আম্বানি-বেজোস লড়াই এবার ভারতের ক্রিকেটের মাঠে
ভারতে দেওয়ালিয়া হওয়া একটি খুচরা পণ্য বিক্রেতা কোম্পানি- ফিউচার গ্রুপ কেনা নিয়ে বিশ্বের অন্যতম সেরা দুই ধনী—মুকেশ আম্বানি ও জেফ বেজোসের লড়াই চলছে। ব্যবসায়িক সে দ্বন্দ্বের সমাধান হতে না হতেই- এবার ক্রিকেট পিচের দখল নিয়ে দ্বিতীয় রাউন্ড লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা দুজন।
ভারতে সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ক্রিকেট। এর রয়েছে সর্বভারতীয় আবেদন- যাতে সাড়া দেন সপরিবারে কোটি কোটি জনতা। উভয় ধনী-ই চান ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লীগ (আইপিএল) সম্প্রচারের (ব্রডকাস্ট ও স্ট্রিমিং) স্বত্বাধিকার।
আম্বানি তার মূল প্রতিষ্ঠান- রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের মাধ্যমে দর হাঁকবেন। অপর বড় দরদাতা হচ্ছে, জেফ বেজোসের অ্যামাজন ডটকম ইনকর্পোরেশন।
সম্প্রচারের এই স্বত্ব মর্যাদারও লড়াই। জেফ বেজোস বিশ্বের দ্বিতীয় সেরা ধনী। আর ৯ নম্বর বিত্তশালী মুকেশ নিজ হোমগ্রাউন্ডে বিনা-যুদ্ধে ছাড় দেওয়ার পাত্র নন। ফিউচার গ্রুপের ঘটনায় তিনি তা প্রমাণ করেছেন।
ভারতে বেজোস-আম্বানি দ্বৈরথের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র- দেশটির খুচরা পণ্য বিকিকিনির ব্যবসা। ভারতে এ ব্যবসা সিংহভাগ অনানুষ্ঠানিক খাতের দখলে, যা নিয়ে এখন আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতা করছেন তারা।
এ বাস্তবতায়, ভারতের ১৪০ কোটি জনতা যে খেলার আবেগী দর্শক, তার চেয়ে ভালো ব্যবসা তাদের জন্য আর কীইবা হতে পারে?
উন্মাদনার জন্ম দেওয়া আইপিএল ভারতে বেশ বড় এক ব্যবসা। গেল বছরের আইপিএল সম্প্রচার মোট প্রায় ২৪ হাজার কোটি মিনিট সময় ধরে দেখা হয়েছে।
এর আগে, ২০১৭ সালে মিডিয়া মোগল রুপার্ট মারডকের স্টার স্পোর্টস ২৫৫ কোটি ডলারে পাঁচ বছরের জন্য টেলিভিশন ও ডিজিটাল মাধ্যমে আইপিএল সম্প্রচার স্বত্ব কিনে নেয়। এসময় মারডককে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে ম্যাচ লাইভস্ট্রিম স্বত্ব পেতে ৬০ কোটি ডলার দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল ফেসবুক।
সামাজিক মাধ্যম যে ধীরে ধীরে প্রচলিত মিডিয়ার ব্যবসাকে দখল শুরু করছে- এ ঘটনায় সে হাওয়া বদল টের পান- অস্ট্রেলীয় বিলিয়নিয়ার। তাই আরও মুনাফা করে নিজের বিখ্যাত প্রোডাকশন স্টুডিও- টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি ফক্স ইনকর্পোরেশন বিক্রি করে দেন ওয়াল্ট ডিজনি অ্যান্ড কোম্পানির কাছে। ফক্সের আওতাধীন থাকায় স্টার স্পোর্টসের বর্তমান মালিকানা প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ডিজনি।
সম্প্রতি ম্যাচের ফাঁকে ফাঁকে প্রতি ১০ সেকেন্ডের একেকটি বিজ্ঞাপনী স্পট ২২ হাজার ডলারে বিক্রি করেছে স্টার স্পোর্টস। লাইভ ম্যাচ স্ট্রিম করা ডিজনি প্লাস হটস্টার অ্যাপের বিজ্ঞাপনী আয় যদি তার সাথে ধরা হয়—তাতেও স্পষ্ট হয় কত লাভজনক এ ব্যবসা।
সম্ভাবনা অপার হওয়ায় এবার দর হাঁকাহাঁকি অন্তত ৫০০ কোটি ডলারের হওয়ার আশা রয়েছে। এই ক্রিকেট লীগ উদীয়মান বাজারের ভোক্তাশক্তির আরেকটি জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ। আইপিএল সম্প্রচার করতে পারলে, ভারতের বাজারে নেটফ্লিক্স ও ডিজনিকে পেছনে ফেলে স্ট্রিমিং ব্যবসায় এগিয়ে যাবে অ্যামাজন।
এসব গুরুত্ব মুকেশ আম্বানি সমানভাবে উপলদ্ধি করেন। বিনোদন কন্টেন্ট, বাণিজ্য ও বাহক—এ তিন শক্তির ভিত্তি করে তিনি নিজের ভোক্তাসেবা ব্যবসাকে গড়ে তুলতে চান।
তাছাড়া, আম্বানির রিলায়েন্স জিও প্রায় ৪০ কোটি গ্রাহকসহ ভারতের সবচেয়ে বড় টেলিকম। জিও'র সেবা ব্যবহারকারীরা তাদের ইন্টারনেট ডেটার এক বড় অংশ ব্যয় করছেন ক্রিকেট ম্যাচ দেখতে। আম্বানি ম্যাচ সম্প্রচার স্বত্ব পেলে নিজ গ্রাহকের ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসাকে পুঁজি করে ডেটা প্লান বেশি বিক্রি করবেন। প্রতিযোগীদের সার্ভিস থেকে তার গ্রাহকদের দৃষ্টি দূরে থাকায়, তিনি একইসাথে তাদের কাছে আরও বেশি খুচরা পণ্য বিক্রির বিজ্ঞাপন করতে পারবেন।
