পৃথিবীর অন্যতম দমনপীড়নকারী সরকার ব্যবস্থার কাছেই কেন কিছু উ. কোরীয় ফিরে যাচ্ছে?
আন্তর্জাতিক রাজনীতির মারপ্যাঁচে বিভাজিত কোরীয় উপদ্বীপ। পৃথিবীর অন্যতম সুরক্ষিত ও সামরিকায়িত সীমানার একদিকে পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র- দক্ষিণ কোরিয়া। অপরদিকে, পারিবারিক শাসন ব্যবস্থায় পরিচালিত সমাজতান্ত্রিক- উত্তর কোরিয়া। দুই দেশের জনগণের জীবনমানেও রাতদিনের পার্থক্য। যেন ভিন্ন দুই জগতকে আলাদা করেছে এ সীমানা।
আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় উত্তর কোরিয়ার শাসকগোষ্ঠী নিপীড়ক ও দমনপীড়নকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবেই পরিচিত। সে হিসাবে কোনো মানুষেরই ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে থাকার কথা নয়। কিন্তু, বিরল হলেও কিছু ক্ষেত্রে হয়েছে ঠিক সেটাই!
সম্প্রতি এমনই একজন দক্ষিণ কোরিয়া থেকে পালিয়ে গেছেন উত্তরে। এজন্য জীবন বাজি ধরে তিনি পাড়ি দেন পৃথিবীর অন্যতম বিপজ্জনক সীমান্ত।
তিনি অবশ্য মোট দুইবার এ সীমান্ত পাড়ি দেন। স্বপক্ষ ত্যাগকারী ওই ব্যক্তি এ পথেই দক্ষিণ কোরিয়ায় পালিয়ে আসেন। তারপর আবার এক বছর পর প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে ফিরে যান। ফেরার পর তার রয়েছে নিশ্চিত প্রাণদণ্ডের সম্মুখীন হওয়ার ঝুঁকি। প্রশ্ন উঠছে- কেন তিনি এত বিপদ মাথায় করে কিম জং উন শাসিত পৃথিবীর সবচেয়ে বিচ্ছিন্ন রাষ্ট্রে ফিরে গেছেন?
দক্ষিণ কোরিয়ার গণমাধ্যম ওই ব্যক্তির ফিরে যাওয়ার কথা জানালেও তার নাম-পরিচয় গোপন রাখে।
তবে দ. কোরিয়ায় আশ্রয় লাভকারী কয়েকজন উত্তর কোরীয় স্বপক্ষ ত্যাগকারী জানিয়েছেন, তার নাম ছিল কিম ওয়ো জিয়ং। সাবেক এই জিমন্যাস্ট ছিলেন অন্তর্মুখী স্বভাবের। তাদের সাথে খুব একটা মেলামেশাও করতেন না জিয়ং।
দ. কোরিয়ার পুলিশ জানিয়েছেন, ত্রিশের কোঠায় থাকা ওই ব্যক্তি ছিলেন একজন নির্মাণশ্রমিক। তিনি দিনমজুরি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। পুলিশি সূত্র অবশ্য তার নামধাম গোপন রেখেছে।
সত্যিকার অর্থেই তার ঘটনাটি বেশ বিরল। গত এক দশকে ১০ হাজারের বেশি উ. কোরীয় নিজ দেশ থেকে পালিয়ে দ. কোরিয়ায় এসেছেন। এদের মধ্যে মাত্র ৩০ জন স্বদেশে আবার ফিরে গেছেন। নিশ্চিত মৃত্যুদণ্ড না দিলেও সমাজতন্ত্রী সরকার তাদের কুখ্যাত শ্রমশিবিরে পাঠাতে পারে। যেখানে তিলে তিলে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হয় তাদের। দ. কোরিয়ার সরকারি সূত্রের তথ্য এমন দাবিই করছে।
