কে এই ব্যক্তি যে পুতিনকে কানপড়া দেন?
সোমবার (১৪ মার্চ) রুশ টিভি চ্যানেল ওয়ানে সন্ধ্যার খবর প্রচারের সময় টেলিভিশন স্ক্রিনে ভেসে ওঠে এক সাংবাদকর্মীর প্রতিবাদের চিত্র। সম্পাদক মারিনা ওভস্যানিকোভা এ সময় সরাসরি সম্প্রচারিত সংবাদে, উপস্থাপকের পিছনে দাঁড়িয়ে 'যুদ্ধ নয়' প্ল্যাকার্ড উঁচিয়ে ধরেন।
এরপর ওই সাংবাদিককে স্ক্রিন থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় এবং তিনি কর্তৃপক্ষের জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়েন। এর পাশাপাশি জরিমানাও করা হয় তাকে; মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর অভিযোগে তার বিরুদ্ধে এখন তদন্ত চলছে।
রাশিয়া শুরু থেকেই ইউক্রেনে চলমান সংকটকে যুদ্ধ নয় বরং 'বিশেষ সামরিক অভিযান' বলে উল্লেখ করছে। প্রেসিডেন্ট পুতিন বলছেন, ইউক্রেনকে নাৎসিমুক্ত করতেই তার সামরিকবাহিনী দেশটিতে এই অভিযান পরিচালনা করছে।
পশ্চিমারা রাশিয়ার এই বক্তব্যকে গ্রহণ করেনি। রাশিয়ার মিডিয়া ইউক্রেন নিয়ে যেসব তথ্য পরিবেশন করছে তাকে বিভ্রান্তিমূলক প্রপাগান্ডা বলছে। এবং বিভ্রান্তিমূলক তথ্য ছড়ানোর অভিযোগ এনে তারা একজন ব্যক্তিকেও শনাক্ত করেছেন। পশ্চিমা ভাষ্যে এ কাজে পুতিনের প্রধান জেনারেল হলেন রুশ অলিগার্ক ইউরি কোভালচুক। মার্কিন সরকারের দাবী তাই। তারা জানাচ্ছে, ৭০ বছর বয়সী কোভালচুক পুতিনের 'একান্ত উপদেষ্টা' এবং 'ব্যক্তিগত ব্যাংকার', যার ওপর ২০১৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল।
ক্রেমলিন বিষয়ে খোঁজখবর করেন এরকম একজন মার্কিন পর্যবেক্ষকের মতে, গত কয়েক বছর যাবত পুতিন ও কোভালচুকের ঘনিষ্ঠতা এতোটাই বেড়েছে যে, তাদেরকে মোটামুটি 'অবিচ্ছেদ্যই' বলা চলে। কোভালচুকের ন্যাশনাল মিডিয়া গ্রুপে শেয়ার রয়েছে। চ্যানেল ওয়ান এবং রাশিয়ার বেশ কয়েকটি প্রভাবশালী টিভি চ্যানেলের মালিকানাও রয়েছে তার। এটিকেই মার্কিন অভিযোগের ভিত্তি ধরা হয়েছে। মিডিয়ায় এ মালিকানা থাকার সুবাদে আমেরিকান মত হল, রুশরা গণমাধ্যমে কী দেখছে এবং শুনছে তা নিয়ন্ত্রণ করছেন কোভালচুক। পাশাপাশি, গেল ডিসেম্বরে কোভালচুকের কোম্পানি রাশিয়ার সবচেয়ে বড় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ভিকে'র একটি অংশও কিনে নিয়েছে। ফলে আমেরিকা মনে করে, কোভালচুক তার মনের মতো তথ্য প্রচারের কাজে এই প্লাটফর্মটিও ব্যবহার করছেন।
কোভালচুক এবং পুতিন ঘনিষ্ঠ। পানামা পেপারস অনুসারে, এক্সক্লুসিভ ওজেরো দাচা কোঅপরেটিভে একই জায়গায় তাদের দুজনের বাড়ি রয়েছে; এবং বলা হয় ২০১৩ সালে কোভালচুক পুতিনের মেয়ের বিয়ের আয়োজনও করেছিলেন। পুতিনের 'ইনার সার্কেল' বা ঘনিষ্টজনদের ওপর লেখা বইয়ের লেখক রুশ সাংবাদিক মিখাইল জাইগারের মতে, গত দুই বছরে কোভালচুক তার কাজ দিয়ে পুতিনের পর রাশিয়ার 'সেকেন্ড ম্যান' হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। মনে করা হয়, রুশ প্রেসিডেন্টের কর্মীদের মধ্যে তিনিই এখন সবচেয়ে বেশি প্রভাবশালী।
রাশিয়ার অলিগার্কি বা শাসকগোষ্ঠী বিশ্লেষক অ্যান্ডার্স আস্লুন্ড বলেন, "মানুষ যখন রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের কথা বলে, তখন আসলে সেটা কোভালচুকের টেলিভিশনকেই বোঝায়।" তিনি মনে করেন, পুতিন মিডিয়ায় একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ রাখতেই কোভালচুককে ক্ষমতাবান করেছেন।
ফোর্বসের অনুমান, ১.৩ বিলিয়ন ডলার সম্পদের মালিক কোভালচুক। ২০০৮ সালে কোভালচুক আরেক প্রভাবশালী ব্যক্তি আলেক্সি মোর্দাশভকে সঙ্গে নিয়ে ন্যাশনাল মিডিয়া গ্রুপ তৈরি করেন। পশ্চিমা প্রচারণায় পুতিনের বান্ধবী হিসেবে উল্লেখ করা অ্যালিনা কাবায়েভা, এই কোম্পানির চেয়ারম্যান। চ্যানেল ওয়ান ছাড়াও ন্যাশনাল মিডিয়া গ্রুপ জনপ্রিয় রুশ টেলিভিশন চ্যানেল ফাইভটিভি, আরইএন-টিভি (পূর্বে পুতিন বিরোধী নেটওয়ার্ক ছিল) এবং বিনোদন চ্যানেল সিটিসি নিয়ন্ত্রণ করে; পাশাপাশি সংবাদপত্র, ডিজিটাল মিডিয়া এবং এ সংক্রান্ত স্টুডিগুলোতেও অংশীদারিত্ব রয়েছে ন্যাশনাল গ্রুপের।
মার্কিনীদের এসব অভিযোগের বিষয়ে ন্যাশনাল মিডিয়া গ্রুপ এবং কোভালচুক নিজে তাৎক্ষণিকভাবে সাড়া দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি।
২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের পর থেকে, রুশ টিভি নেটওয়ার্কগুলোতে পুতিনের পদক্ষেপের যৌক্তিকতাই তুলে ধরা হচ্ছে। পক্ষান্তরে, পশ্চিমা মিডিয়াও যুদ্ধে ইউক্রেনের পক্ষ নিয়ে সংবাদ প্রচার করছে। ফলে কোভালচুকের বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডা ছড়ানোর অভিযোগ আসছে তাদের পক্ষ থেকে।
মার্কিনীদের কোভালচুকের প্রপাগান্ডা ছড়ানোর উদাহরণ হিসেবে, মার্কিন সমর্থনে ইউক্রেন জৈব অস্ত্র তৈরির চেষ্টা করছে, এই সংবাদকে সামনে আনা হয়েছে। এই তথ্য মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রমূলক। কিন্তু এ্ই অভিযোগ রাশিয়া সরকার উত্থাপন করেছে আমেরিকার বিরুদ্ধে। এই অভিযোগের ভিত্তিতে জাতিসংঘে অধিবেশনও ডেকেছিল রাশিয়া। আমেরিকার বিরুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র তৈরিতে সহযোগিতার অভিযোগ রাশিয়ার সব সংবাদপত্রেও প্রকাশিত হয়। স্বভাবতই ইউক্রেন এবং বাইডেন প্রশাসন রাশিয়ার এই অভিযোগকে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব এবং সম্পূর্ণ মিথ্যা হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।
