নদী নাব্যতা হারানোয় ডুবছে হাওরের ফসল
কেবল বাঁধ নির্মাণে গাফিলতি আর অনিয়মের কারণে নয়, নদী নাব্যতা হারানোর কারণেও ডুবছে হাওর অঞ্চলের ফসল। ফলে ফসল রক্ষায় যথাসময়ে টেকসই বাঁধ নির্মাণের পাশপাশি প্রয়োজন হাওর এলাকার নদীগুলো খনন। এমন মত হাওরের কৃষক, প্রশাসনের কর্মকর্তা আর বিশেষজ্ঞদের। তাদের দাবি, বাঁধের কাজে অনিয়ম ও গাফিলতি কমলে ফসল কিছুটা রক্ষা পাবে। তবে ঢল বেশি হলে কেবল বাঁধ নিয়ে এখন আর ফসল রক্ষা করা যাবে না। এজন্য প্রয়োজন নদীর নাব্যতা ফেরানো।
দেশের সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সিলেট, মৌলভীবাজার ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ১৪ হাজার ৫৩৬ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে হাওর অঞ্চল বিস্তৃত। এখানে ৪১৪টি হাওর আছে। এসব হাওর এলাকা দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে মেঘনা, সুরমা, কুশিয়ারা, যাদুকাটা, পিয়াইন, বউলাই, কাতলাই, সোমেশ্বরী, খোয়াইসহ অন্তত ১৪টি নদী। তলদেশ ভরাট হয়ে এই সবগুলো নদীই নাব্যতা হারিয়েছে। ফলে অল্প বৃষ্টি বা ঢলেই নদী উপচে আশপাশের এলাকায় পানি ছড়িয়ে পড়ে।
তাই হাওরের ফসল রক্ষায় ব্যাপক আকারে নদী খনন প্রয়োজন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। গত ৮ এপ্রিল সুনামগঞ্জে হাওরের ফসলহানি দেখতে গিয়ে প্রাণিসম্পদ উপমন্ত্রীও বলেছেন ফসল রক্ষায় নদী খননের প্রয়োজনীয়তার কথা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এবার হাওরের ৭টি জেলায় মোট ৯ লাখ ৫০ হাজার ৪০৬ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। এরমধ্যে গত কয়েকদিনের বৃষ্টি ও ঢলে তলিয়ে গেছে অন্তত ১০ হাজার হেক্টর জমির ফসল। দেশের সবচেয়ে বেশি হাওর রয়েছে সুনামগঞ্জে। কেবল এই জেলায়ই এ পর্যন্ত ৫ হাজার হেক্টরের উপরে ফসল তলিয়েছে।
হাওরের ফসল রক্ষায় প্রতিবছরই নির্মাণ করা হয় বাঁধ। প্রতিবছরই এতে গাফিলতি ও অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়। এবার দুই দফা মেয়াদ বাড়িয়েও শেষ হয়নি বাঁধের কাজ।
বাঁধের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে। এসময়ে মাত্র ৬২ শতাংশ কাজ শুরু হয়েছে জানিয়ে হাওর ও পরিবেশ উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি কাসমির রেজা বলেন, এই পিআইসি গঠনেই দেরি হয়েছে। ফলে কাজও হয়েছে দেরিতে। এতে যথাসময়ে কাজ শুরু হয়নি। কাজও যথাযথ হয়নি।
পিআইসি গঠনে দেরি হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, স্থানীয় উপকারভোগীদের দিয়ে পিআইসি গঠনের কথা থাকলেও আদতে স্থানীয় সাংসদরাই নিজেদের লোকদের নিয়ে কমিটি গঠন করে দেন। সাংসদদের সাথে সমন্বয় ও নিজেদের লোক বাছাইয়েই দেরি হয়।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, এ বছর সুনামগঞ্জে ১২৪টি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) মাধ্যমে ৫৩২ দশমিক ৩৯ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১২৪ কোটি টাকা।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের সুনামগঞ্জ কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শামসুদ্দোহা বলেন, এবার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের কারণে পিআইসি গঠনে কিছুটা দেরি হয়েছে। কারণ স্থানীয় লোকজন ও প্রশাসন নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত ছিলো।
প্রয়োজন নদী খনন
হাওরে বাঁধের কাজ শুরু হওয়ার কথা ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে। কিন্তু সুনামগঞ্জের অনেক হাওরের পানিই ডিসেম্বরে নামেনি। গত কয়েকবছর ধরেই এমনটি হচ্ছে। পানি না নামায় যথাসময়ে বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু করা যায়নি বলে জানিয়েছেন পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শামসুদ্দোহা।