তবে দেশত্যাগকারী সাবেক উ. কোরীয় এবং মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, দ. কোরিয়ায় স্বপক্ষ ত্যাগকারীদের জীবনযাত্রা যে কতোটা কঠিন হতে পারে- ফিরে যাওয়ার এসব ঘটনা সেদিকে আলোকপাত করছে।
উত্তর কোরীয়রা কেন নিজ দেশ ছেড়ে পালায়
১৯৫৩ সালে এক যুদ্ধবিরতির মধ্যে দিয়ে শেষ হয় কোরীয় যুদ্ধ। তারপর থেকেই প্রায় দুর্ভেদ্য সীমানায় বিভাজিত দুই কোরিয়া।
যুদ্ধের পরের দশকগুলোয় দ. কোরিয়ায় দেখা যায় আধুনিকায়নের জোয়ার। অতিবাহিত সময়ের সাথে সাথে হয়ে ওঠে বিশ্বের অন্যতম ধনী ও প্রযুক্তি অগ্রসর রাষ্ট্র। অপরদিকে, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা, অবরোধে বাকি বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে থাকে উ. কোরিয়া। দেশটি জুড়ে দেখা দেয় ব্যাপক দারিদ্র্য। নাগরিকদের মৌলিক স্বাধীনতাও খর্ব হতে থাকে।
এসব কারণেই উ. কোরীয়রা দক্ষিণে উন্নত জীবনের সন্ধানে সুযোগ পেলেই পাড়ি জমায়।
দ. কোরিয়ার দুই কোরিয়া পুনঃএকত্রীকরণ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, ১৯৯৮ সাল থেকে ৩৩ হাজারের বেশি স্বপক্ষ ত্যাগকারী উত্তর কোরীয় দক্ষিণে পালিয়ে এসেছে। তবে কিম জং উন সম্প্রতি কোভিড-১৯ বিস্তার রোধে সীমান্তে কড়াকড়ি আরও বাড়ানোয়, বিগত দুই বছরে হ্রাস পেয়েছে এ সংখ্যা।
এ বাস্তবতায় হাতেগোণা কয়েকজন স্বপক্ষ ত্যাগকারীই দুই কোরিয়ার সীমান্ত পেরিয়ে দক্ষিণে আসার সুযোগ পান। অধিকাংশই আসেন উ. কোরিয়ার সাথে থাকা প্রতিবেশী চীনের দীর্ঘ সীমান্ত পাড়ি দিয়ে। চীন হয়ে দ. কোরিয়ায় আসা এমনই একজন স্বদেশত্যাগী হলেন- কাং চুন হিউক।
তবে তিনি পালিয়ে আসেন পরিবারের সাথে। ১৯৯৮ সালে কাংয়ের বয়স যখন মাত্র ১২ বছর তখন তার বাবা-মা তাকে নিয়ে দ. কোরিয়ায় পৌঁছাতে সক্ষম হন। চীন হয়ে আসতে তাদের সময় লেগেছিল কয়েক বছর। এ সময়টা তারা চীনেই লুকিয়েছিলেন।
কাং উ. কোরিয়ায় তার শৈশবের স্মৃতিচারণ করে জানান, সেখানে তারা কোনোমতে জীবনধারণের মতো আহার যোগাড় করতে পারতেন। যেমন অনেক সময় তার মা এক প্যাকেট ন্যুডলস দিয়ে পাতলা স্যুপের মতো খাবার বানাতেন, যা তারা এক সপ্তাহ ধরে খেতেন।
"স্কুলে যাওয়ার মতো অবস্থা ছিল না, আমার অনেক সহপাঠীও যেত না। তার চেয়ে ওই সময়ে আমরা ভুট্টা বা আলু চুরি করতাম", বলেন কাং চুন।
