লিটনের সেঞ্চুরিতে সিরিজ জিতে ‘নাম্বার ওয়ান’ বাংলাদেশ
প্রথম ওয়ানডের সঙ্গে কতোই না বৈপরীত্য! যে বৈপরীত্যে লেখা হলো বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের বিত্ত-বৈভবের গল্প। আগের ম্যাচে হারতে হারতে ম্যাচ জেতা দলটাই এবার দোর্দণ্ড প্রতাপে শাসন করলো প্রতিপক্ষকে। ম্যাচসেরা লিটন কুমার দাস ও মুশফিকুর রহিমের ব্যাটিং শো-এর পর বল হাতে তাসকিন আহমেদ, সাকিব আল হাসানদের দাপট। সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডেতে বাংলাদেশের বিপক্ষে পাত্তাই পেল না আফগানিস্তান।
শুক্রবার চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে আফগানিস্তানকে ৮৮ রানে হারিয়েছে বাংলাদেশ। এই জয়ে এক ম্যাচ বাকি থাকতেই সিরিজ জিতে নিলো তামিম ইকবালের দল। এটা ঘরের মাঠে টানা পঞ্চম ও সব মিলিয়ে টানা তৃতীয় ওয়ানডে সিরিজ জয় বাংলাদেশের। দ্বিতীয় ম্যাচ জয়ে ইংল্যান্ডকে পেছনে ফেলে আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপ সুপার লিগের শীর্ষস্থানে উঠে গেছে বাংলাদেশ। ১৪ ম্যাচে ১০ জয়ে বাংলাদেশের পয়েন্ট ১০০। ১৫ ম্যাচে ৯ জয়ে ৯৫ পয়েন্ট পাওয়া ইংল্যান্ড এখন দুই নম্বরে। ১২ ম্যাচে ৮ জয়ে ৭৯ পয়েন্ট নিয়ে তিন নম্বরে ভারত।
টস জিতে আগে ব্যাটিং করতে নামে বাংলাদেশ। লিটন কুমার দাসের দারুণ সেঞ্চুরি ও মুশফিকুর রহিমের হাফ সেঞ্চুরিতে ৪ উইকেটে ৩০৬ রানের বড় সংগ্রহ গড়ে বাংলাদেশ। যা এই স্টেডিয়ামের দ্বিতীয় ও বাংলাদেশের সর্বোচ্চ দলীয় সংগ্রহ। জবাবে তাসকিন আহমেদ, সাকিব আল হাসানদের দারুণ বোলিংয়ের মুখেও রহমত শাহ ও নাজিবুল্লাহ জাদরান হাফ সেঞ্চুরি তুলে নেন। তবে তা যথেষ্ট হয়নি, ৪৫.১ ওভারে ২১৮ রানে অলআউট হয়ে যায় আফগানরা।
বড় লক্ষ্যে ব্যাটিং করতে নেমে দুঃস্বপ্নের শুরু হয় আফগানদের। দলীয় ৯ রানেই ওপেনার রিয়াজ হাসান রান আউটে কাট পাড়ে বিদায় নেন। এক ওভার পরই সফরকারীদের চাপ বাড়ান শরিফুল ইসলাম। বাংলাদেশের বাঁহাতি এই পেসার ফিরিয়ে দেন আফগানিস্তানের অধিনায়ক হাসমতউল্লাহ শহিদিকে। কিছুক্ষণ পরই স্পিন ছোবলে আফগানদের দিক ভুলিয়ে দেন সাকিব, তার শিকার আজমতউল্লাহ ওমরজাই।
৩৪ রানে ৩ উইকেট হারানো দলকে পথ দেখানোর দায়িত্ব নেন শুরু থেকে এক পাশ আগলে রাখা ওপেনার রহমত শাহ ও নাজিবুল্লাহ জাদরান। চতুর্থ উইকেটে ৮৯ রানের জুটি গড়ে তোলেন এ দুজন। তাদের ব্যাটে ১২৩ রানে পৌঁছে যায় আফগানিস্তান। ২৫তম ওভারে রহমত শাহর স্টাম্প উপড়ে এই জুটি ভাঙেন তাসকিন আহমেদ। ফেরার আগে ৭১ বলে ৪টি চারে ৫২ রান করেন রহমত।
এই জুটি ভাঙতেই হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে আফগানদের ব্যাটিং লাইন আপ। কিছুক্ষণ পর ফিরে যান নাজিবুল্লাহও। তাসকিনের দ্বিতীয় শিবারে পরিণত হওয়ার আগে ৬১ বলে ৭টি চারে ৫৪ রান করেন বাঁহাতি এই ব্যাটসম্যান। এরপর মোহাম্মদ নবী ও রশিদ খানের ব্যাটে কিছুটা লড়াই করে সফরকারীরা। নবী ৪০ বলে ৩টি চারে ৩২ ও রশিদ ২৬ বলে ৩টি চার ও একটি ছক্কায় ২৯ রান করেন।