যথাসময়ে পানি না নামার কারণ সম্পর্কে হাওর ও পরিবেশ উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি কাসমির রেজা বলেন, ঢলে পানির সাথে বালিও আসে। এই বালি জমে নদীর নাব্যতা কমে গেছে। ফলে নদী হাওরের পানি টানতে পারছে না। এতে শুষ্ক মৌসুমেও হাওরে পানি জমে থাকছে।
হাওরে এটি নতুন সঙ্কট জানিয়ে কাসমির বলেন, গত ৭/৮ বছর ধরে এমনটি হচ্ছে। দিনদিন এই সমস্যা তীব্র হচ্ছে। শুষ্ক হাওরের পানি নামছে না।
একদিকে শুষ্ক মৌসুমেও হাওরে পানি আটকে থাকছে অপরদিকে, মার্চের দিকে এক দুদিনের ঢলেই বাঁধ উপচে হাওরে পানি প্রবেশ করছে বলে জানান তাহিরপুরের উপজেলা চেয়ারম্যান করুনাসিন্ধু পাল।
তিনি বলেন, বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম তো আছেই। বাঁধ ভাঙছেও কিন্তু অনেক জায়গায় বাঁধ উপচে পানি হাওরে প্রবেশ করছে। এক-দু'দিনের ঢলে আগে এমনটি হতোনা। এখন অল্প বৃষ্টি বা ঢলেও নদী ভরাট হয়ে বাঁধ উপচে হাওরে পানি প্রবেশ করে।
নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় এমনটি হচ্ছে জানিয়ে পুরো হাওর এলাকার নদীগুলো একসাথে খননের দাবি করুনাসিন্ধু পাল ও কাসমির রেজার।
কাসমির রেজা বলেন, এখন আর কেবল বাঁধ দিয়ে ফসল রক্ষা সম্ভব নয়। উজান থেকে ভাটি পর্যন্ত নদী খনন করতে হবে। ভৈরবে মেঘনা নদীতে বড় বড় চর পড়েছে। সেগুলোও খনন করতে হবে। কারণে সুনামগঞ্জ থেকে সুরমার পানি মেঘনায় গিয়ে মিশে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সুনামগঞ্জের উপ-পরিচালক বিমল চন্দ্র সোমও মনে করেন, নদী খনন করা না হলে হাওরের ফসল বাঁচানো সম্ভব নয়।
তিনি বলেন, নদী দ্রুত খনন করা প্রয়োজন। একটু করলে হবে না, পুরো নদী একসাথে খনন করতে হবে।
বাঁধ একটি সাময়িক ব্যবস্থা উল্লেখ করে হাওর গবেষক ড. হালিমদাদ খান বলেন, বাঁধ দিয়ে ফসল পুরোপুরি রক্ষা সম্ভব নয়। আগে এই ঢলের পানি নদী দিয়ে মেঘনা হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশে যেতো। এখন নদী ভরাট হয়ে গেছে। ফলে পানি নদী উপচে হাওরে ঢুকে পড়ে। প্রতিবছরই হাওরে পানি ঢুকে। যে বছর ঢল বেশি নামে, সেবছর বেশি ঢুকে। কেবল বাঁধ দিয়ে এই পানি আটকানো যাবে না।
নদীগুলোর নাব্যতা রক্ষা করা ও নদী খনন প্রয়োজন উল্লেখ করে তিনি বলেন, অনেক হাওরে বিলের তলদেশ পর্যন্ত ধান রোপন করা হয়। ফলে ঢল হলেই বা অল্প বৃষ্টিতেই এগুলো তলিয়ে যায়। একটি নির্দিষ্ট এলাকায় ধান চাষ করতে হবে।
তিনি বলেন, আমাদের নিজেদের যে জাত ছিলো এগুলো বৃষ্টি শুরুর আগেই তোলা যেতো। কিন্তু এতে ফলন কম হয়। এখন হাইব্রিড জাতের ধানে ফলন বেশি হয়, তবে সময় বেশি লাগে। তাই কৃষি বিজ্ঞানীদের হাওরের উপযোগী নতুন জাত উদ্ভাবন করতে হবে।
ফসল রক্ষায় নদী খননের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেট বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী এস এম শহিদুল ইসলাম বলেন, সুরমাসহ এই এলাকার বেশিরভাগ নদীই নাব্যতা হারিয়েছে। এগুলো খনন করা প্রয়োজন। নদী খননের জন্য গত বছরে আমরা ১৪০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। সম্ভাব্যতা যাচাই শেষে এটি এখন মন্ত্রণালয়ের বিবেচনাধীন আছে।
তিনি বলেন, নদী খননের পাশাপাশি কিভাবে আরও টেকসই বাঁধ নির্মাণ করা যায়, সে ব্যাপারে ভাবতে হবে। বাঁধকে উন্নত করতে হবে।
এদিকে সুনামগঞ্জের হাওরের পরিস্থিতি পরিদর্শনে এসে গত ৮ এপ্রিল পানি সম্পদ উপমন্ত্রী একেএম এনামুল হক শামীম বলেন, হাওরের নদীগুলো খননে উদ্যোগ নেওয়া হবে এবং বিশেষজ্ঞদের সাথে পরামর্শ করে বাঁধের স্থায়ী সমাধান খুঁজে বের করা হবে।