বিশ্বজিৎ থেকে নাহিদ: যে রক্তাক্ত আখ্যানের শেষ নেই
রাস্তায় পড়ে আছেন একজন নিথর মানুষ। একটা লম্বা ছুরি দিয়ে নাহিদ হাসান নামের মানুষটিকে কোপাচ্ছেন হেলমেটধারী এক তরুণ। রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় ঢাকা কলেজের ছাত্র ও ব্যবসায়ীদের মধ্যকার সংঘর্ষকালের দৃশ্য এটি। একই সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছেন নিউমার্কেটের একটি দোকানের কর্মচারী মোহাম্মদ মুরসালিন। নাহিদ ছিলেন কুরিয়ারকর্মী।
নাহিদ ও মুরসালিন দুজনকেই হত্যা করা হয়েছে প্রকাশ্য দিবালোকে, শত শত মানুষের উপস্থিতিতে। কিন্তু কেউ বলতে পারছিল না কে, কেন এই দুজন মানুষকে হত্যা করল। অতিসম্প্রতি আইনপ্রয়োগকারী বাহিনী হত্যাকারীদের শনাক্ত করেছে।
পুলিশ জানিয়েছে, হত্যাকারীদের প্রত্যেকেই ঢাকা কলেজের ছাত্র এবং ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তবে এখনও পর্যন্ত তাদের কেউ গ্রেপ্তার হয়নি।
ডিলিঙ্ক কুরিয়ার সার্ভিসের ডেলিভারিকর্মী নাহিদ মারা যান ১৯ এপ্রিল।
অনলাইনে ভাইরাল হওয়া এক ভিডিওতে দেখা যায়, অচেতন নাহিদকে নৃশংসভাবে কোপাচ্ছে হেলমেট পরা এক ব্যক্তি। আর তাকে টেনে সরিয়ে নিচ্ছে আরেক হেলমেটধারী।
আর সংঘর্ষে গুরুতর আহত মুরসালিন ২১ এপ্রিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান।
ক্ষমতার লোভে মনুষ্যত্ব বিসর্জন দেওয়া মানুষের হাতে নিয়মিতই প্রাণ দিয়ে আসছে সাধারণ মানুষ। সেই অকালে প্রাণ দেওয়া মানুষদের তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন নাহিদ ও মুরসালিন।
এর আগে আমরা এভাবে ক্ষমতার দ্বন্দ্বের বলি হতে দেখেছি বিশ্বজিৎকে, ২০১২ সালে। পেশায় দর্জি বিশ্বজিৎ সেদিন পুরান ঢাকার রাস্তায় একা দাঁড়িয়ে ছিল। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কর্মীরা তাকে জামাত-শিবিরের কর্মী ভেবে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করে।
এতগুলো বছর পেরিয়ে যাবার পরও সেই হত্যাকাণ্ডের ছবি আমাদের মানসপটে ভেসে ওঠে। রোগাটে তরুণ বাঁচার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। রক্তে ভিজে গেছে তার শার্ট আর ট্রাউজার। দৌড়ে বাঁচার চেষ্টা করেও পালানোর পথ পাচ্ছেন না। চাপাতি নিয়ে তাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরেছে খুনিরা। আর হাত তুলে সে চাপাতির কোপ থেকে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন বিশ্বজিৎ।
সেই ঘটনার বীভৎসতায় শিউরে উঠেছিল গোটা বাংলাদেশ। বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল।
বিশ্বজিৎকে হত্যা করার পর প্রথমে বলা হচ্ছিল, তিনি জামাত-শিবিরের কর্মী। এরপর সরকার বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডে ছাত্রলীগের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করে।
কিন্তু এরপর গণমাধ্যমই বিশ্বজিতের হত্যাকারীদের পরিচয় সামনে আনে। ধীরে ধীরে সরকার পিছু হটে।
কিন্তু এতেও কি নৃশংসতা থেমেছে? থামেনি। বিশ্বজিতের পরের শিকার আবরার ফাহাদ।
কিন্তু আবরার হত্যাকাণ্ডের সময় ক্ষমতাসীন দলের কেউই ছাত্রলীগের সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করেনি।
আবরারকে হত্যার পর সংগঠনটি বুয়েট শাখা ছাত্রলীগ থেকে ১১ নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করে। পরে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।
তীব্র আন্দোলনের মুখে বুয়েট উপাচার্য হামলাকারীদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের ঘোষণা দেন।
অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার জন্য ছাত্রলীগ বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃ নতুন ঘটনা নয়। অমন বহিষ্কারের ভূরি ভূরি নজির দেখানো যায়।
২০১৭ সালে নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডে দোষী সাব্যস্তদের আপিলের রায়ে হাইকোর্ট ছাত্র রাজনীতিতে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের প্রধান কিছু কারণ চিহ্নিত করেন।
পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, আগেরদিন বিরোধীদলের অবরোধ প্রতিহত করতে ছাত্রলীগ নেতাদের উসকানির ফল ছিল বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ড।
রায়ে আদালত সুনির্দিষ্ট কারণ হিসেবে দেখান, কিছু রাজনৈতিক নেতা চাঁদাবাজি, অস্ত্র ও মাদক ব্যবসা, হত্যা এবং সহিংসতা ইত্যাদি অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িতদের পৃষ্ঠপোষকতা করে।
আদালত এসব সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব জাতীয় নেতাদের ওপর ন্যস্ত করেন।
কিন্তু তাতেও কোনো কাজ হয়নি। হাইকোর্টের ভর্ৎসনার এক বছর পর বেপরোয়া বাসচালকের গাড়িচাপায় নিহত দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনায় নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করা স্কুল শিক্ষার্থীদের বেধড়ক মারধর করে ছাত্রলীগ।
অত্যুৎসাহী ছাত্রলীগ কর্মী যারা আন্দোলন বানচাল করতে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, আবরার হত্যাকাণ্ডের আগে দশ বছরে প্রায় ১৫০টি মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে ছাত্রলীগের অন্তত ৬০ নেতাকর্মী হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। প্রায় সমসংখ্যক শিশু এবং সাধারণ মানুষ নিহত হয়।
সহিংসতামূলক ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অবৈধ আয় এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শহর এলাকায় প্রভাব বিস্তারের প্রবণতাই এসব সহিংসতার পেছনে দায়ী।
যতদিন আমরা এই দুর্নীতিগ্রস্ত সিস্টেম থেকে মুক্তি না পাব, তত দিন এরকম নিরীহ প্রাণক্ষয় থামানো যাবে না।