স্বাস্থ্যখাতে গবেষণা যেভাবে বছরের পর বছর ধরে উপেক্ষিত
ধীরে-সুস্থ চলার নীতি শেষপর্যন্ত হয়তো অনেক দৌড়ে আমাদের এগিয়ে নিয়ে যায়, কিন্তু মহামারি মোকাবিলার ক্ষেত্রে তা সব সেরা কৌশল নয়।
মহামারি যখন হানা দেয় তখন বিশ্বজুড়ে গবেষকরা নতুন করোনাভাইরাসের বৈশিষ্ট্য জানতে উঠেপড়ে লেগেছিলেন, বাংলাদেশের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষও নিজস্ব গবেষণার উদ্যোগ নেয়।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় ২০২০-২১ অর্থবছরে শুধুমাত্র দেশের স্বাস্থ্য খাতে গবেষণার জন্য ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিল। এই বরাদ্দ ছিল বিস্ময়কর অঙ্কের, কারণ ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রথম যখন এ বরাদ্দের ঘোষণা দেওয়া হয়- তখন পরিমাণ ছিল মাত্র ৫ কোটি টাকা।
এত বিপুল বরাদ্দে দেশের গবেষকরা আশায় বুক বেঁধেছিলেন। ভেবেছিলেন, এবার হয়তো কোভিড-১৯ মোকাবিলার লড়াই জোরদার হলো!
দুর্ভাগ্যবশত, মন্ত্রণালয়ের প্রস্তুতির অভাব এবং আমলাতান্ত্রিক লাল ফিতার দৌরাত্মে- যা দেশের প্রায় সব খাতে এক ধ্রুব সত্য- শেষমেষ একটি টাকাও বরাদ্দ হয়নি।
২০২১-২২ অর্থবছরে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আবার গবেষণার জন্য ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে।
কিন্তু এই অর্থবছর শেষ হতে তিন মাস বাকি থাকলেও, মন্ত্রণালয় এখনও একটি গবেষণা প্রস্তাব অনুমোদন করতে, বাছাই প্রক্রিয়া চূড়ান্ত বা কোনো অর্থ বিতরণ করতে না পারায়- এবারও আগের ভুল থেকে কোনো শিক্ষা নেওয়া হয়নি বলে মনে হচ্ছে।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রথমবার কোনো অর্থ বিতরণ করতে ব্যর্থ হওয়ার অজুহাত ছিল গবেষণার অর্থ কীভাবে ব্যয় করা হবে- সে বিষয়ে কোনো নীতিমালা ছিল না। এরপর একটি খসড়া নীতিমালা তৈরি করতে অর্থ মন্ত্রণালয় পাঁচ মাস সময় নিয়েছে। নীতিমালা জারি করতে, আরও চার মাস সময় নেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এবং সবশেষে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গবেষণা নির্বাচক (বাছাই) ও জাতীয় কমিটি গঠন করে।
এসব কিছু হতে হতেই শেষ হয়ে যায় অর্থবছর, কিন্তু গবেষণা প্রস্তাব চায়নি মন্ত্রণালয়।
এই অর্থবছরেও অনুরূপ দৃশ্যের দেখা মিলতে পারে।
তহবিল অনুমোদনের জন্য অনেকে যারা গবেষণা প্রস্তাব জমা দিয়েছেন, তাদের মধ্যে একজন হচ্ছেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. জাহিদুর রহমান।
তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "করোনাভাইরাস ও কোভিড ভ্যাকসিন যেহেতু একটি নতুন বিষয়, তাই চিকিৎসা গবেষণায় এটি অনেক গুরুত্ব পায়। প্রাদুর্ভাবের সময় চারদিকে অনেক ডেটা ছিল, কিন্তু অর্থের অভাবে আমরা গবেষণা করতে পারিনি। কারণ সরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষকদের গবেষণার জন্য এক টাকাও বরাদ্দ নেই। কিন্তু গবেষণায় যখন ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়, তখন আমরা আশাবাদী হই।"
"গবেষণার প্রস্তাব চেয়ে দেওয়া সার্কুলারে বলা হয়, স্বল্প সময়ের মধ্যে যাচাই-বাছাই শেষ করে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হবে। কিন্তু প্রস্তাব জমা দেয়ার এতদিন পরও কর্তৃপক্ষের কোনো সাড়া মেলেনি। ফলে আমরা বুঝতে পারছি না, আদৌ গবেষণাটি করা যাবে কিনা"- যোগ করেন তিনি।
হেলায় হারানো সুযোগ
সমন্বিত স্বাস্থ্য বিজ্ঞান গবেষণা ও উন্নয়ন তহবিল কার্যক্রম পরিচালনা সম্পর্কিত নীতিমালা ২০২১ (সংশোধিত) এর আওতায় গত বছরের ২২ জুন প্রজ্ঞাপন জারি করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ডেডলাইন নির্ধারণ করা হয় ২০২১ সালের ১ জুলাই। সে অনুযায়ী ৬০০টির বেশি গবেষণা প্রস্তাব জমা পড়েছে।
নীতিমালা অনুযায়ী, গবেষণার জন্য প্রাপ্ত আবেদন ৩০ দিনের মধ্যে বাছাই (কারিগরি) কমিটির নিকট পাঠাতে হবে। তারা যাচাই-বাছাই শেষে বাছাইকৃত গবেষণা প্রস্তাব এর তালিকা ১৫ দিনের মধ্যে অ্যাওয়ার্ড (জাতীয়) কমিটিতে অনুমোদনের জন্য পেশ করবে।
অ্যাওয়ার্ড কমিটি বাছাই কমিটির সুপারিশকৃত গবেষণা প্রস্তাবের পর্যালোচনা করে যোগ্য প্রটোকলের ওপর ৩০ দিনের মধ্যে চূড়ান্ত মতামত দেবে এবং এর ৭ দিনের মধ্যে নির্বাচিতদের জানিয়ে দেবে।
পুরো প্রক্রিয়াটি আড়াই মাসের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও, নয় মাস পেরিয়ে গেলেও এখনও তা করাই হয়নি।
ডা.জাহিদুর রহমান আরও বলেন, "আগে গবেষণার সুযোগ ছিল না। কিন্তু এখন বরাদ্দ আছে। আমরা চাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এটি বিতরণ করা হোক, যাতে আমাদের মতো গবেষকরা কাজ শুরু করতে পারেন।"
গবেষকদের আশঙ্কা, বিলম্বের কারণে আগের গবেষণা প্রস্তাবগুলি পুরানো হয়ে গেছে এবং মহামারি-প্রস্তুতি এবং সম্ভাব্য টিকাগুলির জন্য তথ্য সংগ্রহের সুযোগ এখন হারিয়ে গেছে।
কারো কারো আশঙ্কা, তহবিল বিতরণে বিলম্বের ফলে গবেষণা পরিচালনা ও ফলাফল জমা দেওয়ার সময়ও কম পাওয়া যাবে, যাতে উৎসাহিত হবে অনুকরণ প্রবণতা বা 'কপি-পেস্ট গবেষণা'।
নীতিমালা অনুযায়ী, দুই বছরের মধ্যে গবেষণা শেষ করতে হবে এবং তিন কিস্তিতে অনুদান দেওয়া হবে।
ইউনিভার্সিটি মেডিকেল কলেজের গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান ও অ্যাওয়ার্ড (জাতীয়) কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. রিজওয়ানুর রহমান টিবিএসকে বলেন, "৬০০টিরও বেশি প্রস্তাব জমা পড়েছে। সেগুলো যাচাই-বাছাই করা হয়েছে এবং শিগগিরই তহবিল বরাদ্দ করা হবে।"
সূত্রগুলি জানায়, ৬০টি প্রস্তাব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং ৫০টির বেশি প্রস্তাব আইসিডিডিআরবি-এর। বেশিরভাগ গবেষক ৪০ লাখ থেকে ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েছেন।
সময়ের বিরুদ্ধে দৌড়
দ্রুত সময় ফুরিয়ে আসলেও, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এখনও আগামী তিন মাসের মধ্যে তহবিল বিতরণের বিষয়ে আশাবাদী। তবে কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, তা বাস্তবায়নে অনেক কিছুর করার রয়েছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ডা. মো. শরফুদ্দিন আহমেদ বলেন, "চলতি অর্থবছর ৩০ জুন শেষ হবে, তাই বাছাই প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে। এজন্য প্রয়োজনে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে।"
স্বাস্থ্য খাতে গবেষণা তহবিল সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির একটি সূত্র টিবিএসকে জানিয়েছে, "৬০০টিরও বেশি প্রস্তাব জমা দেওয়া হয়েছিল এবং তাদের বেশিরভাগই ছিল খুব ভাল। প্রস্তাবগুলো যাচাই করতে সময় লেগেছে। বাছাই কমিটির অধিকাংশ সদস্যই চিকিৎসক। তাদের পেশাদার কাজের পাশাপাশি এই যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়াটি করতে হয়, এজন্য সময় লেগেছে।"
তিনি আরো জানান, "মন্ত্রণালয়ে বসার সমস্যা, কম্পিউটার এবং সহায়ক জনবলের অভাবসহ অনেক সমস্যা রয়েছে, যেগুলোও বিলম্বের কারণ।"
মো. আহসান কবির যুগ্মসচিব (চিকিৎসা শিক্ষা) এবং সমন্বিত স্বাস্থ্য বিজ্ঞান গবেষণা ও উন্নয়ন তহবিল ব্যবস্থাপনার জাতীয় বাচাই কমিটির সদস্য সচিব বলেন, যাচাই-বাছাই শেষ হয়েছে শিগগিরই অ্যাওয়ার্ড (বরাদ্দ) দেওয়া হবে। এ মাসে জাতীয় কমিটির সভা আছে, সেদিন অ্যাওয়ার্ড দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। আমরা আশা করছি, চলতি অর্থবছরের মধ্যে গবেষণার অর্থবরাদ্দ দেওয়া যাবে। এবছর আর অর্থ ফেরত যাবে না।"
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী বলেন, "গত বছর গবেষণার বরাদ্দের ১০০ কোটি টাকা কীভাবে ব্যয় হবে তার সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকায় ব্যয় করা যায়নি। তবে এ বছর একটি নীতিমালা রয়েছে। সুতরাং, কর্তৃপক্ষ যদি অর্থ ব্যয় করতে না পারে, তাহলে এটি একটি ব্যর্থতাই হবে।"