আগুনে বোলিং করা তাসকিন ১০ ওভারে ৩১ রান খরচায় ২টি উইকেট নেন। ১০ ওভারে ৩৮ রানে ২ উইকেট নেন সাকিবও। এই ম্যাচে বাংলাদেশের সবচেয়ে খরুচে মুস্তাফিজুর রহমান ৮ ওভারে ৫৩ রানে একটি উইকেট পান। এ ছাড়া শরিফুল ইসলাম, মেহেদী হাসান মিরাজ, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ ও আফিফ হোসেন ধ্রুব একটি করে উইকেট নেন। প্রতিপক্ষকে বাগে পেয়ে এই ম্যাচে সাতজন বোলারকে ব্যবহার করেন বাংলাদেশ অধিনায়ক তামিম ইকবাল।
এর আগে ব্যাটিং করা বাংলাদেশের শুরুটা ভালো ছিল না। যদিও প্রথম ওয়ানডের মতো এই ম্যাচে অগোছালো মনে হয়নি স্বাগতিকদের। লিটন কুমার দাস অতি সাবধানী ছিলেন, তামিমকে বেশ সাবলীল দেখাচ্ছিল। উল্টো আফগানরা এলোমেলো ঠিল। ৩ ওভারে বাংলাদেশের তোলা ২০ রানের মধ্যে তামিম কেবল ৮ রান করেন, লিটন তখনও রানের খাতা খোলেননি। ২০ রানের মধ্যে ১২ রানই অতিরিক্ত দেয় আফগানিস্তান।
এরপরও সুযোগ কাজে লাগাতে পারেনি বাংলাদেশ। দলীয় ৩৮ রানে ফজল হক ফারকীর বলে এলবিডব্লিউ হন তামিম। প্রথম ওয়ানতেও একইভাবে আফগান এই পেসারের বলে এলবিডব্লিউন হন তিনি। এদিন ২৪ বলে ২টি চারে ১২ রান করেন বাংলাদেশের ওয়ানডে অধিনায়ক।
লিটনের সঙ্গে যোগ দেওয়া সাকিব আল হাসানও ধীর স্থির মেজাজে খেলতে থাকেন। তাতে চাপ সামলে নেয় বাংলাদেশ। তবে ইনিংস বড় করতে পারেননি সাকিব। বিশ্বের অন্যতম সেরা এই অলরাউন্ডার ৩৬ বলে ২টি চারে ২০ রান করে আউট হন। এরপর লিটনের সঙ্গে জুটি বাধেন মুশফিক, শুরু হয় তাদের ব্যাটিং শো। যা চলে ৪৬.২ ওভার পর্যন্ত।
অসাধারণ ব্যাটিংয়ে লিটন-মুশফিক ২০২ রানের জুটি গড়েন। যা তৃতীয় উইকেটে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রানের জুটির রেকর্ড। এই জুটি গড়ার মাঝে দুজনই তুলে নেন হাফ সেঞ্চুরি। ৫০ পেরিয়ে সেঞ্চুরিও তুলে নেন লিটন। ওয়ানডেতে এটা তার পঞ্চম সেঞ্চুরি।
হাফ সেঞ্চুরি করলেই সেটাকে সেঞ্চুরিতে রূপ দেওয়াটা যেন নিয়ম বানিয়ে ফেলেছেন লিটন। সর্বশেষ ২০১৯ সালের জুনে ওয়ানডেতে হাফ সেঞ্চুরি করেন তিনি। এরপর তার কোনো হাফ সেঞ্চুরিই অল্পতে থামেনি, প্রতিটা ইনিংসকে সেঞ্চুরিতে রূপ দিয়েছেন লিটন। এ নিয়ে টানা চারটি হাফ সেঞ্চুরিকে সেঞ্চুরিতে পরিণত করলেন বাংলাদেশ দলের অন্যতম এই ব্যাটিং স্তম্ভ।
শেষ পর্যন্ত ১৬টি চার ও ২টি ছক্কায় ১৩৬ রানের অসাধারণ ইনিংস খেলেন ম্যাচসেরা লিটন। ওয়ানডেতে এটা তার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ইনিংস। তবে জহুর আহমেদে এটাই কোনো ব্যাটসম্যানের সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত রানের ইনিংস। লিটনের বিদায়ের পরের বলে থামেন মুশফিকও। লিটনের মতো তিনিও আফগান পেসার ফরিদ আহমেদের শিকারে পরিণত হন। এর আগে ৯৩ বলে ৯টি চারে ৮৬ রানের দারুণ এক ইনিংস খেলেন মুশফিক, ওয়ানডেতে এটা তার ৪১তম হাফ সেঞ্চুরি।
লিটন-মুশফিকের বিদায়ে রান তোলার গতি কমে যায় বাংলাদেশের। শেষ দিকে রান তুলতে পারেননি আফিফ হোসেন ধ্রুব ও মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। আফিফ ৯ বলে ৬ ও মাহমুদউল্লাহ ১৩ বলে ১২ রানে অপরাজিত থাকেন। বাংলাদেশের ইনিংসের সর্বোচ্চ রান লিটনের, ১৩৬। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৮৬ রান মুশফিকের। তৃতীয় সর্বোচ্চ রান আসে অতিরিক্ত থেকে, আফগানরা এদিন ৩৩ রান অতিরিক্ত দেয়। সফরকারী দলটির পক্ষে ফরিদ আহমেদ ২টি এবং ফজল হক ও রশিদ খান একটি করে উইকেট নেন।