উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাধাগ্রস্ত হচ্ছে সরকারি প্রতিষ্ঠানের পরস্পরের বিরুদ্ধে মামলায়
সাম্প্রতিক কয়েক বছর ধরে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে বিরোধ ও মামলার সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এর ফলে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ। মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন সরকারি সংস্থার নিজেদের মধ্যে এরকম মামলার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ৪০০-তে।
একদিকে এসব মামলা যেমন বাড়ছে, অন্যদিকে এরকম মামলা নিষ্পত্তির হারও অত্যন্ত কম। এর ফলে সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের ব্যয় ও সময় দুটোই বেড়ে যাচ্ছে। এসব মামলার সঙ্গে সরকারের বিভিন্ন সম্পত্তি ও উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা জড়িত বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা। এসব মামলার অধিকাংশই দায়ের হয়েছে জমি-সংক্রান্ত বিরোধের জেরে।
এছাড়া সরকারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সরকারি প্রতিষ্ঠানের মামলা বলে বাদী-বিবাদী উভয়পক্ষই আদালতে বিব্রতকর অবস্থায় পড়ছে বলে জানান বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশনের (বিজেএমসি) আইনজীবী ব্যারিস্টার মাসুদুর রহমান। গণপূর্ত অধিদপ্তরের (পিডব্লিউডি) বিরুদ্ধে ৩১ বছরের পুরোনো একটি ভূমি-সংক্রান্ত মামলায় বিজেএমসির প্রতিনিধিত্ব করছেন এই আইনজীবী।
গাইবান্ধা শহরে বিজেএমসির তিন একর জায়গায় সরকারি কর্মকর্তাদের আবাসিক ভবন করার জন্য জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে ১৯৯১ সালে নামমাত্র মূল্যে অধিগ্রহণ করে গণপূর্ত অধিদপ্তর। সে থেকেই দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিরোধের সূচনা। ১৯৯১ সালেই অধিগ্রহণের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করে বিজেএমসি। ওই বছরের জুলাইয়ে হাইকোর্ট ওই অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া ছয় মাসের জন্য স্থগিত করে আদেশ দেয়। সেইসঙ্গে অধিগ্রহণ কেন অবৈধ হবে না, তা জানতে চেয়ে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, গণপুর্ত অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসকের প্রতি রুল জারি করেন আদালত। এরপর ৩০ বছর পেরিয়ে গেলেও করলেও ওই রিট এখন পর্যন্ত নিষ্পত্তি হয়নি। ওই জায়গাটি এখন বিজেএমসির নাকি গণপূর্তের, সেটিরও সমাধান হয়নি।
ফলে বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী প্রায় ১৫ কোটি টাকা মূল্যের এই সম্পত্তি এখনও পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। পরে ওই আবাসন প্রকল্প অন্য এলাকায় স্থানান্তর করা হয়।
মাসুদুর রহমান বলেন, 'সরকারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সরকারি প্রতিষ্ঠানের মামলা বলে উভয়পক্ষ এই মামলা পরিচালনায় বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়ে গেছে। ফলে এই মামলা নিয়ে আর কেউ এগোয়নি।'
আইন মন্ত্রণালয়ের সলিসিটর উইংয়ের তথ্য বলছে, সরকারের বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে ২০১৭ সাল থেকে এসব বিচারাধীন মামলার পরিমাণ ক্রমেই বাড়ছে। বর্তমানে এরকম মামলার সংখ্যা ১১ হাজার ৪০০টি। এসব মামলার মধ্যে ৬ হাজার ৮০০টি রিট মামলা হাইকোর্টে বিচারাধীন রয়েছে। এর মধ্যে ৩ হাজার ২০০টি রিট ১০ বছরের বেশি সময় ধরে বিচারাধীন।
৩৪০টি আপিল সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে বিচারাধীন রয়েছে। এর মধ্যে ১২০টির মতো আপিল ১০ বছরের বেশি পুরোনো। বাকি ৪ হাজার ২৬০টি মামলা নিম্ন আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।
সলিসিটর উইংয়ের তথ্য বলছে, ২০১৭ সাল থেকে বছরে গড়ে ৪৩২টি মামলা নিষ্পত্তি করা হয়েছে।
