যেসব প্রাণী দুর্যোগের আভাস দেয়
খ্রিষ্টপূর্ব ৩৭৩ সালে প্রাচীন গ্রিক সভ্যতার হেলিস নগরীতে একবার এক মারাত্মক ভূমিকম্প হয়। এতে প্রায় সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেলেও নগরীর কোনো মুক্তপ্রাণীর ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। কারণ এখানে বসবাসকারী কুকুর, বিড়াল, সাপ, বেজি ইত্যাদি প্রাণী ভূমিকম্প শুরু হওয়ার আগেই নগর ত্যাগ করে।
১৮০৫ সালে নেপালে ভূমিকম্প শুরু হওয়ার কয়েক মিনিট আগে সেখানকার ষাঁড়, ভেড়া, কুকুর, রাজহাঁসগুলো একত্রে চিৎকার করতে শুরু করে। এমনই চিত্র লক্ষ করা যায় ১৯০৬ সালের সান ফ্রান্সিসকো শহরে ভূমিকম্প শুরু হওয়ার আগেও। সেখানকার ঘোড়াগুলো হঠাৎ উত্তেজনায় এদিক-সেদিক দৌড়াতে শুরু করে।
এমনকি ২০০৪ সালে ইন্দোনেশিয়ায় ভূমিকম্পের কারণে সৃষ্ট সুনামি শুরু হওয়ার ঘণ্টাখানেক আগে সেখানকার হাতিগুলো উঁচু জায়গায় উঠে আসতে শুরু করে। এই সুনামিতে প্রাণ হারায় প্রায় ২ লাখ ২৫ হাজার মানুষ।
তার মানে কি প্রাণীরা সত্যি সত্যিই কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হওয়ার কথা আগে থেকে জানতে পারে? যদি পারেও তাহলে এমন কী শক্তি রয়েছে তাদের? কারণ অনেক সময়েই সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী মানুষের তৈরি আধুনিক যন্ত্রও ভূমিকম্পের পুর্বাভাস দিতে ব্যর্থ হয়। এই রহস্য উন্মোচনের জন্য যুগে যুগে বহু গবেষণা হয়েছে। সেসব গবেষণায় উঠে এসেছে প্রাণীদের এই অতিপ্রাকৃত শক্তি এবং কীভাবে এটি কাজ করে তার ব্যাখ্যা।
প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোর মধ্যে ভূমিকম্প হলো- সবচেয়ে বেশি ধ্বংসাত্মক। ভূমিকম্পের কারণে যুগে যুগে মাটির নিচে হারিয়ে গেছে বহু সমৃদ্ধ সভ্যতা। এই ধ্বংসলীলা এখনো থেমে নেই, মাঝেমধ্যেই আামরা বিভিন্ন দেশে ভূমিকম্পের খবর পাই। তবে দুঃখজনক ব্যাপর হলো এই দুর্যোগটি সম্পর্কে আগামবার্তা দিতে পারে এমন কোনো যন্ত্র আধুনিক বিশ্ব আবিষ্কার করতে পারেনি।
প্রাণীরা কিভাবে ভূমিকম্পের আগাম বার্তা পায় সে বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুসন্ধান চালান জার্মানির ম্যাক্স প্লাঙ্ক ইনস্টিটিউট অফ অ্যানিমেল বিহেভিয়র- এর গবেষক মার্টিন উইকিলস্কি। ইতালির ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা মার্চেসের একটি খামারের গরু, ভেড়া এবং কুকুরের উপর এই গবেষণা পরিচালনা করা হয়। এখানকার প্রত্যেকটি প্রাণীর সাথে তিনি একটি করে কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত চিপ লাগিয়ে দেন। প্রাণীগুলো প্রতিমিনিটে কতখানি নড়াচড়া করলো তার ডেটা সেই কম্পিউটারে চলে যেতো। এভাবে তিনি অক্টোবর ২০১৬ সাল থেকে এপ্রিল ২০১৭ সাল পর্যন্ত এসব প্রাণীর নড়াচড়ার তথ্য সংগ্রহ করেন।
এই সময়ে ইতালি সরকারি হিসাব অনুযায়ী, প্রায় ১৮ হাজার ভূকম্পন সংগঠিত হয়। এসবের মধ্যে বেশিরভাগ ছিল ০.৪ মাত্রার মৃদু ভূমিকম্প। এক ডজনের মতো ছিলো ৪ মাত্রার। এছাড়া ৬.৬ মাত্রার মতো নর্সিয়া ভূমিকম্পও এসময় সংগঠিত হয়।
