রাশিয়ান গ্যাসের অভাবে অন্য দেশের জন্য নির্ধারিত এলএনজির চালানের উপর ইউরোপের চোখ এখন
ইউরোপের জ্বালানির ভবিষ্যৎকে অনিশ্চয়তায় ফেলেছে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন। বিশেষত, পাইপলাইনে আমদানি করা প্রাকৃতিক গ্যাসের ক্ষেত্রে একথা চরম সত্য। মহাদেশটির জ্বালানি চাহিদার এক-চতুর্থাংশই পূরণ করে গ্যাস।
২০১৯ সালে রাশিয়া এ চাহিদার ৪০ শতাংশ সরবরাহ করেছে। তাই হয়তো ইউক্রেন নিয়ে পশ্চিমা বিশ্ব একাট্টা হওয়ার পর- এখনও দেয়নি রাশিয়ার গ্যাস রপ্তানিতে কঠোর নিষেধাজ্ঞা। জার্মানি অবশ্য নর্ড স্টিম- টু পাইপলাইন সচল করা স্থগিত করেছে। রাশিয়া ও জার্মানির মাঝে গ্যাস সংযোগের এ লাইনটি স্থাপনের কাজ শেষ হলেও, আবারও ভূরাজনৈতিক কারণে মুখ থুবড়ে পড়ল।
কিন্তু, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন-ই যদি পশ্চিমে গ্যাস রপ্তানি বন্ধ করে দেন? তাহলে বিকল্প একটি উৎস হতে পারে- সমুদ্রপথে ট্যাংকার জাহাজে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি। এখানেও রয়েছে প্রশ্ন: এই উৎস থেকে আমদানি বাড়িয়ে কি আদৌ ইউরোপে রাশিয়ার গ্যাস সরবরাহের ঘাটতি মেটানো সম্ভব?
সন্দেহ নেই- ইউরোপ বিপুল পরিমাণ এলএনজি ব্যবহার করে। অঞ্চলটির মোট প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানির প্রায় ২৫ শতাংশই হচ্ছে এলএনজি। তবে জাহাজে আনা এলএনজিকে আবার উপকূলের কাছাকাছি টার্মিনালে গ্যাসে রূপান্তর (রিগ্যাস) করতে হয়। এরপর তা আবার পাইপলাইনে করে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বা বাসাবাড়িতে সরবরাহ করতে হয়। প্রধান প্রশ্ন হলো- ইউরোপ কতটুকু এলএনজি প্রক্রিয়াকরণের ক্ষমতা বাড়াতে পারবে? সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ইউরোপের রিগ্যাসিফিকেশন প্ল্যান্টগুলোয় বিপুল বিনিয়োগ হয়েছে। সে হিসাবে রয়েছে তাদের বাড়তি প্রক্রিয়াকরণ ক্ষমতাও।
যেমন গত বছর ইউরোপের আমদানি টার্মিনালগুলো তাদের সক্ষমতার মাত্র ৪৫ শতাংশ ব্যবহার করেছে বলে জানায় সংশ্লিষ্ট শিল্পের তথ্য পরিবেশক এনার্জি ইন্টেলিজেন্স।
মুশকিল কিন্তু অন্যখানে। ইউরোপের সব টার্মিনাল সঠিক স্থানে নির্মিত হয়নি। যেমন জার্মানির কোনো টার্মিনাল নেই। সে তুলনায় স্পেনের কাছে আছে মহাদেশটির ২৫ শতাংশ সক্ষমতা। অথচ স্পেনের এসব গ্যাস অবকাঠামো বাকী ইউরোপ থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন।
আরেক গুরুতর সমস্যা উৎস থেকে এলএনজির সরবরাহ। বিশ্বের বড় তিন এলএনজি রপ্তানিকারক আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও কাতার। এসব দেশের বিপুল মজুদ থাকলেও, এখনই তারা সক্ষমতার পূর্ণমাত্রায় রপ্তানি করছে অথবা চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে। তাছাড়া, গ্যাস তরলীকরণ এবং সে অনুপাতে ট্যাংকার জাহাজে রপ্তানি বৃদ্ধি রাতারাতি করা যায় না, এজন্য প্রয়োজন হয় দীর্ঘসময়।
