত করে ভাষা-আন্দোলনে সম্পৃক্ত করার ব্যাপারে চেমন আরা বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।
১৯৫০ সালে ভাষা-আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক বিশিষ্ট সাহিত্যিক শাহেদ আলীর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হবার পর ভাষা-আন্দোলনের সাথে তার সংশ্লিষ্টতা বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। আবির্ভূত হন এ আন্দোলনের একজন সার্বক্ষণিক কর্মীরূপে।
২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার ব্যাপারে যে সমাবেশ হয়, চেমন আরা সে সমাবেশে উপস্থিত থেকে ইডেন কলেজের ছাত্রীদের সংগঠিত করেন। সভাশেষে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের ঐতিহাসিক ছাত্রী মিছিলেও তিনি অংশগ্রহণ করেন। ভাষা শহীদ বরকতের রক্তমাখা শার্ট নিয়ে ২২ ফেব্রুয়ারি যে মিছিল বের হয় সে মিছিলে চেমন আরা অংশগ্রহণ করেন।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মিছিলে গুলির ঘটনায় উপর বিশেষ শহীদসংখ্যা বের করে তমদ্দুন মজলিসের মুখপাত্র দৈনিক সৈনিক। এ ঘটনায় ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে পুলিশ অধ্যাপক আবুল কাসেমের ১৯ নম্বর আজিমপুরের বাসা ঘেরাও করে। সেদিন চেমন আরা ও অধ্যাপক আবুল কাসেমের স্ত্রী রাহেলা খাতুনের বুদ্ধিমত্তায় গ্রেপ্তার এড়ান ভাষা সৈনিকেরা।
চেমন আরা ১৯৩৫ সালের ১ জুলাই চট্টগ্রাম শহরের চান্দগাঁও থানার ঐতিহ্যবাহী মৌলভী বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা এএসএম মোফাখখর ছিলেন বিভাগপূর্বকালে কলকাতা হাইকোর্টের একজন খ্যাতিমান আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ। মায়ের নাম দুরদানা খাতুন।
তিনি ১৯৫১ সালে ঢাকার সরকারি কামরুন্নেসা বালিকা বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ১৯৫৩ সালে ইমেন কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৬ সালে বাংলায় বিএ অনার্স ও ১৯৫৭ সালে এমএ পাস করেন। ১৯৫৪-৫৫ সালে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এসএম ছাত্র সংসদ নির্বাচনে। ১৯৫৮-৫৭ সালে ডাকসুর ম্যাগাজিন কমিটির সদস্য হন।
বায়নগঞ্জের নবীগঞ্জ বালিকা বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ঢাকা সরকারি কলেজ, তিতুমীর কলেজ, বদরুন্নেছা কলেজ ও ইডেন কলেজে প্রায় ৩৬ বছর অধ্যাপনা করেন।
১৯৯০ সালে তিতুমীর কলেজ থেকে অবসর নেন চেমন আরা। তিনি সরকারি মহিলা কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন ১৯৮২ সাল থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত। এছাড়াও কিশোরগঞ্জ কটিয়াদীতে অবস্থিত ডা. আব্দুল মান্নান মহিলা কলেজের প্রিন্সিপাল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
ভাষা-আন্দোলনের চেতনা বিকাশের ক্ষেত্রে সাংগঠনিক ও লেখালেখির মাধ্যমে অবদান রাখেন চেমন আরা। ১৯৪৮ সালে সাপ্তাহিক সৈনিকে তার প্রথম লেখা প্রকাশিত হয়। অধ্যাপিকা চেমন আরার গল্প, স্মৃতিকথা, জীবনীগ্রন্থ ও কবিতার ৫টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে এবং সম্পাদনা করেছেন ৫টি গ্রন্থ। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তার কবিতা ও প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।
- একটি টিবিএস ও নগদ-এর যৌথ উদ্যোগ