রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা যেভাবে ভোগাবে পশ্চিমাদেরও
পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় হিমশিম খাচ্ছে রাশিয়ার অর্থনীতি। কিন্তু ক্ষতি যে কেবল একা রাশিয়াকেই টানতে হচ্ছে এমন নয়। বরং মস্কোকে যারা বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করছে সেই দেশগুলোই এখন অর্থনৈতিক হুমকির সম্মুখীন। তেল, গ্যাস ও খাদ্যশস্যের মতো অবিচ্ছেদ্য পণ্যগুলোর দাম হু হু করে বাড়ছে। ইতোমধ্যেই সেই আঁচ টের পেতে শুরু করেছে বিশ্ব অর্থনীতি।
রাশিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞার মূল্য এখন স্বয়ং যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলোকে চোকাতে হবে বলে মন্তব্য অর্থনীতিবিদদের। শুধু পশ্চিমাদের নয়, গোটা বিশ্বকে এই নিষেধাজ্ঞা কী ধরনের ভোগান্তিতে ফেলতে চলেছে, দেখে নেওয়া যাক।
১। বিশ্বজুড়ে জ্বালানি মূল্যবৃদ্ধির ভুক্তভোগী হবে সাধারণ মানুষ
নিষেধাজ্ঞার পর সবচেয়ে বড় ও তাৎক্ষণিক প্রভাব পড়েছে পেট্রোলিয়াম ও প্রাকৃতিক গ্যাস খাতে, যেখানে রাশিয়া বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ রপ্তানিকারক। জ্বালানির মূল্য এখন ৫০ বছরের মধ্যে দ্রুততম হারে বাড়ছে, যার ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ। জ্বালানির মূল্য বাড়ায় ব্যবসায়িক ক্ষেত্র ছাড়াও গৃহস্থালির খরচ বেড়েছে।
তেলের দাম এক দশকের বেশি সময়ে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। এই সপ্তাহে ব্যারেল প্রতি দাম ১৩০ মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে। পাইকারি প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম ইতোমধ্যেই রেকর্ড পর্যায়ে রয়েছে। ইউরোপের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো গ্যাসের দাম প্রতি ১,০০০ ঘনমিটারে ৩,৯০০ মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেছে।
২। জ্বালানি সংকট থেকে সৃষ্টি হতে পারে বিশ্বমন্দা
রাশিয়াকে জ্বালানি সরবরাহ থেকে বিচ্ছিন্ন করার ফল কেবল ইউরোপ নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বাকি বিশ্বের জন্যও মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে পারে। ওয়াশিংটন চলতি সপ্তাহে রাশিয়ার হাইড্রোকার্বনের ওপর নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করেছে, ফলে অপরিশোধিত জ্বালানির দাম রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে। ইউরোপ বলছে তারা এই বছর রাশিয়ার প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে আনবে। রাশিয়া ইঙ্গিত দিয়েছে যে অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব বাড়তে থাকলে তারা তেল ও গ্যাস রপ্তানি কমাতে পারে। ফলে জ্বালানি সংকট মারাত্মক রূপ ধারণ করার আশঙ্কা রয়েছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের মতে, জ্বালানির দাম বৃদ্ধির অর্থনৈতিক প্রভাব ইতোমধ্যেই 'গুরুতর' রূপ ধারণ করেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, আগামী ১২ মাসের মধ্যে রাশিয়ান তেল এবং গ্যাস সরবরাহ থেকে সরে এসে বিকল্প উৎস বেছে নিতে চাইলে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ নিশ্চিতভাবেই মন্দায় পড়তে চলেছে। এর মধ্যে ইউরোপের জন্য এ ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।
৩। মুদ্রাস্ফীতির শঙ্কা
কোভিড-১৯ মহামারির সময় গত দুই বছরে অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব মোকাবেলায় বিশ্বজুড়েই বিভিন্ন দেশের সরকার বিপুল পরিমাণে মুদ্রা ছাপায়। ফলস্বরূপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো পশ্চিমা দেশগুলোর মুদ্রাস্ফীতি এখন রেকর্ড পর্যায়ের কাছাকাছি৷ এরই মধ্যে বৈশ্বিক জ্বালানি সংকটের কারণে সব ভোগ্যপণ্যের দামও বাড়তে থাকবে। ফলে মুদ্রাস্ফীতিও ভয়াবহ রূপ নিতে চলেছে বলেই আশঙ্কা।
৪। বিশ্বব্যাপী খাদ্যদ্রব্যের দাম বৃদ্ধি
বৈশ্বিক রুটির ঝুড়ি খ্যাত ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে ইতোমধ্যে খাদ্য ও কৃষি পণ্যের রপ্তানি কমে যাওয়ার যে সংকটের সৃষ্টি হয়েছে তা বাড়িয়ে তুলতে পারে মস্কোর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা। বিশ্বব্যাপী গম রপ্তানির ৩০ শতাংশ আসে এই দুটি দেশ থেকে।
বিশেষজ্ঞরা আরও সতর্ক করেছেন যে রাশিয়া ও বেলারুশের ওপর নিষেধাজ্ঞার কারণে বিশ্বজুড়ে সার সরবরাহও হ্রাস পেতে পারে। দেশ দুটি বিশ্বের পটাশ উৎপাদনের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি নিয়ন্ত্রণ করে, যা সারের একটি মূল উপাদান।
গবেষণা সংস্থা সিএফআরএ-র তথ্য অনুসারে, রাশিয়া নাইট্রোজেনযুক্ত সার উৎপাদনের ১৪ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে। সার সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিলে তা খাদ্যদ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধিতেও ভূমিকা রাখবে।
