দিল্লির সাম্প্রদায়িক সহিংসতা করোনা ভাইরাসের ভারতীয় সংস্করণ: অরুন্ধতী রায়
দিল্লির চলমান সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রসঙ্গে কঠোর নিন্দা ও সমালোচনা করেছেন ভারতের বিখ্যাত সাহিত্যিক অরুন্ধতী রায়। নন্দিত এই কথাশিল্পী ও ঔপন্যাসিক সাম্প্রদায়িক অশান্তি মহামারি আকারের ব্যাধি বোঝাতে একে করোনা ভাইরাসের একটি ভারতীয় সংস্করণ বলেও উল্লেখ করেন।
গত রোববার দিল্লির জন্তর-মন্তরে আয়োজিত এক লেখক-বুদ্ধিজীবী সমাবেশে এসব কথা বলেন তিনি। ভারতীয় গণমাধ্যম স্ক্রল ডটইনের সূত্রে অরূন্ধতীর ওই বক্তব্যের সারসংক্ষেপ তুলে ধরা হলো-
প্রিয় বন্ধু, সহযোদ্ধা এবং লেখকবৃন্দ,
আজ আমরা যেখানে সমবেত হয়েছি সেখান থেকে বাসে করে একটু দূরে গেলেই পৌঁছে যাব উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে, যেখানে মাত্র চারদিন আগে ফ্যাসিস্ট দাঙ্গাবাজের দল সহিংস হামলা চালিয়েছে।
তাদের উস্কে দিয়েছে সরকারি দল বিজেপির উগ্র বক্তব্য। আর দিল্লি পুলিশের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ও মদদের মধ্য দিয়েই সশস্ত্র, রক্তপিপাসু এই খুনিরা মুসলমানদের ওপর বর্বর হামলা চালায়।
শুধু তাই নয়, দেশের ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমের একটি বড় অংশ দাঙ্গাকারীদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল। দেশের বিচার ব্যবস্থাও এদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেবে না, এমন বিশ্বাস থেকেই তারা উত্তর-পূর্ব দিল্লির এই খেটে খাওয়া দিনমজুর শ্রেণির মুসলমানদের ওপর হামলা চালিয়েছে।
দাঙ্গাবাজ ফ্যাসিবাদিরা যে হামলা করবেই তা ক'দিন ধরেই বেশ টের পাচ্ছিলেন স্থানীয় অধিবাসীরা। তাই তারা নিজ নিজ এলাকার সুরক্ষায় সাধ্যমতো প্রতিরোধের চেষ্টা করেন। এরপরও বাজার, দোকান, বসতভিটা, মসজিদ আর যানবাহন আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া ঠেকাতে পারেননি।
সড়কগুলো ভরে গেছে দু'পক্ষের ছোড়া পাথর আর ইট আর পুড়ে যাওয়া যানবাহনের কঙ্কালে। হাসপাতাল ভর্তি হয়ে উঠেছে আহত আর মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়া রোগীদের ভিড়ে। মর্গগুলোতে লাশের ভিড়; হিন্দু, মুসলমান সব ধরনের লাশ। আছে এক পুলিশের লাশ, গোয়েন্দা বিভাগের এক তরুণ কর্মীর লাশ।
হ্যাঁ, উভয়পক্ষের লোকজনই নিজেদের অবিশ্বাস্য রকমের নৃশংস প্রমাণিত করতে পেরেছে। তবে হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের মানুষই প্রবল সৎ সাহস, মানবতা এবং ভালোবাসার দৃষ্টান্তও স্থাপন করেছেন। অবশ্য বর্বরতার তুলনায় মানবতার উদাহরণগুলো সংখ্যায় তুলনা দেওয়া যায় না।
এসব ঘটনায় 'জয় শ্রী রাম' স্লোগান দিয়ে যে এই বর্বর হামলার সূত্রপাত হয়েছিল সেই সত্য অস্বীকার করা যায় না। অস্বীকার করা যায় না নগ্ন ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রশক্তির মদদেই হামলা করা হয়েছে।
স্লোগান নিয়েও বিভাজিত হওয়ার কিছু নেই। একে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা বলাটাও যথার্থ হবে না। এটা দেশে চলমান ফ্যাসিস্ট এবং ফ্যাসিবাদ বিরোধী শক্তির সংঘাতের এক রূপ।
এখানে দুর্বল ও বঞ্চিত সংখ্যালঘুরা হিংসার শিকার হয়েছে। কারণ এসব ফ্যাসিবাদি শক্তির কাছে ভারতের মুসলমানরাই সবচেয়ে বড় শত্রু। তাই অনেকেই একে 'দাঙ্গা' বলে ভুল করছেন। একে দাঙ্গা বলা আর বামকে ডান, ডানকে বাম বলা সমান কথা। সংজ্ঞাটি একই সঙ্গে ভয়ঙ্কর বিভ্রান্তিকর এবং প্রকৃত সত্যকে লুকিয়ে রাখতে সাহায্য করে।
আজ এখানে উপস্থিত সকলেই দাঙ্গা চলাকালে পুলিশি ভূমিকার ভিডিও চিত্র দেখেছি, দেখেছি তাদের অংশগ্রহণ আর নির্যাতনের নানা ঘটনা। জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপরেও কি একই কায়দায় বর্বর হামলা চালানো হয়নি?
তবে এটা ভুলে গেলে চলবে না জামিয়া মিলিয়ার পুলিশি বর্বরতায় শুধু মুসলমান নয়, হিন্দু শিক্ষার্থীরাও নির্বিচারে মারধরের শিকার হয়েছে। দিল্লি শহরেও এখন সব ধর্মের শান্তিকামী মানুষ নরেন্দ্র মোদি ও বিজেপির ছড়িয়ে দেওয়া ঘৃণার আগুনে পুড়ছে।
এটা অপ্রত্যাশিত বা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। আজ থেকে ১৮ বছর আগে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে ঠিক এভাবেই বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি হিংসার আগুন জ্বেলেছিলেন।
আজ দিল্লিতে যে সহিংসতা চলছে তার প্রকৃত কারণগুলো নিয়ে আগামী দিনে অনেক গবেষণা, অনেক আলোচনা চলবে। সে সময়ের জন্য স্থানীয় মানুষের বিবরণ ও অভিজ্ঞতাগুলো রেকর্ড করে রাখা দরকার। তারা ঠিকঠাক বলতে পারবেন কিভাবে সামাজিক গণমাধ্যমে মিথ্যে গুজব ছড়িয়ে এই বিস্ফোরক পরিস্থিতি তৈরি করা হয়। সাম্প্রদায়িক এসব পোস্টের পুঁজি ছিল নির্ভেজাল ঘৃণা।
দাঙ্গার তীব্রতা কিছুটা কমে আসলেও এখনো সড়কে মিছিল হচ্ছে। সেখানে উঠছে স্লোগান, দেশ কি গাদ্দারো কো, গোলি মারো সালো কো; অর্থাৎ দেশদ্রোহীদের গুলি করে মারো। এই স্লোগান দিয়েই সিএএ বিরোধী আন্দোলনকারীদের নির্মূলের আহ্বান জানান বিজেপি নেতা কপিল মিশ্র।
দিল্লি হাইকোর্টের বিচারক মুরালিধরন বিজেপি নেতা কপিল মিশ্রর বিরুদ্ধে কেন অভিযোগ গঠন করা হয়নি, পুলিশের কাছে তার ব্যাখ্যা তলব করার পরেই তাকে পাঞ্জাব হাইকোর্টে বদলি করা হয়েছে। কপিল মিশ্র বহাল তবিয়তেই আছেন। নিজের খুনি স্লোগান তিনি অনির্দিষ্টকালের জন্য এখন ব্যবহার করে যেতে পারবেন।
অতীত ইতিহাসেও বিচারপতিদের নিয়ে এমন মশকরার নজির আছে। বিচারক লোয়া বিজেপি গুণ্ডা বাবু বাজরাঙ্গির বিরুদ্ধে দেওয়া রায়ের পর তার সঙ্গে কি হয়েছে তা নিয়ে ইউটিউবে একটি ভিডিও আপলোড করেন। চাইলেই যে কেউ সেই ভিডিও দেখে নিতে পারেন। এভাবে বিচারালয়ও হয়েছে বিতর্কিত।
ফ্যাসিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা একটি সামাজিক ঘৃণা। এই ঘৃণা করোনা ভাইরাসের ভারতীয় সংস্করণ। নরেন্দ্র মোদি এবং তার দলের আদর্শ এই ভাইরাসের মূল বীজ। ভারতীয় সমাজ এই ভাইরাসে আপাদমস্তক অসুস্থ হয়ে পড়েছে।