কোভালচুকের ন্যাশনাল মিডিয়া গ্রুপ ধনাঢ্য ব্যক্তি আলিশের উসমানভের কাছ থেকে রুশ সোশ্যাল মিডিয়া জায়ান্ট 'ভিকে'র অংশীদারিত্ব কেনার পর প্রতিষ্ঠানটির অনেক পদেই ঘটেছে রদবদল। অভিযোগ করা হয়, কোভালচুক নিজের অনেক আত্মীয়কে এখানে নিয়োগ দিয়েছেন। ব্যাপক রদবদলের এই খবর পরিবেশন করে রাশিয়ার স্বাধীন সংবাদমাধ্যম দ্য বেল। আর বিবিসি জানাচ্ছে, ইউক্রেন যুদ্ধে ভাড়াটে সৈন্য সংগ্রহের জন্য ভিকে ব্যবহার করছে ক্রেমলিন।
সাংবাদিকতা বিষয়ের অধ্যাপক ইয়াবলোকভ বলেন, "সাধারণ জপনগণের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ভিকে'র ব্যবহার করছে রুশ সরকার; ক্রেমলিনের অনুকূলে তথ্য প্রচার এবং বিকল্প মতামত ছড়ানোর জন্য যারা সামাজিক নেটওয়ার্ক ব্যবহার করছে তাদের চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে ভিকে ভূমিকা রাখছে।"
১৯৯০'র দশকে সেন্ট পিটার্সবার্গে ঘনিষ্ঠ হন কোভালচুক এবং পুতিন। এ সময় কোভালচুকের রসিয়া ব্যাংক পুতিনের রাজনৈতিক উত্থানের সমর্থনে কাজ করেছিল। এরপর থেকেই পুতিনের নেপথ্যে কাজ করে যাচ্ছেন কোভালচুক।
২০০০ সালে পুতিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর কোভালচুক গড়ে তোলেন তার মিডিয়া সাম্রাজ্য। এই সম্রাজ্য গড়তে নিজের রসিয়া ব্যাংককে ব্যবহার করেছেন তিনি। পুতিনও তাকে সাহায্য করেছেন। মার্কিন তথ্যানুসারে, সরকার বিরোধী মিডিয়াকে স্তব্ধ করতে চাইছিলেন পুতিন। মার্কিন তথ্যে আরও দাবি করা হয়েছে, রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেই প্রেসিডেন্ট পুতিন তৎকালীন অনেক প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও মিডিয়া ব্যক্তিত্বকে অবাঞ্চিত করেন, জেলে পুরেন; এমনকি তাদের অনেককেই এখন পর্যন্ত জনসম্মুখে আসতে দেখা যায় না। উদাহরণ হিসেবে ভ্লাদিমির গুসিনস্কির কথাই বলা যেতে পারে। জালিয়াতির অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার করেন পুতিন। অভিযোগ আছে আরিএন-টিভিসহ তার মিডিয়া সম্পদ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন গ্যাজপ্রমের কাছে বিক্রি করতে বাধ্য করা হয় তাকে।
মার্কিন তথ্যমতে, গুসিনস্কির মতো এমন পরিণতি অনেক রুশ ধনাঢ্যের ভাগ্যেই জুটেছে। যদিও আমেরিকা বাকিদের নাম প্রকাশ করতে পারেনি এখন পর্যন্ত।
ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রুশ আগ্রাসন চলমান অবস্থায় কোভালচুকের ওপর হঠাৎই নজর পড়েছে মার্কিন মিডিয়ার। তারা মনে করে কোভালচুক পুতিনকে কানপড়া দেওয়ার প্রধান ব্যক্তি।
- সূত্র: ফোর্বস