৫। অ্যাভিয়েশন খাতে বড় ধাক্কা
রাশিয়ান এয়ারলাইনসের ওপর ৩০টিরও বেশি দেশের আরোপিত ফ্লাইট নিষেধাজ্ঞায় বিশ্বের ভ্রমণ ও এয়ারলাইন খাতের ওপর প্রভাব পড়েছে। খাতটি ইতোমধ্যে করোনাভাইরাস মহামারির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত। অ্যারোফ্লট ও এস৭ এয়ারলাইনসের মতো রাশিয়ান বিমান সংস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা এই নিষেধাজ্ঞার কারণে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এছাড়া ফ্লাইটগুলো রাশিয়ান আকাশসীমা এড়িয়ে চলায় দীর্ঘ রুট বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছে। এরসঙ্গে জ্বালানির বাড়তি মূল্য তো আছেই। এ কারণে টিকিটের দাম ও পণ্য পরিবহন ব্যয়ও বাড়তে চলেছে বলে বিশ্লেষকদের ধারণা।
ইউরোপীয় অনেক এয়ারলাইনসই রাশিয়ান এয়ারলাইনগুলোর কাছে কয়েকশ প্লেন ইজারা দিয়ে রেখেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইজারাদানকারী সংস্থাগুলোকে রাশিয়ায় সঙ্গে বর্তমান চুক্তিগুলো শেষ করতে ২৮ মার্চ পর্যন্ত সময় দিয়েছে। কিন্তু আকাশসীমার নিষেধাজ্ঞা ও রাশিয়ান সরকারের অভ্যন্তরীণ সক্ষমতা বাড়াতে বিমানবহর জাতীয়করণের পরিকল্পনার মধ্যে বিমানগুলো উড়িয়ে আনার জন্য এখন সংস্থাগুলোকে নতুন কৌশল খুঁজে বের করতে হবে।
এয়ারবাস এবং বোয়িংয়ের মতো প্রধান প্রধান বিমান নির্মাতা সংস্থাগুলোও রাশিয়ার বিচ্ছিন্নতার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তারা যে শুধু বিশাল বাজার হারাচ্ছে তাই নয়, বিমান তৈরির জন্য রাশিয়া টাইটানিয়ামের মতো গুরুত্বপূর্ণ উপাদান সরবরাহ করে। ফলে বিমান নির্মাণেও খরচ বাড়তে চলেছে।
৬। ধাতব পদার্থের সরবরাহ সংকটে অন্যান্য পণ্যের মূল্যও বাড়বে
রাশিয়া বিশ্ব অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু খনিজ পদার্থের প্রধান রপ্তানিকারক। নিষেধাজ্ঞার ফলে ধাতুর আকাশছোঁয়া দামের পাশাপাশি সরবরাহ ঝুঁকিতে রয়েছে গাড়ি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। সোমবার অ্যালুমিনিয়াম এবং প্যালাডিয়াম দুটি ধাতুর মূল্যই রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছে। স্টেইনলেস স্টিলের জন্য প্রয়োজনীয় নিকেলের দামও মঙ্গলবার রেকর্ড অতিক্রম করেছে।
এদিকে কয়লার দাম বাড়ছে হু হু করে। চলতি সপ্তাহে প্রতি টন কয়লার দাম ৪০০ ডলার ছাড়িয়েছে। সরবরাহের অনিশ্চয়তা এবং তীব্র চাহিদার মাঝে ২০২১ সালের দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই খনিজ পদার্থের দাম বাড়ছে। তার সঙ্গে এই নিষেধাজ্ঞার ফলে সৃষ্টি হলো নতুন উদ্বেগ।
৭। রাশিয়াকে একঘরে করে ভুগছে ইউরোপীয় ব্যবসায়ীরাও
ইউরোপীয় দেশগুলোর সঙ্গে রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সম্পর্ক আছে। আর তাই যেকোনো বাণিজ্যিক ও আর্থিক নিষেধাজ্ঞা উভয় পক্ষকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে। তবে ১৪৪ মিলিয়ন জনগোষ্ঠীর বিশাল রাশিয়ান বাজার হারানোর ফলে ইউরোপীয় ব্যবসায়ীরা মারাত্মক সংকটে পড়বে।
২০২১ সালে রাশিয়ার সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর বাণিজ্যের পরিমাণ বার্ষিক ৪২.৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ২৪৭ বিলিয়ন ইউরোতে পৌঁছেছে। রাশিয়া ইইউ-র পণ্য রপ্তানির জন্য পঞ্চম বৃহত্তম অংশীদার। এছাড়া পণ্য আমদানিতে দেশটি তৃতীয় বৃহত্তম। ইইউ ইতোমধ্যেই মস্কোর বিরুদ্ধে কয়েক দফা কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় ইউরোপের ব্যবসায়িক খাত মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
৮। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে কার
রাশিয়া যদি চীনের মতো মিত্র দেশগুলোর সাহায্যে নিজেকে পুনর্গঠিত করে তাহলে ইউরোপীয় দেশ ও তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যই এই নিষেধাজ্ঞায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
হোয়াইট হাউস সম্প্রতি জানায়, রাশিয়ার সঙ্গে চীনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক মস্কোর উপর মার্কিন ও ইউরোপীয় নিষেধাজ্ঞার প্রভাব কমানোর জন্য যথেষ্ট নয়। তবে বাস্তবতা এই যে ইউক্রেন যুদ্ধ সত্ত্বেও দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সোমবার প্রকাশিত চীনা কাস্টমসের তথ্য অনুসারে, গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এই বছরের প্রথম দুই মাসে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক টার্নওভার প্রায় ৩৯ শতাংশ বেড়ে ২৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে। ২০২৪ সালের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ২০০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে মস্কো ও বেইজিং। ফলে, রাশিয়া নিজেদের সামলে নিলেও ইউরোপের বড় ধরনের সংকটের মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা থাকছে।