সতীদাহ নিবারণের আবেদন জানিয়ে বেন্টিঙ্ককে লেখা রামমোহনের সেই খসড়া চিঠি
[ভারত তথা সারা বিশ্বে যে কটা চিঠি ইতিহাস হয়ে রয়েছে, তার একেবারে প্রথম সারিতে থাকবে লর্ড বেন্টিঙ্ককে লেখা রামমোহনসহ বাকিদের সেই চিঠি। বিষয় সতীদাহ নিবারণ। শোনা যায়, ড্রাফট নাকি করেছিলেন স্বয়ং রামমোহন রায়। আজ রামমোহন রায়ের জন্মদিনে মূল চিঠিটির বঙ্গানুবাদ ফেসবুকে তুলে দিয়েছেন লেখক-গবেষক কৌশিক মজুমদার। আমরা রামমোহনের জন্মদিন উপলক্ষে লেখাটি টিবিএসের পাঠকদের জন্য তুলে দিলাম। উল্লেখ্য, চিঠিটির অনুবাদ তখনকার দিনের সংবাদপত্র সংবাদ চন্দ্রোদয় থেকে নেওয়া।]
(২৩ জানুয়ারি ১৮৩০। ১১ মাঘ ১২৩৬)
মহামহিম শ্রীলশ্রীযুত লার্ড উলিএম কেবেণ্ডিশ বেন্টিক গবরনর জনরেল বাহাদুর ইন কৌনসেল মহামহিমেষু ফোর্ট উলিএম।
পরের নাম লিখিত কলিকাতা নগরস্থায়ি এবং তন্নিকটস্থ গ্রামনিবাসিরা শ্রীলশ্ৰীযুতের মহোপকারে প্রফুল্ল অন্তঃকরণ সহিত এবং প্রচুর সম্ভ্রম পূৰ্ব্বক প্রার্থনা করিতেছে যে শ্রীলশ্ৰীযুতের অনুমতিক্রমে সমীপস্থ হইয়া হিন্দু প্রজাদের স্ত্রী পরম্পরার জীবন রক্ষার নিমিত্ত মহামহিম ইদানীন্তন যে উপাদেয় নিয়ম করিয়াছেন এবং স্বেচ্ছাপূৰ্ব্বক স্ত্রীবধকলঙ্ক আর আত্মঘাতের অতিশয় উৎসাহকারী রূপ ও দুর্নাম হইতে চিরকাল এ শরণাগত প্রজারদিগ্গে মোচন করিতে যে করুণামুক্ত হইয়া যে সুসিদ্ধ যত্ন করিয়াছেন সেই পরমোপকারের পুনঃ স্বীকার নম্রতাপূর্বক শ্রীলশ্ৰীযুতের সাক্ষাতে করিতে অনুমতি প্রাপ্ত হয়। হিন্দু প্রধানেরা আপন স্ত্রী পরম্পরার প্রতি অতিশয় সন্দিগ্ধচিত্ত হইয়া পরস্পর নির্বাহের সাধারণ সেতুকে উল্লঙ্ঘন এবং অবলা জাতির রক্ষণাবেক্ষণ যে পুরুষের নিয়ত ধর্ম তাহাকে অবজ্ঞা করিয়া বিধবারা উত্তরকালে কোনক্রমে অদ্যাসক্ত না হইতে পান তন্নিমিত্ত আপনাদের অবাধিত ক্ষমতার উপর নির্ভরপূর্বক ধর্মচ্ছলে সজীব বিধবারা যে স্বামির মরণের পরেই শোকের ও নৈরাশ্যের প্রথম উন্মুখে আপন শরীর দগ্ধ করেন এই রীতি চলিত করিলেন। ওই স্ত্রী পরম্পরা দাহের রীতি স্বার্থপর এবং পরানুগামি ইতর লোকের ও অত্যন্ত মনোনীত হইবাতে তাহারা ও তদনুরুপ ব্যবহারে ঝটিতি প্ৰবৃত্ত হইয়া আপনারদের অত্যন্ত মান্য শাস্ত্ৰ উপনিষৎ ও ভগবদগীতাকে অবহেলন করিয়া এবং ভগবান মধু যিনি প্রথম ও সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম বক্তা হন তাঁহার যে আজ্ঞা অর্থাৎ ক্ষমাঅবলম্বন তপোরূপ ধর্ম্মযাজন আর আপনাকে কায়িক সুখ হইতে রহিত করণ ইত্যাদি ধর্ম আমরণান্ত বিধবা করিতে থাকিবেন ৫ অধ্যায় ১৫৮ শ্লোক, তাহাকেও তুচ্ছ করিলেন। বাস্তবিক ইহারা স্ত্রী পরম্পরার প্রতি আপন সন্দিগ্ধান্তঃকরণের সান্ত্বনার নিমিত্ত এইরূপ ব্যবহারে উদ্যত হইলেন কিন্তু লোকেতে এমত গহিত কৰ্ম্ম হইতে আপনাদিগ্গে নির্দ্দোষ করিবার মিথ্যা বাসনায় সাক্ষাৎ দুর্বল শাস্ত্রের কতিপয় বচন যাহাতে স্বেচ্ছাপূর্বক বিধবাকে স্বামির জলচ্চিতারোহণ করিবার অনুমতি দিয়াছেন তাহা পাঠ করিতেন যেন তাঁহারা এরূপ স্ত্রীদাহ ব্যবহারকে শাস্ত্রের আজ্ঞানুসারে করিতেছিলেন কিন্তু স্ত্রীলোকের প্রতি সন্দেহে মুগ্ধ হইয়া করেন নাই। বস্তুত ইহা অতিশয় সৌভাগ্য যে শ্রীশ্ৰীযুত ইংলণ্ডীয় এতদ্দেশাধিপতিরা যাঁহাদের আশ্রয়ে ঈশ্বরপ্রসাদাৎ এদেশীয় স্ত্রী পুরুষ তাবৎ প্রজাদের জীবন সমর্পিত হইয়াছে তাঁহারা বিশেষ অনুসন্ধান দ্বারা নিশ্চয় রূপ জানিলেন যে ওই সকল দুৰ্বল শাস্ত্রের বচন যাহাতে বিধবাদিগ্গে ইচ্ছাপূর্ব্বক জলচ্চিতারোহণের অনুমতি আছে তাহাকে কার্য্যের দ্বারা অমান্য করিতেছিলেন এবং ওই সকল বচনের শব্দের ও তাৎপর্যের সম্পূর্ণ মতে অন্যথা করিয়া পতিবিহীনাদের আত্ম অন্তরঙ্গেরা ওই বিহ্বলাদের দাহকালীন তাহাদিগ্গে প্রায় বন্ধন করিতেন এবং তাহারা চিতা হইতে পলাইতে না পারেন এ নিমিত্ত তদ্যেগ্য রাশীকৃত তৃণ কাঠাদি দ্বারা তাহাদের গাত্র আচ্ছন্ন করিতেন মনুষ্য স্বভাবের ও করুণার সর্ব্বথা বিরুদ্ধ এই ব্যাপার ভূরি স্থানে পুলিসের সংক্রান্ত আমলা যাহারা প্রাণির রক্ষার ও লোকের শান্তি ও স্বচ্ছন্দতার নিমিত্তে ব্যর্থ নিযুক্ত হইয়াছেন তাহাদের অস্পষ্ট অনুমতিক্রমে সম্পন্ন হইতেছিল।
অনেকস্থলে যেখানে সক্ষম মাজিষ্ট্রেট সাহেবের আশঙ্কায় পুলিসের এতদ্দেশীয় আমলারা আপন ইচ্ছানুরূপ আচরণে নিবারিত ছিল কেহ বিধবা কিঞ্চিৎ দগ্ধ হইয়া চিতা হইতে পলায়নপূর্বক আপন প্রাণ রক্ষা করিয়াছেন কেহ বা ভয়ঙ্কর ব্যাপার দেখিয়া চিতার নিকট হইতে নিবৰ্ত্ত হইলেন যাহার দ্বারা তাহারদের প্রবর্ত্তকদের মরণ তুল্য নৈরাশ জন্মিল। কোন স্থানে বিধবাদিগ্গে এরূপ মরণ উচিত নহে ইহা বিশেষ মতে বোধগম্য করতে এবং তাঁহাদের রক্ষার ও যাবজ্জীবন প্রতিপালনের