২০২০ সালে প্রকাশিত এই গবেষণা রিপোর্টে দেখানো হয় যে, ভূমিকম্প শুরু হওয়ার ২০ ঘণ্টা পূর্বে প্রাণীরা তাদের আচরণ পরিবর্তন করা শুরু করতো। যখন খামারটির ৫০ শতাংশের বেশি প্রাণী একসাথে ৪৫ মিনিটের বেশি সময় ধরে অস্থির আচরণ করতো তখন ৪ মাত্রার ভূমিকম্প সংগঠিত হতো। এভাবে সেই সময়ের আটটির মধ্যে সাতটি শক্তিশালী ভূমিকম্প আগেভাগে শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছিল।
আরেকটি গবেষণায়ও এমন ফলাফল পেয়েছেন লন্ডনের সাউথ ব্যাংক ইউনিভার্সিটির বিহেভোরিয়াল পরিবেশবিদ রাসেল গ্রান্ট। তিনি পেরুর ইয়ানাচাগা ন্যাশনাল পার্কের মধ্যে মোশন ক্যামেরা স্থাপন করে প্রাণীদের গতিবিধি লক্ষ্য করেন। তার এই গবেষণার সময় পেরুর কন্টামানায় শক্তিশালী ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়।
গবেষণার ফলাফলে বলা হয়, ভূমিকম্প শুরু হওয়ার ২৩ দিন পূর্ব থেকে প্রাণীদের গতিবিধি কমতে শুরু করে। ভূমিকম্প শুরু হওয়ার দশম, ৬ম, ৫ম, ৩য় এবং ভূমিকম্পের দুইদিন আগে এবং ভূমিকম্প সংগঠনের দিন কোনো প্রাণীর চলাচল লক্ষ করা যায়নি। যেটাকে তিনি অত্যন্ত অস্বাভাবিক বলে উল্লেখ করেছেন।
প্রাণীরা যেভাবে ভূমিকম্পের পূর্বাভাস পায়
রাসেল গ্রান্ট ভূমিকম্প শুরু হওয়ার আগে প্রাণীদের এই অস্বাভাবিক আচরণ করার একটি প্রমাণ খুঁজে পেয়েছেন। তিনি বলেন, ভূমিকম্পের আট দিন আগে থেকে বায়ুমণ্ডলে বৈদ্যুতিক চার্জের অস্বাভাবিক ওঠানামা শুরু হয়। প্রতি দুই থেকে চার মিনিট ধরে এই চার্জের ওঠানামা থাকত।
প্রাণীদের সতর্ক করার ক্ষেত্রে এই তড়িৎ-চৌচুম্বকীয় চার্জের ব্যাখ্যা দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। ভূমিকম্প শুরু হওয়ার আগে মূলত ভূ-অভ্যন্তরে থাকা শিলার উপর প্রচণ্ড চাপের সৃষ্টি হয়। চাপের কারণে সেখানে বৈদ্যুতিক চার্জ তৈরি হয়। এই চার্জ মাটি ভেদ করে দ্রুত ভূপৃষ্ঠে চলে এসে বায়ুমণ্ডলকে আয়নায়িত করে।
সারা বিশ্বে ভূমিকম্প শুরু হওয়ার আগে এ ধরনের আয়নায়ন লক্ষ করা গেছে। আয়ন অতি-নিম্নমানের আল্ট্রা-ইলোক্ট্রম্যাগনেটিক ওয়েভ বা তরঙ্গ তৈরি করে। এই তরঙ্গগুলোর সংকেত ও আয়নিত বাতাস কিছু কিছু প্রাণী তাদের শরীরের পালক ও অন্যান্য অঙ্গের মাধ্যমে বুঝতে পারে। যার কারণে তারা ভূমিকম্প হতে চলেছে এমন পূর্বাভাস আগেই পেয়ে যায়।
প্রাণীদের এই ভূমিকম্প-পূর্বাভাস মানুষ কীভাবে কাজে লাগাতে পারে
চীন ইতোমধ্যে প্রাণীদের আচরণের ওপর নজরদারি করে ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেওয়ার জন্য ন্যানিং শহরে একটি বিশেষ ভূকম্পন পূর্বাভাস কেন্দ্র তৈরি করেছে। তারা মূলত সাপের ওপর নজরদারি করে এই পুর্বাভাস কেন্দ্র গড়ে তুলেছে। কারণ সরীসৃপের অনুভূতি ক্ষমতা অত্যন্ত বেশি। চারপাশের পরিবেশের সামান্যতম পরিবর্তন হলেও তারা বুঝতে পারে। ভূমিকম্প হওয়ার খানিক আগে এরা নিজেদের গর্ত থেকে বের হয়ে আসে। এমনকি শীতের কনকনে ঠান্ডার মাঝেও এরা বেরিয়ে আসবেই।
উল্লেখ্য, সাপ ও অন্যান্য প্রাণীর আচরণ নজরদারি করে ১৯৭৫ সালে চীনের হেইচেং শহরে ভূমিকম্প শুরু হওয়ার আগেই পূর্বাভাস দিতে সক্ষম হয় শহরটির কর্তৃপক্ষ। যার কারণে সেই ভূমিকম্পের তাণ্ডবলীলা থেকে বেঁচে যায় অগণিত মানুষের প্রাণ।