গ্যাসের চাবি বন্ধ করল রাশিয়া—পোল্যান্ড ও বুলগেরিয়া দিয়ে শুরু, ইউরোপে গ্যাসের দাম ২৪% বাড়ল এক লাফে!
বুলগেরিয়া ও পোল্যান্ডে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করেছে রাশিয়া। এ ঘোষণার পর পরই ইউরোপে গ্যাসের মূল্য ২৪ শতাংশ বেড়েছে।
গত মাসে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন রুবলে গ্যাসের দাম পরিশোধে ইউরোপের দেশগুলোর প্রতি দাবি জানিয়েছিলেন। সেটি তখন মেনে নেয়নি ইউরোপীয় ইউনিয়ন। রুশ মুদ্রায় মূল্য পরিশোধ না করাতেই পোল্যান্ড ও বুলগেরিয়ায় গ্যাস রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্তের কথা বুধবার (২৭ এপ্রিল) জানিয়েছে রাশিয়ার সরবরাহক গ্যাজপ্রম কোম্পানি।
ইউক্রেনে সামরিক আগ্রাসনের কারণে নজিরবিহীন পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়লেও মস্কো এর মতো কঠোর সিদ্ধান্ত আগে নেয়নি। নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ার অর্থনীতি মন্থর হয়ে পড়ে, মূল্য হারায় রুবল।
তখন পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে রুবলে রপ্তানি করা জ্বালানির মূল্য পরিশোধের চাপ দেন পুতিন। এর মাধ্যমে মার্কিন ডলার ও ইউরোপের বিপরীতে রুশ মুদ্রার বিনিময় দর উত্থানের পরিকল্পনা নেন তিনি।
রাশিয়ার ওপর ইইউ- এর নিষেধাজ্ঞায় পোল্যান্ড ও বুলগেরিয়া সমর্থন দিয়েছে। উভয় দেশই এসময় প্রতিশ্রুতি দেয় যে, তারা এখন থেকে রাশিয়ার গ্যাসের ওপর নির্ভরশীলতা কমাবে। কিন্তু, প্রকৃতপক্ষে রাশিয়ার বিপুল সরবরাহ অন্য উৎস থেকে মেটাতে পারেনি। তার আগেই উল্টো আঘাত হানলো ক্রেমলিন। দেশ দুটির অর্থনীতিতে পড়তে চলেছে যার মারাত্মক প্রভাব। ইউরোপের অন্যান্য দেশের সামনেও এখন অশনি বার্তা। তারাও সরবরাহ বন্ধের ঝুঁকি নিয়ে উদ্বিগ্ন।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লিয়েন এই পদক্ষেপকে "ইউরোপকে জিম্মি করার চাল" উল্লেখ করে বলেন, এটি অন্যায় এবং মেনে নেওয়া যায় না।
পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে রাশিয়ার অপরিশোধিত জ্বালানি তেল (ক্রুড) বাণিজ্যে নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে ইইউ।
এদিকে গ্যাজপ্রমের সিদ্ধান্তের পর, বিদ্যুৎ প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে জ্বালানি বাজারে। ইউরোপে গ্যাসের মূল্য সূচকগুলো সার্বিকভাবে ২৪ শতাংশ পর্যন্ত নাটকীয় হারে বেড়ে প্রতিমেগাওয়াট ঘণ্টা হিসাবে ১২১ ইউরোতে উন্নীত হয়েছে। চলতি মাসে ইউরোপে গ্যাসের বাজারে এটিই সবচেয়ে বড় মূল্যস্ফীতি, এক বছর আগের তুলনায় যা সাতগুণ বেশি।
ইউরোপে প্রধান গ্যাস রপ্তানিকারক রাশিয়া। সিংহভাগ রপ্তানি হয় পাইপলাইনে। ইইউ অঞ্চলে প্রথম রাশিয়ার গ্যাস সরবরাহ বন্ধের শিকার হলো- পোল্যান্ড ও বুলগেরিয়া। অবশ্য গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর পর ইইউ যখন ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা দেয়; তখন রাশিয়া স্পষ্ট হুঁশিয়ারি দিয়েছিল যে, তারা এই অর্থনৈতিক যুদ্ধের কারণে সরবরাহ বন্ধ করে দিতে পারে।
ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর পর ইইউভুক্ত দেশগুলোয় রাশিয়ার গ্যাস রপ্তানি এতদিন অব্যাহতই ছিল। জ্বালানি পণ্য রপ্তানি নির্ভর রাশিয়া নিজে থেকে নিষেধাজ্ঞা দেবে না- এমন ক্ষীণ আশাও ছিল পশ্চিম ইউরোপের সরকার প্রধানদের।
কিন্তু, তা ধুলোয় মিলিয়ে দিল গ্যাজপ্রমের ঘোষণা। বুধবার কোম্পানিটি এক বিবৃতিতে জানায়, "রুবলে মূল্য পরিশোধ না করায় গ্যাজপ্রম বুলগেরিয়ার বুলগারাজ ও পোল্যান্ডের পিজিএনআইজিকে সম্পূর্ণরুপে গ্যাস সরবরাহ বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।"
রাশিয়া থেকে জার্মানি, হাঙ্গেরি ও সার্বিয়ায় সরবরাহ করা গ্যাস পাইপলাইন গিয়েছে পোল্যান্ড ও বুলগেরিয়ার ওপর দিয়ে। এই ট্রানজিট লাইন থেকে অবৈধভাবে গ্যাস সংগ্রহ (চুরি) করলে ওই লাইনগুলোর সরবরাহও সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে গ্যাজপ্রম।
পোল্যান্ডের রাষ্ট্রায়ত্ত গ্যাস ইউটিলিটি কোম্পানি পিজিএনআইজি পৃথক এক বিবৃতিতে রাশিয়ার ইয়ামাল পাইপলাইন থেকে তাদের জন্য গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
এতে বলা হয়, "চুক্তিতে উল্লেখিত শর্ত মেনে চলার পরও ২৭ এপ্রিল থেকে ইয়ামাল পাইপলাইনে প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করেছে গ্যাজপ্রম।"
কোম্পানিটি একে চুক্তির সরাসরি বড়খেলাপ বলেও উল্লেখ করে।
এর আগে পোল্যান্ড বেশ কয়েকবার রাশিয়া থেকে আমদানিকৃত গ্যাসের দাম রুবলে পরিশোধে অস্বীকৃতি জানায়। এক পর্যায়ে তারা গ্যাজপ্রমের সাথে বর্তমান ক্রয় চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধি না করারও পরিকল্পনা করেছিল। বর্তমান চুক্তি শেষ হওয়ার কথা চলতি বছরের শেষ নাগাদ।
তবে গ্যাজপ্রম সাফ সাফ রুবলে মূল্য পরিশোধের ওপরই জোর দিয়ে বলেছে, "গত ১ এপ্রিল থেকে সরবরাহ করা সমস্ত গ্যাসের দাম রুবলেই দিতে হবে। আর সেজন্য রাশিয়ার নির্ধারিত নতুন ব্যবস্থা মেনে চলতে হবে। এবিষয়ে সংশ্লিষ্ট গ্রাহকদের সময় থাকতেই অবহিত করা হয়েছিল।"
রাশিয়ার সরবরাহ হারিয়ে ব্যাপক অর্থনৈতিক চাপের মুখে পড়তে চলেছে পোল্যান্ড ও বুলগেরিয়া। ইইউ জোটের সামনেও হয়তো অপেক্ষা করছে একই পরিস্থিতি।
তুলনামূলক দুর্বল বুলগেরিয়ার ওপর চাপ আরও বেশি। দেশটির জ্বালানিমন্ত্রী আলেক্সান্ডার নিকোলোভ বুধবার সাংবাদিকদের জানান, গত ১ এপ্রিল থেকে সরবরাহ করা গ্যাসের দাম ইতোমধ্যেই তার দেশ রাশিয়াকে দিয়েছে। একারণে, সরবরাহ বন্ধ করা হলো গ্যাজপ্রমের সাথে বর্তমান চুক্তির লঙ্ঘন।
রুবলে মূল্য পরিশোধ না করার ইউরোপীয় কমিশনের সিদ্ধান্তের পক্ষেই বুলগেরিয়ার অবস্থান থাকবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
তবে দেশটি রাশিয়ার গ্যাসের ওপর ব্যাপক মাত্রায় নির্ভরশীল। ৬৫ লাখ জনসংখ্যার দেশটির ৯০ শতাংশ গ্যাস চাহিদা পূরণ হয় রাশিয়া থেকে আমদানির মাধ্যমে। নিকোলোভ মন্তব্য করেন যে, রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে প্রাকৃতিক গ্যাস সম্পদকে ব্যবহার করছে।
বর্তমান মজুদে তার দেশের অন্তত এক মাসের চাহিদা মেটানো যাবে বলেও তিনি উল্লেখ করেছেন।
বিকল্প উৎস থেকে গ্যাস সরবরাহে ইইউ সাহায্য করবে বলেও আশাপ্রকাশ করেন বুলগেরীয় জ্বালানিমন্ত্রী।
এরমধ্যেই গ্রীসের প্রধানমন্ত্রী কিরিয়াকোস মিতসোতাকিস তার বুলগেরীয় সহকর্মীকে আশ্বস্ত করে বলেছেন, নিজস্ব গ্যাস মজুদ নিয়ে গ্রীস তার দেশের পাশে এসে দাঁড়াবে।
উভয় প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ফোনালাপে এ আশ্বাস দেওয়া হয়।
- সূত্র: ডেইলি মেইল