এ বাস্তবতায় ইউরোপের জন্য জরুরি চালান পাওয়ার একমাত্র সমাধান হতে পারে, অন্য কোনো দেশে রপ্তানির জন্য নির্ধারিত কার্গোকে অধিকার করা।
জ্বালানির বড় ক্রেতা ইউরোপ একাই নয়, এশিয়াতেও রয়েছে শক্তিশালী চাহিদা। এশিয়ায় এক চীনেরই এলএনজি আমদানি ২০১৭ থেকে ২০২০ সালের মাঝামাঝি সময়ে বেড়েছে ৮২ শতাংশ। গত বছর জাপানকে পেছনে ফেলে পণ্যটির সবচেয়ে বড় আমদানিকারক হয়ে উঠেছে চীন। তাছাড়া, বিশ্বের মোট এলএনজি বাণিজ্যের ৭০ শতাংশই ১০ বছর বা তার চেয়ে বেশি দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির ভিত্তিতে হয়। সে তুলনায় ইউরোপ বেশি নির্ভর করে স্বল্পমেয়াদী চুক্তি ও স্পট মার্কেটে। অতীতে এ নির্ভরতা ইউরোপকে বাজারে যখন গ্যাসের স্টক পর্যাপ্ত থাকায় কম দর ছিল- তার সুযোগ নিতে দিয়েছে। তবে এতে করে বাজারের অনুকূল/ প্রতিকূল পরিস্থিতির ওপর ইউরোপের নির্ভরতা বেড়েছে।
বসন্ত ও শীতকালে যখন রাশিয়ার সরবরাহ কমে আসায় ইউরোপের গ্যাস রিজার্ভ প্রায় শূন্যের কোঠায় পৌঁছায়, তখন এলএনজি আমদানি লক্ষণীয় উল্লম্ফন দেখা যায়, সমানতালে বেড়ে যায় দাম। অতীতে এশিয়ায় গ্যাসের স্পট মার্কেটের দর ইউরোপের চেয়ে উচ্চ ছিল। কিন্তু, সাম্প্রতিক কয়েক মাসে ইউরোপের স্পট মার্কেটের দর এশিয় বাজারের সমান মাত্রায় পৌঁছেছে। ইউক্রেন আগ্রাসনের পর হয়েছে দর পরিস্থিতির আরও অবনতি। গেল ২৪ ফেব্রুয়ারি ভ্লাদিমির পুতিন দেশটিতে রুশ বাহিনীর বিশেষ অভিযানের ঘোষণা দেওয়ার পর- মাত্র একদিনেই উত্তরপশ্চিম ইউরোপে এলএনজি সরবরাহের দাম ২৯ শতাংশ বেড়েছে।
এ বাস্তবতায় ইউরোপের নেতারা যেকোনো উপায়ে এলএনজির নতুন চালান নিশ্চিত করার চেষ্টা করছেন। মিত্র ইউরোপের জ্বালানি সংকটের এ সময়ে আমেরিকাও সরবরাহ খুব বেশি বাড়াতে পারছে না। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন অবশ্য ইউরোপের জন্য উৎস সন্ধানে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এপর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের সে কূটনৈতিক চেষ্টায় ফলাফল যৎসামান্য। চলতি ফেব্রুয়ারি মাসেই কাতারের জ্বালানিমন্ত্রী বলেছেন, রাশিয়ার গ্যাস সরবরাহের ঘাটতি পূরণের মতো বিপুল পরিমাণে এলএনজি অতি দ্রুত সরবরাহ করা তার দেশের পক্ষে 'প্রায় অসম্ভব।
শুধু এলএনজি নয়, রাশিয়ার সরবরাহ বিচ্ছিন্নতায় অন্য পণ্যের ঘাটতিও ইউরোপকে পূরণ করার চ্যালেঞ্জ নিতে হবে। তবে আপাতত এলএনজির ঘাটতি পূরণই সবচেয়ে কঠিন কাজ।
- সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট