সমাজ সংস্কারক রামমোহন ও সাম্প্রদায়িক বঙ্কিম
রাজা রামমোহন রায়ের মৃত্যুর পাঁচ বছর পর ১৮৩৮ সালের ২৭ জুন বাংলা সাহিত্যের শৈশব রচনাকার বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম। বাংলা সাহিত্যের এ বিশাল মানুষটির বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ অহরহই ছিল। তার প্রায় সকল সাহিত্যকর্মে সাম্প্রদায়িকতার বীজ খুঁজে পাওয়া যায়। বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ আন্দোলনের তীব্র সমালোচক ছিলেন এ ব্রাহ্মণ লেখক।
কথা হচ্ছিল আমাদের কালের শিক্ষক ও কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের সঙ্গে। স্যারের কাছে জানতে চেয়েছিলাম বঙ্কিমের সাম্প্রদায়িকতা প্রসঙ্গে। স্যার প্রথমে বললেন, 'মধুতে বিষ আছে জানলে কি মধু খাওয়া মানুষ ছেড়ে দিত?'
সাহিত্য পাঠ ছেড়ে দেওয়া যায় না; তবে বর্তমানে বঙ্কিম স্কুল পর্যায়ে পড়ানো হয় কি না, জানি না। পত্রিকান্তে জেনেছিলাম, পাঠ্যপুস্তক থেকে বহু লেখকের লেখা বাদ দেওয়া হয়েছে দেশের প্রতিক্রিয়াশীলদের সঙ্গে সমঝোতার কারণে।
বঙ্কিমের জন্মের পাঁচ বছর আগে রামমোহন রায়ের মৃত্যু হয়। রামমোহন জন্মেছিলেন ভারতের হুগলি জেলার শ্রীরামপুরে। চাকরিসূত্রে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী ছিলেন ১৮০৩ থেকে ১৮১৪ সাল পর্যন্ত। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চাকরির সুবাধে ইংরেজি ভাষা খুব ভালোভাবে রপ্ত করেছিলেন রামমোহন।
১৮১৫ সাল থেকে রামমোহন কলকাতায় বসবাস শুরু করেন। প্রথম দিকে নানা সংস্কৃত ভাষার পুস্তক- বেদ, উপনিষদসহ বহু গ্রন্থ বাংলায় প্রকাশ করেন। তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য- বেদান্তগ্রন্থ, বেদান্তসার ইত্যাদি। কিন্ত তার আগে তিনি রচনা করেন 'তুবফাতুল মুহহাহিদিন'।
বইটি ছিল ফার্সি ভাষার আর মুখবন্ধ ছিল আরবি ভাষার। এ বইয়ে তিনি প্রথম তার একেশ্বরবাদী চিন্তা প্রকাশ করেন এবং ব্রাহ্ম সমাজ গঠন করেন- যা ছিল একেশ্বরবাদের সঙ্গে বেদের সংমিশ্রণ। এ কারণে ব্রাহ্ম সমাজ ভারতীয় সনাতন হিন্দু ধর্মে এক নতুন মাত্রা যোগ করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দাদা দ্বারকানাথ ঠাকুর ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষিত হন।
অবশ্য গোড়া সনাতন ধর্মাবলম্বীরা ব্রাহ্ম ধর্ম অনুসারীদের কোম্পানির অনুগ্রহী, সুবিধাভোগী মনে করত; এর সঙ্গে তার (রামমোহন) প্রকাশিত গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ 'প্রবর্তক ও নিবর্তকের সম্বাদ' বইয়ে মূলত সতীদাহের ভ্রান্তি তুলে ধরা হয়। কীভাবে আদিকালে প্রথমে অনেক বিধবার মত নিয়ে সতীদাহ প্রথা শুরু হয়েছিল, যদিও তখনো ভুল তথ্য দেওয়া হতো সতীদাহের পক্ষে, যার ফলে পরবর্তীকালে এটি ধর্মীয় রীতিতে পরিণত হয়, রামমোহন এ বইয়ে সেটি বর্ণনা করেন।
লর্ড বেন্টিঙ্ক ১৮২৮ সালে ভারতের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রধান নিযুক্ত হন। রামমোহন রায়ের একান্ত চেষ্টায় ১৮২৯ সালে ডিসেম্বরে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিতে সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ করা হয়। এর বিরোধিতা করে গোঁড়া ব্রাহ্মণরা প্রচুর প্রতিনিধি পাঠায় এবং ইংল্যান্ডের প্রিভি কাউন্সিলে মামলা করা হয়।
রামমোহনকে তখন দিল্লির বাদশাহ দ্বিতীয় আকবর রাজা উপাধি দেন আর রবি ঠাকুরের দাদা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর টাকা দিয়ে বিলেত প্রেরণ করেন সতীদাহ নিষিদ্ধকরণ আইনের পক্ষে বিলেতে প্রিভি কাউন্সিলের মামলায় অংশ নেওয়ার জন্য।
রাজা রামমোহন প্রিভি কাউন্সিলে প্রমাণ করেছিলেন, সনাতন হিন্দু ধর্মে সতীদাহের কোনো বিধান নেই। যার ফলে ১৮৩২ সাল থেকে স্থায়ীভাবে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিতে নিষিদ্ধ করা হয় সতীদাহ। সে পথ ধরে ভারতের অন্য সব অঞ্চলে ক্রমান্বয়ে সতীদাহ নিষিদ্ধ হলো, যা ছিল সেকালের মহামানব রামমোহনের কীর্তি।
রামমোহনের বিলেত যাত্রার আগে মোগল সম্রাট (ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভাতাভোগী) দ্বিতীয় আকবর 'রাজা' উপাধি দিয়েছিলেন প্রিভি কাউন্সিলে ভারতের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শাসিত অঞ্চলের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য। যদিও তার বহু আগে মোঘল সম্রাট হুমায়ুন ও আকবর (প্রথম) সতীদাহ নিষিদ্ধ করার আইন করেছিলেন।
বহু শতাব্দীর সংগ্রামের ফল ছিল সতীদাহ নিষিদ্ধ আইন। রাজা রামমোহন বিলেতেই মৃত্যুবরণ করেন ১৮৩৩ সালে, 'ম্যালিনজাইটিস' রোগে।
রাজা রামমোহনের ইতিহাসের প্রাসঙ্গিকতা এ কারণে যে, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার জীবনে সেই নিষিদ্ধ সতীদাহের পক্ষে মত দিয়েছিলেন। বিধবা বিবাহকে নিষিদ্ধতা করার বিরোধিতা করে নিজ বিধবা কন্যাকে কোনোদিন বিবাহ করতে দেননি; এমনকি কোনো পুরুষের সঙ্গে যেন কন্যাটির যোগাযোগ না হয়, সেজন্য পাহারাদার বসিয়েছিলেন। বিধবা বিবাহ অবশ্যই সতীদাহ সংশ্লিষ্ট। তখনকার ভারতে আইন করা না হলে কন্যাকে হয়তো সতীদাহের রাস্তায় ঠেলে দিতেন বঙ্কিম। সাহিত্যে বঙ্কিমের যে প্রাসঙ্গিকতা, তা হারিয়ে যাচ্ছে অথবা গেছে তার সেই ব্যাপক সাম্প্রদায়িক দর্শনের কারণে।
- লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক