যে কারণে চেরনোবিল দখলে উদ্গ্রীব ছিল রাশিয়া
আক্রমণের দ্বিতীয় দিনে ইউক্রেনের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র দখল করেছে রাশিয়ার সামরিক বাহিনী। ইউক্রেনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন এই তথ্য।
১৯৮৬ সালে চেরনোবিলের একটি চুল্লির বিস্ফোরণকে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় পারমাণবিক বিপর্যয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি ভলোদিমির জেলেনস্কি ইতোমধ্যেই সতর্কবার্তা হিসেবে বলেন, রাশিয়া তাদের আক্রমণ অব্যাহত রাখলে আবারও এ ধরনের বিপর্যয় ঘটতে পারে।
"আমাদের রক্ষাকারীরা তাদের জীবন দিচ্ছেন যাতে ১৯৮৬ সালের ট্র্যাজেডির পুনরাবৃত্তি না ঘটে," টুইট করেন জেলেনস্কি।
"এটি সমগ্র ইউরোপের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করার মতো," বলেন তিনি।
এদিকে, ইউক্রেনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও চেরনোবিলে আরও একটি 'পরিবেশগত বিপর্যয়ের' সম্ভাবনার বিষয়ে সতর্ক করেছে।
চেরনোবিল পারমাণবিক কেন্দ্র থেকে এর আশেপাশের ৩২ কিলোমিটার বা ১৯ মাইল জায়গা জুড়ে চুল্লি বিস্ফোরণের ৩৬ বছর পর এখনও পর্যন্ত জীবনের কোনো চিহ্ন নেই।
প্ল্যান্টের অন্য তিনটি চুল্লি ২০০০ সালের মধ্যে বন্ধ করে দেওয়া হয়।
৩৬ বছর আগের ওই বিস্ফোরণের পর থেকে এই অঞ্চলে তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা বিপজ্জনকহারে বেশি।
বৃহস্পতিবার রাশিয়ান সেনারা ইউক্রেনে প্রবেশের আগে চেরনোবিলের এক্সক্লুসিভ জোনে প্রবেশ করেছিল বলেও জানা গেছে।
এদিকে হোয়াইট হাউস জানিয়েছে, চেরনোবিলের কর্মীদেরকে রুশ সৈন্যরা জিম্মি করে রেখেছে, এমন খবর পেয়েছে তারা।
কিন্তু উচ্চ তেজস্ক্রিয়তাসম্পন্ন এই অঞ্চলের দখল নিতে কেন উদগ্রীব ছিল রাশিয়া?
এর মূল কারণ চেরনোবিলের ভৌগলিক অবস্থান। রাজধানী কিয়েভ থেকে চেরনোবিল প্রায় ১৩০ কিমি (৮০ মাইল) উত্তরে অবস্থিত এবং আক্রমণকারী বাহিনীর জন্য শহরে প্রবেশের সংক্ষিপ্ততম পথ এটি।
এর আগে পশ্চিমা বিশ্লেষকরা বলেছিলেন, রাশিয়ান সৈন্যরা আক্রমণের সময় বেলারুশ থেকে কিয়েভ পর্যন্ত দ্রুততম পথটিই বেছে নিবে।
কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস থিঙ্ক ট্যাঙ্কের জেমস অ্যাক্টন বলেন, "পয়েন্ট এ থেকে পয়েন্ট বি পর্যন্ত যাওয়ার এটিই ছিল দ্রুততম উপায়।"
ইউএস আর্মি স্টাফের প্রাক্তন প্রধান জ্যাক কিন বলেন, চেরনোবিলের কোনো 'সামরিক তাৎপর্য' নেই, তবে এটি বেলারুশ থেকে কিয়েভ পর্যন্ত সংক্ষিপ্ততম রুটে অবস্থিত। একে ইউক্রেনীয় সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য রাশিয়ান কৌশলের অংশ হিসেবেও উল্লেখ করেন তিনি।
বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে একযোগে ইউক্রেন আক্রমণকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর একটি ইউরোপীয় রাষ্ট্রে সবচেয়ে বড় আক্রমণ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
চেরনোবিলের দখল নেওয়া রাশিয়ানদের পরিকল্পনার অংশ ছিল উল্লেখ করে একজন সিনিয়র ইউক্রেনীয় কর্মকর্তা বলেন, আক্রমণকারী সৈন্যরা বৃহস্পতিবারই শহরটির দখল নেয়। যদিও, এ তথ্য নিশ্চিত করতে পারেনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
১৯৮৬ সালের বিস্ফোরণে তেজস্ক্রিয় স্ট্রন্টিয়াম, সিজিয়াম এবং প্লুটোনিয়াম মূলত ইউক্রেন এবং প্রতিবেশী বেলারুশের পাশাপাশি রাশিয়া এবং ইউরোপের বেশ কিছু অংশে প্রভাব ফেলে।
পারমাণবিক এই দুর্যোগ থেকে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ মৃত্যুর সংখ্যা বিশ্বব্যাপী কয়েক হাজার। এছাড়া অনুমান করা হয়, তেজস্ক্রিয়তা এবং পরোক্ষ অন্যান্য কারণে বিশ্বজুড়ে প্রায় ৯৩ হাজার মানুষের মৃত্যু হয় এই বিস্ফোরণের পর।
তবে, সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ প্রাথমিকভাবে বিপর্যয় ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে। এমনকি বিস্ফোরণের কথা সেসময় স্বীকারও করেনি সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্বাচেভের সরকার।
অনেকেই চেরনোবিল বিপর্যয়কে সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের একটি অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচনা করেন।
রাশিয়ান সৈন্যদের চেরনোবিল আক্রমণ তেজস্ক্রিয়তা বাড়ার আশঙ্কা আরও গুরুতর করে তুলতে পারে বলে উল্লেখ করেন অ্যাক্টন।
"অবশ্যই চেরনোবিলের মধ্যে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তা একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। তবে এক্সক্লুশন জোনের কারণে তা সম্ভবত ইউক্রেনের বেসামরিক নাগরিকদের উপর খুব বেশি প্রভাব ফেলবে না," বলেন তিনি।
এদিকে বৃহস্পতিবার জাতিসংঘের পারমাণবিক পর্যবেক্ষণ সংস্থা জানিয়েছে, ইউক্রেনের চারটি কর্মক্ষম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিরাপদে চলছে।
কিন্তু অ্যাক্টন বলেন, ইউক্রেনের অন্যান্য চুল্লিগুলো কোনো এক্সক্লুশন জোন দিয়ে পরিবেষ্টিত নয়। এসব চুল্লিতে যে পরিমাণে পারমাণবিক জ্বালানী রয়েছে যা অনেক বেশি তেজস্ক্রিয়।
"সক্রিয় পারমাণবিক কেন্দ্রের আশেপাশে লড়াই করলে তা থেকে বিপর্যয়ের ঝুঁকি অনেক বেশি," বলেন তিনি।
- সূত্র: বিবিসি ও রয়টার্স