প্রবাসে উ. কোরীয়দের শরণার্থী সংস্থা- নর্থ কোরিয়ান রিফিউজি ফাউন্ডেশনের চলতি বছর প্রকাশিত এক জরিপ অনুযায়ী, চরম খাদ্যাভাবের কারণেই বেশিরভাগ মানুষ দেশত্যাগ করে। জরিপে অংশ নেওয়া প্রায় ৩ হাজার স্বপক্ষ ত্যাগকারীদের ২২ শতাংশই একে প্রধান কারণ বলে উল্লেখ করেন।
আর সবচেয়ে সার্বজনীন কারণ হিসেবে উঠে আসে- উ. কোরীয় শাসকগোষ্ঠীর সবকিছু নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারিতে রাখার চেষ্টা, অধিকাংশই যাকে 'দমবন্ধকারী' বলে উল্লেখ করেন।
দ. কোরিয়ার সরকার এসব দেশত্যাগীকে নানানভাবে সহায়তা দিয়ে থাকে। তাদের ১২ সপ্তাহের আবশ্যিক একটি শিক্ষাকোর্স সম্পন্ন করতে হয়, যাতে তারা দ. কোরিয়ার সমাজে খাপ খাওয়ানোর সুযোগ পান। এছাড়া, তাদের আবাসনসহ আর্থিক সহায়তাও দেওয়া হয়। পান স্বাস্থ্যসেবা এবং চাকরি সন্ধানে পরামর্শ।
তারপরও, দেশত্যাগীদের পক্ষে নতুন সমাজ ব্যবস্থায় মানিয়ে চলাটা সহজ হয় না মোটেও। অনেকেই মানসিক বিষাদে ভোগেন।
কাজ খুঁজে পাওয়া আর নতুন সমাজে মানিয়ে নেওয়ার অসুবিধা
২০১৪ সালে দ. কোরিয়ায় পালিয়ে আসেন কিশোরী কাং নারা। তিনি উ. কোরিয়ার চংজিন শহরে বসবাসের সময় লুকিয়ে 'কে-ড্রামা' বলে পরিচিত দ. কোরীয় টিভি সিরিয়ালগুলো দেখতেন। ভেবেছিলেন সেখানে গেলে তেমন জাঁকজমকের জীবনই হয়তো পাবেন। কিন্তু, বাস্তবের দ. কোরিয়া ছিল তার টিভি স্ক্রিনে দেখা রোমান্টিক দুনিয়ার চেয়ে অনেক ব্যতিক্রমী।
কাং নারার মা, মেয়ের আগেই গোপনে দ. কোরিয়ায় আসেন। এখন দুজনে একসাথেই বাস করছেন।
কাং নারার মা উ. কোরীয় স্বপক্ষ ত্যাগীদের নিয়ে গঠিত একটি নাচের দলে শিল্পী। ব্যয় নির্বাহের যথেষ্ট অর্থ উপার্জন করতে তাকে দীর্ঘ সময় বাড়ির বাইরে কাটাতে হয়। এসময়টা খুব একাকি কাটতো নারার। নিঃসঙ্গতার বড় কারণ, এক ভাষাভাষী হওয়ার পরও দ. কোরিয়ায় এসে তার সাথে খুব কম সমবয়সীরই বন্ধুত্ব হয়েছে।
নাম-প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেকজন দেশত্যাগী মার্কিন গণমাধ্যম সিএনএনকে বলেন, কয়েক বছর আগে তিনি দ. কোরিয়ায় আসেন। এখানে এসে তিনি দুই দেশের বিশাল সাংস্কৃতিক বিভেদ উপলব্ধি করেন। কিছুতেই মানিয়ে চলতে পারছিলেন না শুরুতে।
এমনকি দ. কোরিয়ার পথেঘাটে রকমারি বিজ্ঞাপনের বর্ণিল উপস্থাপন বা ভাষায় ইংরেজি শব্দের বহুল প্রচলন তাকে অস্বস্তির মধ্যে ফেলছিল।
"উ. কোরিয়ায় এসবের বালাই ছিল না। তাই প্রথম প্রথম এখানকার অনেক কিছুই ভালো লাগতো না," দেশত্যাগীরা দ. কোরিয়ায় চাকরি পেতেও সমস্যার মুখে পড়েন বলে উল্লেখ করেন তিনি।
দ. কোরিয়ার পুনঃএকত্রীকরণ মন্ত্রণালয়ের তথ্যও তার বক্তব্যকে সমর্থন করছে। ২০২০ সালে প্রকাশিত তথ্যানুসারে, দ. কোরিয়ার সাধারণ জনগণের তুলনায় সাবেক উ. কোরীয়দের মধ্যে বেকারত্বের হার বেশ উচ্চ। তাদের প্রায় ৯.৪ শতাংশ বেকার, অন্য সবার ক্ষেত্রে যা মাত্র ৪ শতাংশ।
নাম-প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ব্যক্তি বলেন, "এখানে শিক্ষাব্যবস্থা আন্তর্জাতিক মানের। যারা এদেশে জন্মেছেন তাদেরকেই চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতা করতে হয়। তাহলে আমাদের মতো উ. কোরিয়ায় বেড়ে ওঠা মানুষের জন্য তা কতোটা কঠিন- সেটা সহজেই বোধগম্য।"
বিচ্ছেদের যন্ত্রণা
কিন্তু সব দেশত্যাগী উ. কোরীয় দক্ষিণ কোরিয়ায় উজ্জ্বল জীবনের স্বপ্ন দেখে আসেননি। কেউ কেউ সেখানে এসেছেন দুর্ঘটনাক্রমে। কিম রিওন-হুই তেমন বিরল মানুষদেরই একজন।
৫৪ বছরের এই নারী উ. কোরিয়ায় তুলনামূলক সম্পন্ন জীবনযাপনই করছিলেন। ২০১১ সালে তিনি চীনে বসবাসরত আত্মীয়দের সাথে দেখা করতে আসেন। তার ছিল লিভারের সমস্যা, চীনে আসার পেছনে আরেক উদ্দেশ্য ছিল চিকিৎসা করানো। কিন্তু চীনা ডাক্তাররা তার কাছে অগ্রিম টাকা দাবি করলে বিপাকে পড়েন হুই।
এসময় একজন দালাল হুইকে জানান, চীনের অনেকেই অর্থ উপার্জন করতে দ. কোরিয়ায় যান। আপনিও যেতে পারেন। এরপর তিনি দালালের সাথে দ. কোরিয়ায় অনুপ্রবেশ করেন। কিন্তু, তারপর ধরা পড়ে যাওয়ায় তার আর দেশে ফিরে যাওয়া হয়নি। বরং দেশটির সরকার তাকে সেখানে বসবাসের অনুমতি দিয়েছে।
তবে উ. কোরিয়া যখন ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালায় তখন দ. কোরিয়ার অনেকেই তার সাথে উগ্র আচরণ করে বলে জানান হুই। তার অভিযোগ, "পুঁজিবাদী এই সমাজ ব্যবস্থায় মানিয়ে চলার আপ্রাণ চেষ্টা করি; কিন্তু দিনশেষে মনে হয়, এ এমন এক ব্যবস্থা- যেখানে ক্ষুধার্ত কুকুর তার স্বজাতিকে কামড়ে খায়।"
তিনি আরও বলেন, "উত্তর যদি তেল হয়, তবে দক্ষিণ হলো পানি। এজন্য দুই প্রান্তের মানুষ সহজে একসাথে মিশতে পারে না।"
নর্থ কোরিয়ান রিফিউজি ফাউন্ডেশনের জরিপ অনুসারে, বেশিরভাগ দেশত্যাগীই এমন ধারণা পোষণ করেন। তবে মুক্ত জীবনযাপনের সুযোগ পেয়ে বেশিরভাগই দ. কোরিয়ায় তাদের জীবনযাপনের ব্যাপারে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন।
সূত্র: সিএনএন