সিলেট কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল আধুনিকায়নের কাজে ধীরগতি, দুর্ভোগ চরমে
১১৭ কোটি টাকা ব্যয়ে সিলেট কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালের আধুনিকায়ন কাজ শুরু হয়েছিল ২০১৯ সালে। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে এই কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২০ সালে। তবে মেয়াদ শেষে আরও প্রায় দুই বছর পেরোতে চললেও এখন শেষ হয়নি কাজ।
নির্ধারিত সময়ে শেষ না হওয়ায় কাজের ব্যয় বেড়েছে। আর বাস টার্মিনালে আসা যাত্রী, চালক ও এই সড়কদের পথচারীদের প্রায় তিন বছর ধরে পোহাতে হচ্ছে চরম দুর্ভোগ।
বাস টার্মিনালের আধুনিকায়নের কাজ চলায় সেখানে কোনো বাস রাখা যাচ্ছে না। ফলে তিন বছর ধরে সড়কই হয়ে উঠেছে টার্মিনাল। বাস টার্মিনাল ও আশপাশের সড়কজুড়ে দিন-রাত দাঁড় করিয়ে রাখা হয় শ'য়ে শ'য়ে বাস।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনার কারণে দীর্ঘ সময় কাজ বন্ধ ছিল। ফলে নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ হয়নি। চলতি বছরের মধ্যে কাজ শেষ হবে বলেও জানান তারা।
মঙ্গলবার নগরের কদমতলী এলাকার বাস টার্মিনালে গিয়ে দেখা যায়, টার্মিনালে নির্মাণকাজ চলছে। ইতোমধ্যে মূল স্থাপনাগুলো নির্মিত হয়েছে। এখন সাজসজ্জ্বাসহ আনুষঙ্গিক কাজ চলছে।
এদিকে, টার্মিনালের পাশের বিশাল সড়কের পুরোটা জুড়েই দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে শত শত গাড়ি। গাড়ির কারণে এই সড়ক দিয়ে হেঁটে চলাচল করারও জো নেই। এ যেন সড়ক নয়, পুরোটাই বাস টার্মিনাল! সড়কজুড়ে এলোপাতাড়িভাবে গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাখার ফলে এই সড়ক দিয়ে কোনো যানবাহন চলাচল করতে পারে না। প্রায় তিনবছর ধরেই চলে আসছে এমন অবস্থা।
এই সড়কের পাশেই সিলেট রেলওয়ে স্টেশন। রেল স্টেশনের সামনেও দাঁড়িয়ে থাকে বাসের সারি। ফলে স্টেশনে যাত্রীদের যাওয়া-আসায়ও দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
সিলেট কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল থেকে প্রতিদিন দূরপাল্লার প্রায় পাঁচশ বাস ছেড়ে যায়। এরচেয়ে দ্বিগুণ সংখ্যক বাস চলাচল করে আন্তঃজেলা রুটে। টার্মিনালে আধুনিকায়নের কাজ চলায় এই বাসগুলো দাঁড় করিয়ে রাখা হয় সড়কের ওপর। বাস দাঁড় করিয়ে রাখায় এই সড়কে সবসময়ই লেগে থাকে দীর্ঘ যানজট। ফলে যাত্রীদের পোহাতে হয় চরম দুর্ভোগ।
সরেজমিনে দেখা যায়, কিনব্রিজ পার হয়ে দক্ষিণ সুরমার হুমায়ুন রশীদ চত্বর পর্যন্ত পুরো সড়ককেই মনে হয় বড়সড় বাস টার্মিনাল। কেবল সড়ক নয়, আশপাশের বিপণিবিতানগুলোর সামনে, রেলস্টেশনের খোলা অংশজুড়েও পার্কিং করে রাখা হয়েছে শত শত বাস। ফলে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত এই এলাকায় যানজট লেগেই থাকে। এতে প্রতিদিন স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি হাজারও মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হয় ।
এই টার্মিনাল থেকে ঢাকা-সিলেট, সিলেট-কুমিল্লা, সিলেট-চট্টগ্রাম, সিলেট-হবিগঞ্জসহ বিভিন্ন অঞ্চলের যানবাহন ছেড়ে যায়। এছাড়া সিলেট বিভাগের বিভিন্ন জেলার কোচ, মিনিবাস চলাচল করে এখান থেকে।
মঙ্গলবার জরুরী প্রয়োজনে হবিগঞ্জ যাওয়ার জন্য বাস টার্মিনাল এলাকায় এসেছিলেন নগরের শিবগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা শরিফুল ইসলাম। তিনি বলেন, টার্মিনাল এলাকার পুরো সড়কজুড়ে বাস দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। এতে এই সড়কে সবসময় যানজট লেগে থাকে।
তিনি বলেন, আমি জরুরী কাজে হবিগঞ্জ যাচ্ছিলাম। কিন্তু দুই ঘণ্টায় বাস টার্মিনাল এলাকা থেকেই বের হতে পারিনি।
সড়কে বাস দাঁড় করিয়ে রাখায় ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে জানিয়ে সিলেট থেকে ঢাকাগামী হানিফ বাসের চালক অরুণ দেব বলেন, টার্মিনাল থেকে বাস বের করতেই একঘণ্টার ওপরে লেগে যায়। এতে যথাসময়ে গন্তব্যে পৌঁছতে পারি না। এ নিয়ে যাত্রীদের সাথে প্রায়ই বচসা বাঁধে।
জানা যায়, বিশ্বব্যংকের অর্থায়নে সিলেট সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে সিলেট কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল আধুনিকায়নের কাজ শুরু হয় ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে। প্রায় সাড়ে ৭ একর জমির উপর এই টার্মিনাল নির্মাণ কাজে ব্যয় হচ্ছে ১১৭ কোটি টাকা। ২০২১ সালের মে মাসে এই কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিলো। তবে করোনার কারণে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় যথাসময়ে শেষ হয়নি কাজ।
সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক) সূত্রে জানা যায়, আগের বাস টার্মিনালে যাত্রীদের জন্য বসার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। ফলে যাত্রীদের পোহাতে হত দুর্ভোগ। এছাড়া টার্মিনালে যাত্রীদের জন্য ছিল না কোনো টয়লেটের ব্যবস্থা। পুরো বাস টার্মিনালে যততত্র ময়লা-আবর্জনা ফেলে রাখা হতো। এরকম অবস্থায় সিলেট কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল আধুনিকায়নের উদ্যোগ নেয় সিটি করপোরেশন।
সিসিক সূত্র জানিয়েছে, বাস টার্মিনাল আধুনিকায়ন প্রক্রিয়ায় ডাম্পিং গ্রাউন্ড নির্মাণ ও টার্মিনালের অবকাঠামোগত উন্নয়নের কাজ চলছে। পুরো বাস টার্মিনালের ময়লা-আবর্জনা যাবে ডাম্পিং গ্রাউন্ডে। সেখানে ময়লা-আবর্জনাকে পরিশোধন করা হবে। এছাড়া বাস টার্মিনালে আধুনিক ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। যেখানে যাত্রীদের জন্য বিশ্রাম কক্ষ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কক্ষ, টয়লেট, বিশুদ্ধ পানি প্রভৃতির ব্যবস্থা থাকবে। ডাম্পিং গ্রাউন্ডের জন্য ৫৬ কোটি টাকা এবং টার্মিনালের অবকাঠামোগত উন্নয়নে ৬১ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। তবে নির্মাণ সামগ্রীর দাম বাড়ায় এখন ব্যয় অনেকটা বেড়ে যাবে।
সিসিকের কর্মকর্তারা জানান, আধুনিক টার্মিনালে প্রত্যেক রুটের জন্য আলাদা পার্কিং জোন, প্রবেশ ও বের হওয়ার আলাদা রাস্তা থাকবে। টার্মিনালে থাকবে মেডিকেল সেন্টার। কেউ অসুস্থ হলে কিংবা দুর্ঘটনার শিকার প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকবে সেখানে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি সিলেটের সাধারণ সম্পাদক জিয়াউল কবির পলাশ বলেন, করোনার কারণে দীর্ঘদিন টার্মিনালের কাজ বন্ধ ছিল। একারণে যথাসময়ে কাজ শেষ হয়নি। টার্মিনালের আধুনিকায়ন চলায় সড়কেই গাড়ি রাখতে হয়।
তিনি বলেন, যথাসময়ে কাজ না হওয়ায় আমাদের অনেক লোকসান গুনতে হচ্ছে। দীর্ঘ যানজটের কারণে যথাসময়ে বাস ছেড়ে যেতে ও প্রবেশ করতে পারে না। এতে অনেক সময় নষ্ট হয়।
এ প্রসঙ্গে সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নুর আজিজুর রহমান বলেন, ২০২১ সালের মে মাসের মধ্যে টার্মিনালের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু করোনার কারণে যথাসময়ে কাজ শেষ করা যায়নি। এখন পুরোদমে কাজ চলছে। এই জুনের মধ্যে পুরো কাজ শেষ হবে বলে আশা করছি। তখন আর দুর্ভোগ থাকবে না।
তিনি বলেন, আধুনিকায়নের কাজ শেষ হলে এটি হবে দেশের অন্যতম আধুনিক বাস টার্মিনাল। এখানে আধুনিক ভবনে যাত্রীদের জন্য বিশ্রাম কক্ষ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কক্ষ, টয়লেট, বিশুদ্ধ পানি প্রভৃতির ব্যবস্থা থাকছে। এছাড়া প্রত্যেক রুটের জন্য আলাদা পার্কিং জোন, প্রবেশ ও বের হওয়ার আলাদা রাস্তা থাকবে। টার্মিনালে কেউ অসুস্থ হলে কিংবা দুর্ঘটনার শিকার কাউকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে আলাদা কক্ষ ও চিকিৎসক থাকবে।
নুর আজিজ বলেন, এখন নির্মাণ সামগ্রীর দাম অনেক বেড়ে গেছে। ফলে টার্মিনালের নির্মাণ ব্যয়ও বাড়বে। তবে কী পরিমাণ বাড়বে তা এখনই বলা যাবে না। কাজ শেষ হলে বলা যাবে। তাছাড়া বাড়তি টাকা বিশ্বব্যাংক দেবে না। সিটি করপোরেশনকেই তার ব্যবস্থা করতে হবে।