বর্তমানে ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগ লাইভস্ট্রিমের স্বত্বাধিকারী অ্যামাজন আম্বানির তেমন এক প্রতিপক্ষ। তবে অন্য প্রতিযোগীরাও আছে।
সম্প্রতি ভারতের সবচেয়ে বড় পুঁজিবাজার মূল্যায়িত টিভি নেটওয়ার্ক কোম্পানি- জি এন্টারটেইনমেন্ট নেটওয়ার্ক লিমিটেডের সিংহভাগ মালিকানা লাভে ব্যর্থ হয় রিলায়েন্স। জি এখন জোট বাঁধছে জাপানের সনি গ্রুপ কর্পোরেশনের সাথে। এ বাস্তবতায়, আম্বানি যদি ভারতের সুপারবলখ্যাত আইপিএল সম্প্রচার স্বত্ব লাভ করেন, তাহলে সনি-জি অংশীদারিত্বকে একহাত দেখিয়ে দিতে পারবেন।
এনিয়ে মুকেশ রুপার্ট মারডকের ছেলে জেমস ও তার বিশ্বস্ত সহকারী স্টার টিভি ইন্ডিয়ার সাবেক প্রধান উদয় শঙ্করের সাথে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন। আলোচনা সফল হলে, রিলায়েন্স তাদের স্থানীয় টেলিভিশন কন্টেন্ট প্রচারের প্ল্যাটফর্ম ভায়াকম-১৮ এর ৩৯ শতাংশ মালিকানা দেবে মারডকদের। এভাবে জোটবদ্ধ হবে মারডক ও রিলায়েন্স সাম্রাজ্য।
হাত গুটিয়ে বসে নেই সনিও। আসলে, সাবেক ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মুকুটখ্যাত ভারতের বাজার দখলে শুধু আমেরিকানরাই অগ্রণী নয়; তাদের পেছনে ফেলতে তৎপর রয়েছে জাপানিরাও।
সব মিলিয়ে বলা যায়, ক্রিকেটে আম্বানির আগ্রহ শুধু গণমাধ্যম প্রচার অধিকারে সীমাবদ্ধ নয়। আইপিএলে রয়েছে, তার মালিকানাধীন টিম- মুম্বাই ইন্ডিয়ানস। ২০০৮ সালে এই লীগটি শুরুর পর পাঁচটি শিরোপা ঘরে তুলে সবচেয়ে সফল আইপিএল টিমের খ্যাতি অর্জন করেছে তারা। প্রচারস্বত্ব পেলে আম্বানি ধরাবাঁধা বাজেটের পরোয়া না করেই, সব সেরা খেলোয়াড়কে একত্র করতে পারবেন।
তাছাড়া, ক্রীড়া ব্যবসা হয়তো আম্বানির কাছে ব্যক্তিগত কারণেও গুরুত্বপূর্ণ। ৬৫ বছরের এ ভারতীয় ব্যবসায়ী এরমধ্যেই নিজ ব্যবসায়ীক সাম্রাজ্য তার সন্তানদের হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। নতুন প্রজন্ম আইপিএল টিম ব্যবস্থাপনায় কতোটা সফল হয়- সেদিকে তার নজর থাকবে। আরও আছে সম্মানের বিষয়। মুম্বাই ইন্ডিয়ানসের মালিকানা আম্বানিকে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ক্রীড়া স্পন্সরের অনন্য মর্যাদা দিয়েছে।
শেয়ারমূল্যের ওপর ভিত্তি করে কখনো এ শিরোপা থাকছে আম্বানির দখলে, কখনোবা পাচ্ছেন পেশাদার বাস্কেটবল টিম- লস অ্যাঞ্জেলস ক্লিপার্সের মালিক ও মাইক্রোসফট কর্পোরেশনের সাবেক সিইও স্টিভ বলমার। মজার বিষয় হলো, স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস স্কুলে তারা দুজন ছিলেন সহপাঠী।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আম্বানি, বেজোস বা ডিজনি—আইপিএল কেনার দৌড়ে এগিয়ে—এ তিন মহারথী। তবে ম্যাচ ফরম্যাট দর্শকদের ক্লান্ত করলে, তা ব্যবসায়ীক ঝুঁকি হবে দেশি বা বিদেশি দরদাতা সকলের জন্যেই। যদিও, আম্বানি বা বেজোস শুধু বিজ্ঞাপনী আয় পকেটভর্তি করতে এ লড়াইয়ে নামছেন না। তাদের প্রধান লক্ষ্য, অনলাইন মার্কেটপ্লেস। এ বাজারে দখলের মহার্ঘ্য সুযোগ করে দিতে পারে আইপিএল। এই এক জয় যার বাহুবন্দী হবে, বহু বছর তার হাতেই থাকতে ভারতে ই-কমার্সের ব্যবসার বড় অংশ। সে বিবেচনা থেকে বেজোস ও আম্বানি এবার কোমড় বেঁধে প্রতিযোগিতায় নামতে চলেছেন, ফাইনাল ম্যাচের মতোই যা আরও রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনার হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
- লেখক: ব্লুমবার্গের মতামত কলাম লেখক অ্যান্ডি মুখার্জি শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং আর্থিক সেবাখাত নিয়ে বিশ্লেষণ করেন। ইতোপূর্বে, তিনি বার্তা সংস্থা রয়টার্সের ব্রেকিংভিউজেও কলাম লিখতেন।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ হতে অনূদিত