অঙ্গীকার করিবাতে তাঁহারা আপনাদের জ্ঞাতি ও আত্মীয়কর্তৃক ভর্ৎসন রাশিকে আপনাদের উপর স্বীকার করিয়াও সহমরণ হইতে নিবর্ত্তা হইয়াছেন। তাবৎ সহমরণ ঘটিত ব্যাপার যাহা স্বয়ং অতিদারুণ ও কুৎসিৎ এবং ইংলণ্ডীয় অধিকারের নীতির অতি বিরুদ্ধ তাহার প্রণিধানপূর্বক শ্রীলশ্ৰীযুত কৌশলে বিচার ও করুণা উভয় প্রদর্শিত নীতির বিশেষানুষ্ঠানে উদ্যুক্ত হইয়া ইংলণ্ডীয় নামের মহিমা সূচনাৰ্থ আবশ্যক কর্ত্তব্য বোধ এই নিয়মকে নির্দ্ধারিত করিলেন যে শ্রীলশ্রীযুতের হিন্দুপ্রজাদের স্ত্রীলোকের প্রাণরক্ষা অধিক যত্ন পূৰ্ব্বক করিতে হইবেক এবং স্ত্রীলোক প্রতি নিষ্ঠুর ব্যবহার অতিশয় পাতক পুনৰ্ব্বার আর হইতে না পায় এবং হিন্দুদের অতি প্রাচীন পরম পবিত্র ধর্মকে তাহারা নিজে যেন তুচ্ছ না করেন। সম্প্রতিক এ অধীনদের জ্ঞাতসার হইল যে ওই আজ্ঞানুসারে মেজেষ্ট্রেট সাহেবদের প্রতি বিশেষরূপে লিপি প্রস্থাপিত হইয়াছে যে সর্ব্বোপায়ের দ্বারা শ্রীলশ্রীযুতের আজ্ঞাকে প্রতিপালন করেণ।
শ্ৰীলশ্ৰীযুতের মহোচ্চপদের নিয়মের বিবেচনা করিয়া এ শরণাগত প্রজারা আপনাদের অন্তঃকরণের ভাবকে কোন প্রকাশিত সম্মানের চিহ্ন যাহা এমত স্থানে ব্যবহার্য্য হয় তাদ্দ্বারা দর্শাইতে নিবারিত হইয়াছে কিন্তু এ অধীনদের অন্তঃকরণ ও ধর্ম্ম বারবার আজ্ঞা দিতেছেন যে এ শরণাগতরা অন্তঃকরণের ভাব যাহা তাবত হিন্দুর প্রতি পরমানুগ্রাহক শ্রীলশ্ৰীযুতের এই চিরস্থায়ি মহোপকার কর্তৃক উৎপন্ন হইয়াছে তাহা সর্ব্বসাধারণ বিজ্ঞপ্তি করা যায়; যদি এ সময় এ শরণাগতরা তাচ্ছল্যপূৰ্ব্বক মৌনাবলম্বন করে তবে সর্ব্বথা কৃতঘ্ন ও প্রবঞ্চক রূপে গণিত হইতে হইবেক এ নিমিত্ত এ অধীনেরা এ নিবেদন পত্রীকে এই প্রার্থনা দ্বারা সমাপ্তি করিতেছে যে এ অধীনদের সর্ব্বান্তঃকরণ সহিত শ্রীলশ্রীযুতের মহোপকারের অঙ্গীকার রূপ উপহার, যাহা যদ্যপি ও শ্রীলশ্ৰীযুতের মহোচ্চপদের যোগ্য হয় না তাহা কৃপাপূর্বক গ্রাহ্য করেন। ও যাঁহারা শ্রীলশ্ৰীযুতের এই পরম অনুগ্রহকে এ অধীনদের সহিত তুল্য রূপে প্রাপ্ত হইয়াছেন অথচ এই সর্ব্বসাধারণ কৰ্ম্মে অজ্ঞতা অথবা অসংস্কার প্রযুক্ত অধীনদের সহিত ঐক্য হইলেন নাই তাঁহাদের এই ঔদাস্যকে কৃপা পূৰ্ব্বক ক্ষমা করেণ সবিনয় নিবেদন মিতি।
কালীনাথ রায় চৌধুরী
রামমোহন রায়
দ্বারকানাথ ঠাকুর
প্রসন্নকুমার ঠাকুর