ইউক্রেন সংকট: রাশিয়ার এই ক্রান্তিকালে চীন কি পারবে দেশটিকে সাহায্য করতে?
ইউক্রেনে আক্রমণ শুরু করার পর বাণিজ্য খাতে রাশিয়া তার প্রধান প্রধান অংশীদারদের হারিয়েছে। ইইউ এবং যুক্তরাজ্যের মতো দীর্ঘদিনের অংশীদাররা কড়া অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে দেশটির উপর। রাশিয়ার এই ক্রান্তিকালে চীন কি পারবে দেশটিকে অর্থনৈতিকভাবে সাহায্য করতে?
রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা কি বাণিজ্যে প্রভাব ফেলবে?
চীন বলেছে, তারা রাশিয়ার সঙ্গে স্বাভাবিক বাণিজ্য সহযোগিতা অব্যাহত রাখবে।
কিন্তু বেশ কিছু রাশিয়ান ব্যাংককে সুইফট আন্তর্জাতিক পেমেন্ট সিস্টেম থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে। বিশ্বজুড়ে আর্থিক লেনদেনের জন্য ব্যবহৃত হয় এই পেমেন্ট সিস্টেমের সাহায্য ছাড়া রাশিয়ার জন্য রপ্তানির অর্থ গ্রহণ করা আরও কঠিন হয়ে উঠবে।
চীন ইতোমধ্যে রাশিয়ার সঙ্গে তাদের বেশ কিছু আমদানি পরিকল্পনা বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে, কারণ ব্যবসায়ীরা টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারছিল না।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, সুইফটের মতো ডলার-ভিত্তিক ব্যবস্থার উপর নির্ভরতা কমিয়ে নিজস্ব বিকল্প অর্থপ্রদান ব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে এ দুই দেশ।
অর্থ স্থানান্তরের জন্য রাশিয়ার রয়েছে এসটিএফএম নামের একটি পেমেন্ট ব্যবস্থা। চীনের রয়েছে ক্রস-বর্ডার ইন্টারব্যাঙ্ক পেমেন্ট সিস্টেম (সিআইপিএস)। এগুলো তাদের নিজস্ব মুদ্রায় কাজ করে।
এই দেশীয় পেমেন্ট সিস্টেমগুলোকে সুইফটের বিকল্প হিসেবে মানতে নারাজ বিশেষজ্ঞরা। ২০২১ সাল পর্যন্ত, মাত্র একটি চীনা ব্যাঙ্ক এসটিএফএমে যোগ দিয়েছে। যদিও বেশ কিছু রুশ ব্যাঙ্ক এবং বৈশ্বিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান চীনা পেমেন্ট সিস্টেমের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।
রাশিয়ার সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমানে রাশিয়া ও চীনের মধ্যকার হওয়া ১৭ শতাংশ বাণিজ্যে চীনা ইউয়ান ব্যবহার করা হয় (২০১৪ সালে যা ছিল মাত্র ৩ শতাংশ)।
তবে জ্বালানি খাতে তাদের বেশিরভাগ বাণিজ্য এখনও মার্কিন ডলারেই হয়। এই খাতেও ইউয়ান ব্যবহারের হার দিন দিন বাড়ছে।
চীনের সঙ্গে রাশিয়ার বাণিজ্যের পরিধি কতটুকু?
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই দুই দেশের মধ্যকার বাণিজ্যের হার ক্রমাগত বেড়েছে।
গত বছর নিজেদের মধ্যে প্রায় ১৪ হাজার ৭০০ কোটি মার্কিন ডলারের বাণিজ্য করেছে চীন ও রাশিয়া, যা তাদের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এই অঙ্কটি আগের বছরের তুলনায় ৩৬ শতাংশ বেশি এবং ২০২১ সালে রাশিয়ার সামগ্রিক বাণিজ্যের প্রায় ১৮ শতাংশ।
গত মাসে রাশিয়া প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বেইজিং সফরের সময় দুই দেশ বলেছে, তারা ২০২৪ সালের মধ্যে নিজেদের মধ্যকার বাণিজ্যের পরিমাণ ২৫ হাজার ৫০০ কোটি ডলারে উন্নীত করবে।
তেল, গ্যাস, কয়লাসহ রাশিয়ান রপ্তানিকারক পণ্যগুলোর জন্য চীনই সবচেয়ে বড় বাজার। সেটি বুঝতে পেরে গত কয়েক বছরে রাশিয়া পূর্বের তুলনায় অনেক বেশি পণ্য রপ্তানি করেছে চীনে।
তবে, জোট হিসেবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাণিজ্য খাতে রাশিয়ার সবচেয়ে বড় অংশীদার। ২০২১ সালে এই দুই পক্ষের মোট বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল চীন-রাশিয়া বাণিজ্যের প্রায় দ্বিগুণ।
বাণিজ্য অর্থনীতিবিদ ড. রেবেকা হার্ডিং-এর মতে, এখন পরিবর্তন হতে যাচ্ছে এই সম্পর্ক।
তিনি বলেন, "এটা নিশ্চিত, সাম্প্রতিক নিষেধাজ্ঞার আলোকে ইইউ-রাশিয়া বাণিজ্য হ্রাস পাবে। বর্তমান সংকট ইইউর সাপ্লাই চেইনে বৈচিত্র্য আনার প্রয়োজনীয়তাকে ফুটিয়ে তুলেছে। আর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রাশিয়ার বাণিজ্য এমনিতেও অনেক কম।"
চীন কি আরও রাশিয়ান গ্যাস কিনবে?
রাশিয়ার অর্থনীতি তেল এবং গ্যাস রপ্তানির উপর অনেক বেশি নির্ভর করে। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞাগুলো এখনও পর্যন্ত এই খাত দুটিকে লক্ষ্যবস্তু বানায়নি।
গত বছর রাশিয়া ছিল চীনের দ্বিতীয় বৃহত্তম তেল সরবরাহকারী এবং তৃতীয় বৃহত্তম গ্যাস সরবরাহকারী। এই দুই খাতে চীনে যথাক্রমে ৪১ হাজার ১০০ কোটি ও ৪ হাজার ৩০০ কোটি ডলারের রপ্তানি করেছে রাশিয়া।
কিন্তু এরপরও রাশিয়ার সবচেয়ে বড় জ্বালানি বাজার ইইউই। এই জোটের ৪০ শতাংশ গ্যাস ও ২৬ শতাংশ তেল আসে রাশিয়া থেকে।
ড. হার্ডিং বলেন, "গত পাঁচ বছর ধরে চীনে রাশিয়ার তেল ও গ্যাস রপ্তানি (বছরে) ৯ শতাংশের চেয়েও বেশি হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তারপরও, রাশিয়ান তেলের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজার এখনও চীনের দ্বিগুণ।"
প্রাকৃতিক গ্যাসের ক্ষেত্রে রাশিয়ার প্রধান আমদানিকারক জার্মানি। কিন্তু সম্প্রতি ইউক্রেনে শুরু হওয়া রুশ আগ্রাসনের ভিত্তিতে দুই দেশের মধ্যকার নতুন যে গ্যাস পাইপলাইন (নর্ড স্ট্রিম টু) হওয়ার কথা ছিল সেটি স্থগিত করেছে জার্মানি।
চীন ও রাশিয়া নতুন যে গ্যাস পাইপলাইন তৈরির ব্যাপারে সম্মত হয়েছে (পাওয়ার অফ সাইবেরিয়া টু), সেটির ক্ষমতা নর্ড স্ট্রিম পাইপলাইনের এক পঞ্চমাংশ।
তবে গ্রিনহাউজ গ্যাস কমানোর লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে চীন দীর্ঘ মেয়াদে রাশিয়া থেকে গ্যাসের আমদানি আরও বাড়াতে পারে।
রাশিয়া বিশ্বের বৃহত্তম গম রপ্তানিকারক। রোগ-বালাই সংক্রান্ত উদ্বেগের কারণে রাশিয়ার নির্দিষ্ট কিছু এলাকা থেকে আগে আমদানি বন্ধ রেখেছিল চীন। কিন্তু ইউক্রেনের ওপর হামলা শুরু হওয়ার দিনই রাশিয়ার গম ও বার্লির ওপর থেকে সমস্ত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার ঘোষণা দেয় চীনা শুল্ক কর্তৃপক্ষ ।
কয়লার ক্ষেত্রে চীন রাশিয়ার বৃহত্তম ক্রেতা। এক সপ্তাহ আগেই এই দুই দেশ ২০ হাজার কোটি ডলারের একটি নতুন কয়লা চুক্তিতে সম্মত হয়েছে।
সূত্র: বিবিসি।