আর এসব মামলা পরিচালনায় প্রতিবছর সরকারের হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ হচ্ছে। যাকে অপচয় বলেছেন আইন বিশেষজ্ঞরা।
এসব মামলা পরিচালনায় বছরে প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে। এরকম অর্থব্যয়কে 'জনগণের টাকার অপচয়' বলছেন আইন বিশেষজ্ঞরা।
ঘাট সরেছে, কিন্তু মামলা নিশ্চল
২০১৩ সালে বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন করপোরেশনকে (বিআইডব্লিউটিসি) ঘাট সংস্কারে ৬১ কোটি টাকার বরাদ্দ দেয় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। ওই বছরই একই এলাকায় নদীশাসন ও বাঁধ নির্মাণের জন্য পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় (বিডব্লিউডিবি) বরাদ্দ দেয় ১৫০ কোটি টাকা।
বিআইডব্লিউটিসির ঘাট আগে সংস্কার হবে নাকি নদীশাসন ও বাঁধ নির্মাণের কাজ আগে হবে, তা নিয়ে দুই বিভাগর মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়।
বিআইডব্লিউটিসির দাবি, বাঁধ নির্মাণ ও নদীশাসনের কাজ হওয়ার পর তারা ঘাট সংস্কার করবে। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ডের দাবি, ঘাটের এলাকায় বিআইডব্লিউটিসি নদীশাসন ও বাঁধ নির্মাণসহ ঘাট সংস্কারের কাজ করবে।
পরবর্তীতে এ নিয়ে হাইকোর্টে রিট করে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ২০১১ সালের ডিসেম্বরে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রতি চার সপ্তাহের রুল জারি করে। এখন পর্যন্ত ওই রুলের শুনানি হয়নি।
সরকারের বরাদ্দ দেওয়া অর্থ কাজে লাগাতে পারেনি কোনো সংস্থাই। পরবর্তীতে নতুন করে ১২০ কোটি টাকার বরাদ্দ নিয়ে অন্য এলাকায় নতুন করে একটি ঘাট তৈরি করে বিআইডব্লিউটিসি। কিন্তু দুই সংস্থার আইনি লড়াইয়ের নিষ্পত্তি এখনও হয়নি।
বিআইডব্লিউটিসির আইনজীবী ব্যারিস্টার রাফসান আলভী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও পানি উন্নয়ন বোর্ড বারবার সময় নিয়েছে এই রিট শুনানির জন্য। এরমধ্যে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চের এখতিয়ার বারবার পরিবর্তন হওয়ায় আর শুনানি সম্ভব হয়নি।'
বাধাগ্রস্ত হচ্ছে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড
সলিসিটর উইংয়ের দেওয়া তথ্য বলেছে, সবচেয়ে বেশি মামলা রয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ের। রেলওয়ের সঙ্গে গণপূর্ত অধিদপ্তর, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ), বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড, খাদ্য মন্ত্রণালয় এবং বিভিন্ন জেলা প্রশাসনের বিরোধ-সংক্রান্ত মামলা রয়েছে ২ হাজার ১৮০টি। ১ হাজার ৪০০ বিচারাধীন মামলা নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। ভূমি জরিপ অধিদপ্তরের বিরুদ্ধে সরকারের বিভিন্ন বিভাগের মামলা রয়েছে প্রায় ১ হাজার ২০০।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী অ্যাডভোকেট নুরুল ইসলাম সুজন বলেন, এসব মামলার সিংহভাগই অনেক আগের। 'তবে এখন আর সেভাবে মামলা হচ্ছে না।'
তিনি বলেন, এসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে রেলপথ মন্ত্রণালয় কাজ করছে। দ্রুত সমাধানের একটা পথ বের করা হচ্ছে।
রেলওয়ের অধিকাংশ মামলাই গণপূর্ত অধিদপ্তর, সওজ, পানি উন্নয়ন বোর্ড, খাদ্য মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন জেলা প্রশাসনের বিরুদ্ধে।
রেলমন্ত্রী টিবিএসকে বলেন, 'এসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে রেলপথ মন্ত্রণালয় কাজ করছে। দ্রুত সমাধানের একটা পথ বের করা হচ্ছে।'
তিনি আরও জানান, এসব মামলার কারণে রেলওয়ের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ আটকে আছে বছরের পর বছর।
এছাড়া এসব মামলার জন্য আরও অনেক সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ কাজ আটকে আছে বলেও জানান রেলমন্ত্রী।
মামলা পরিচালনায় জনগণের অর্থ অপচয়
সলিসিটির উইংয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, এসব মামলা পরিচালনায় সরকারের বিভিন্ন বিভাগ ও সংস্থা বছরে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা খরচ করেছে। এ অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে আইনজীবী নিয়োগ, মামলার কাগজপত্র প্রস্তুত করা, মামলা দায়ের, আপিল দায়েরসহ নানা কাজে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সলিসিটর উইংয়ের ওই কর্মকর্তা জানান, দেশের সবগুলো মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থার প্রায় ২ হাজার ৩০০ আইনজীবী রয়েছে। এই ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার প্রায় ৮০ শতাংশ খরচ হয় আইনজীবীদের ফি দেওয়ার জন্য।
বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, 'এসব মামলা পরিচালনায় খরচ করা হচ্ছে জনগণের করের টাকা। একটি দেশের প্রশাসনে কী পরিমান অদক্ষ লোকজন থাকলে এই অপচয় হয়, সেটার প্রমাণ এই মামলাগুলো।'
এই বিভাগগুলোর মধ্যে সমন্বয় থাকলে এরকম হতো না বলে উল্লেখ করেন তিনি।
এসব বিরোধ নিষ্পত্তির উদ্যোগ কী
২০১৬ সালে মন্ত্রীপরিষদ বিভাগ সরকারি আন্তঃপ্রতিষ্ঠান বিরোধ আদালতের বাইরে নিষ্পত্তির লক্ষ্যে উদ্যোগ নেয়। ওই সময় কেবিনেট ডিভিশন থেকে প্রতিটি মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থার কাছে তাদের মধ্যে চলমান মামলার তথ্য চাওয়া হয়।
সরকারি কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল, সরকারের আন্তঃপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে কোনো বিরোধ দেখা দিলে যেন মামলা না করা হয়। মামলা না করে ওই বিরোধের ব্যাপারে আন্তঃমন্ত্রণালয় আইনগত বিরোধ নিষ্পত্তি-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিকে জানাতে বলা হয়।
কিন্তু মন্ত্রীপরিষদের একজন কর্মকর্তা জানান, এ সিদ্ধান্তের তেমন প্রতিফলন নেই।
এখন পর্যন্ত কয়েকটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ ছাড়া বেশিরভাগই মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কাছে কোনো তথ্য দেয়নি বলে জানান তিনি। ফলে এ নিয়ে কোনো সমাধানের পদ্ধতি গ্রহণ করা যাচ্ছে না।
মন্ত্রীপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, আদালতের বাইরে চলমান মামলা ও বিরোধ কীভাবে দ্রুত নিষ্পত্তি করা যায়, তা নিয়ে কাজ করছে কমিটিগুলো।
তিনি আরও বলেন, 'কিছু মামলার তালিকা পাওয়া গেছে। সবগুলো তালিকা পেতে সকল বিভাগকে আবার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। আশা করা যায় দ্রুত এই বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হবে।'
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, 'এসব মামলা সরকারের উন্নয়নমূলক কাজে বেশ বাধা সৃষ্টি করে। ইতোমধ্যে আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটির কয়েকটি সভা হয়েছে। আইন মন্ত্রণালয় থেকে প্রধান বিচারপতি ও নিম্ন আদালতকে অনুরোধ করা হয়েছে, সরকারের বিভিন্ন বিভাগ ও সংস্থার মধ্যে এসব মামলা যাতে করে দ্রুত নিষ্পত্তি করা হয়।'
বেকায়দায় অ্যাটর্নি জেনারেল
অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন বলেন, হাইকোর্টে সরকারের পক্ষে-বিপক্ষে প্রতিটি মামলা পরিচালনার জন্য তার অফিস কাজ করে।
'কিন্তু বেকয়াদায় পড়তে হয়, যখন নিজেদের বিভাগ ও সংস্থার মধ্যে মামলার উদ্ভব হয়। তখন বাধ্য হয়ে ওই মামলার শুনানি থেকে হয় নিজেকে বিরত রাখতে হয়, অথবা আদালতকে অনুরোধ করতে হয় তার সুবিবেচিত রায় বা আদেশ প্রদানের,' বলেন তিনি।
অ্যাটর্নি জেনারেল আরও বলেন, এসব বিরোধ ও মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য যে আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি হয়েছে, তাদের উচিত দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া। এগুলো নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে আদালতের বাইরেও নিষ্পত্তি সম্ভব।