টিসিবির লাইনে মধ্যবিত্তের দীর্ঘশ্বাস
বেলা প্রায় ১১টা। ঢাকার মালিবাগ মোড়ে রাস্তার পাশে নিত্যপণ্যবোঝাই একটি ট্রাক দাঁড়ানো, তার পেছনে প্রায় ১০০ মানুষের লাইন। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ-এর (টিসিবি) ট্রাক থেকে ন্যায্যমূল্যে বাজার করতে অপেক্ষারত লাইনের মানুষেরা। ট্রাক আসার আগে প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে অপেক্ষা করছেন তারা। রমজানের আগে কিছুটা কম দামে দরকারি বাজার করার জন্যই এই প্রতীক্ষা।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে নিম্ন আয়ের মানুষের নাভিশ্বাস দশা। ভর্তুকি মূল্যে বিক্রি হওয়া ১১০ টাকা লিটার তেল, ৫৫ টাকা কেজি চিনি, ৬৫ টাকা কেজি মসুর ডাল, ২০ টাকা কেজি পেঁয়াজ, ৫০ টাকা কেজি ছোলা আর ৮০ টাকা কেজি খেজুর কিনতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছে এখানে। তবু নিম্নবিত্ত আর মধ্যবিত্তের কাছে এ-ই যেন এক বড় সুযোগ।
ঘন্টাখানেক লাইনে দাঁড়িয়ে ক্লান্ত হয়ে রাস্তার পাশে বসে পড়েছেন ষাটোর্ধ্ব আব্দুল হাই। তার এক ছেলে ছোটখাটো ব্যবসা করেন, আরেক ছেলে বছরখানেক ধরে সৌদি আরব থাকেন। দুই ছেলের আয়েও স্বস্তিতে দিন কাটানোর উপায় নেই তার মধ্যবিত্ত পরিবারে। তাই বাজার থেকে একটু কম দামে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসগুলোর খোঁজে এসেছেন টিসিবির লাইনে।
আব্দুল হাই বলেন, 'জিনিসপত্রের যে দাম, বাজার থেকে রেগুলার কিনতে সংসার খরচে টানাটানি হয়। বাজারে সয়াবিন তেলের লিটার ১৬০-১৭০ টাকা করে, টিসিবির ট্রাকে ১১০ টাকা লিটার তেল পাই। চিনি, মসুর ডাল, ছোলা, খেজুরও বাজার থেকে কম দামে দিচ্ছে।'
তবে দুই দিন যাবত টিসিবির ট্রাকের সামনের লাইনে ভিড় তুলনামূলক কম হচ্ছে বলে জানান লাইনে দাঁড়ানো আরেক ক্রেতা দুলাল। হোটেলে কাজ করেন তিনি।
'কয়েকদিন আগেও ট্রাকের সামনে অনেক লম্বা লাইন দেখেছি। কিন্তু রমজান উপলক্ষে এখন নতুন প্যাকেজ দেওয়া শুরু হয়েছে। এখানে তেল, চিনি, ডাল, পেঁয়াজের পাশাপাশি খেজুর আর ছোলাসহ ৭৪০ টাকার প্যাকেজ দিচ্ছে আজ। দুর্মূল্যের বাজারে নিম্নবিত্ত পরিবারে ছোলা আর খেজুর কেনা অনেকটা বিলাসিতার মতো। দুই কেজি ছোলা আর এক কেজি খেজুরের জন্য অতিরিক্ত ১৮০ টাকা ব্যয় করার সামর্থ্য অনেকেরই নেই। সেজন্যই বোধ হয় লাইনে ভিড় কম,' দুলালের ভাষ্য।
দুলালের পেছনে দাঁড়ানো আরেকজন ক্রেতা বলেন, 'গত কয়েক সপ্তাহের তুলনায় বাজারে দাম কিছুটা কমেছে এ সপ্তাহে। যেমন এখন বাজারে ২৫-৩০ টাকায় ভালো পেঁয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। অথচ এখানে ২০ টাকা কেজি যে পেঁয়াজ দিচ্ছে, সেগুলোর মধ্যে অনেকসময়ই নষ্ট পেঁয়াজ থাকে। মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ মূলত তেলটার জন্যই এখানে আসে বেশিরভাগ সময়।'
চৈত্রের দুপুরে লাইনে দাঁড়িয়ে গরমে হাঁসফাঁস করলেও জায়গা ছাড়ছিলেন না ফুটপাতের ব্যবসায়ী স্বপন মিয়া। তিনি বলেন, 'মাত্র জিনিসগুলা মাপামাপি করতেছে। মাপা শেষ কইরা দেওয়া শুরু করতে আরও কমপক্ষে দুই ঘণ্টা সময় লাগব। এই লাইনের মানুষদের দিতে দিতেই বিকাল হইব। তবুও কষ্ট কইরা আসছি যখন মাল না নিয়া যামু না আইজ।'
প্রতি প্যাকেজের জন্য ২ কেজি করে চিনি মেপে প্যাকেট করছিলেন টিসিবির কর্মী বশির। লাইনে দাঁড়ানো ক্রেতাদের শৃঙ্খলা বজায় রাখতে অনুরোধ করছিলেন বারবার। কিন্তু এর মাঝেই কয়েকজনের মধ্যে জায়গা রাখা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়ে যায়। বশির বলেন, '২৫০ জন মানুষের জন্য পণ্য নিয়ে এসেছি আমরা। ভিড় বেশি হলে মেপে শেষ করার দুই-তিন ঘণ্টার মধ্যেই শেষ হয়ে যায় বিক্রি। কিছুদিন আগেও ২৫০ জনের জায়গায় ৫০০ মানুষের লাইনও হয়ে যেত। শেষে অনেকেই ফিরতেন খালি হাতে।'
দুপুর গড়ানোর সাথে সাথে টিসিবির লাইন আরও বড় হতে থাকে। বিক্রি শুরু হয় সাড়ে ১২টার দিকে। নারীদের লাইনে শেষের দিকে দাঁড়ানো গৃহিণী ফাতেমা শংকা নিয়ে বলেন, 'আজকে লাইনে দাঁড়াতে দেরি হয়ে গেছে। তাই ভয়ে আছি জিনিস কিনতে পারব কি না। আমার স্বামী গার্মেন্টেসে কাজ করেন। তার স্বল্প আয়ে সংসার চালাতে খুব কষ্ট হয়ে যায়। মাসের শেষে এখন ধার করে চলতে হচ্ছে।'
টিসিবি থেকে ন্যায্যমূল্যে জিনিস কিনে অনেকেই আবার বিক্রি করেন মুদির দোকান বা বাজারে। পরিবারের কয়েকজনকে নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে পণ্য সংগ্রহ করেন তারা। এতে করে নিজেদের সংসারের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে এসে অনেকেই ব্যর্থ হন। এরকম যারা করেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান সাধারণ ক্রেতারা।
দু-ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে বিকাল সাড়ে পাঁচটার দিকে খালি হাতেই ফিরে যাচ্ছিলেন মধ্যবিত্ত গৃহিণী প্রভা রাণী। 'আমার সামনেই একই পরিবারের কয়েকজন লাইনে দাঁড়িয়ে তেল, চিনিসহ সব কিনে নিয়ে গিয়েছে। অনেকেই লাইনের বাইরে থেকেই প্রভাব খাটিয়ে জিনিস কিনেছে। অথচ এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও আমি কিছুই কিনতে পারলাম না।'
নিত্যপণ্যসহ সবকিছুর দাম বাড়ায় দেশের মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়ও বৃদ্ধি পেয়েছে অস্বাভাবিক হারে। কিন্তু তার সাথে তাল মিলিয়ে বাড়েনি সাধারণ নাগরিকের আয়। ফলে স্বাভাবিক জীবনধারণেই হিমশিম খাচ্ছে মানুষ। টিসিবির ন্যায্যমূল্যের পণ্যের ট্রাকের প্রতি তাই নিম্নবিত্তের সাথেসাথে মধ্যবিত্তের আগ্রহও বাড়ছে দিনদিন।
রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে প্রতিদিন ১৫০টি ট্রাকে করে নিত্যপণ্য বিক্রি করছে টিসিবি। রমজান উপলক্ষে এই বিক্রি কার্যক্রম চলবে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত।