কুতুব মিনার: ভারতের সর্বোচ্চ মিনারটি যে কারণে এখন বিতর্কের কেন্দ্রে
ভারতের রাজধানী দিল্লির আকাশের মাথা তুলে সগর্বে দাঁড়িয়ে রয়েছে কুতুব মিনার। ২৪০ ফুট উঁচু এ মিনারটি রাজধানীর সবচেয়ে আইকনিক ও দৃষ্টিনন্দন স্মৃতিস্তম্ভগুলোর একটি।
কয়েকশ বছর আগে কুতুব মিনারকে গড়ে তোলা হয়েছিল ধ্বংস করা একাধিক মন্দিরের জায়গায়। এখন এক আবেদনের প্রেক্ষিতে ভারতের আদালত সিদ্ধান্ত জানাবেন ওই মন্দিরগুলোকে পুনরুদ্ধার করা হবে কিনা।
১১৯২ সালে হিন্দু শাসকদের পরাস্ত করার পরে দিল্লির প্রথম সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবেক তার বিজয়ের নিদর্শন হিসেবে এই কুতুব মিনার নির্মাণ করেন। বেলেপাথরের তৈরি লালচে-খয়েরি এ স্তম্ভটি ভারতের ইতিহাসের প্রথমদিকের মুসলমান শাসনামলে তৈরি করা স্থাপনাগুলোর একটি।
কুতুবউদ্দিনের পরে আরও তিন শাসক মিনারটিকে ওপরের দিকে বাড়িয়েছিলেন ও অন্যান্য সংস্কার করেছিলেন। এখন এটি একটি পাঁচতলা ভবনের সমান উঁচু এবং এর শীর্ষে যাওয়ার জন্য ৩৭৯টি সিঁড়ি রয়েছে।
ইতিহাসবিদ উইলিয়াম ডালরিম্পলের মতে, কুতুব মিনার ছিল (দিল্লিতে মুসলিম শাসন) আগমনের 'দাম্ভিক ও জয়োল্লাসপূর্ণ একটি বার্তা'।
যে দুর্গ এলাকার (কমপ্লেক্স) ভেতরে কুতুব মিনার নির্মাণ করা হয়েছে, তার রয়েছে বিতর্কিত ইতিহাস। ওই স্থানে থাকা ২৭টি হিন্দু ও জৈন মন্দিরকে ভেঙে সেগুলোর ভগ্নাবশেষ দিয়ে ওই স্থানে নির্মাণ করা হয়েছিল দিল্লির প্রথম মসজিদ।
একটি মন্দিরের স্তম্ভমূলকে অপরিবর্তিত রেখে তা মসজিদের সাথে জুড়ে দেওয়া হয়। মসজিদটি তৈরি করা হয়েছিল বিভিন্ন অংশে ভাগ করে। এসব তথ্য জানা গেছে কুতুব মিনারকে নিয়ে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অভ ইন্ডিয়ার একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জেএ পেজ-এর ১৯২৬ সালের এক লেখা থেকে।
কুতুব মিনারের কমপ্লেক্সের ভেতরে আরও আছে ১৬০০ বছরের পুরনো ২০ ফুট উঁচু একটি লোহার তৈরি স্তম্ভ। সময় ও প্রকৃতির এত বিবর্তনের পরেও এখনো টিকে আছে এটি।
এছাড়া আছে পাঁচটি খিলান এবং একজন সুলতানের সমাধি। হিন্দু ও মুসলিম মোটিফ দিয়ে সাজানো হয়েছে কমপ্লেক্সের ভবনগুলো।
৮০০ বছর পরে কুতুব মিনার কমপ্লেক্সে ধ্বংস হওয়া ২৭টি মন্দির পুনরুদ্ধার করার আবেদন পেয়েছেন ভারতের আদালত। এর আগে নভেম্বর মাসে একটি সিভিল কোর্ট আবেদনটি খারিজ করে দিয়েছিলেন।
তখন আদালত জানিয়েছিলেন, ভারতের ইতিহাসে অনেক শাসক শাসন করে গেছেন, অতীতে এখানে অনেক অপরাধই সংগঠিত হয়েছিল। সেগুলোর ওপর ভিত্তি করে বর্তমান বা ভবিষ্যতে শান্তির আয়োজন করা যাবে না।
এখন সেই আবেদনকারী আদালতের এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করেছেন। হরিশঙ্কর জৈন নামে ওই আবেদনকারীর প্রশ্ন, 'যখন সেখানে মসজিদ থাকার অনেক আগেই মন্দিরের অস্তিত্ব ছিল, তাহলে সেটিকে কেন পুনরুদ্ধার করা যাবে না?' তিনি বিশ্বাস করেন মিনার কমপ্লেক্সের ভেতরে এখনো হিন্দু দেবদেবীরা বিরাজ করেন।
পুরাতত্ত্ববিদেরা মিনার কমপ্লেক্সটির প্রকৃত হাল নিয়ে ওয়াকিবহাল। ভারতের প্রশাসনিক আইন অনুযায়ী এটি একটি সংরক্ষিত স্থাপনা। তারা মনে করেন এর বৈশিষ্ট্য 'চিরস্থায়ী ও পরিবর্তনের কোনো সুযোগ নেই'।
এদিকে বারানসি ও মথুরাতে হিন্দু মন্দির ধ্বংস করে মসজিদ স্থাপনের বিষয়ে একইভাবে বিতর্ক তুলে আনছেন হিন্দুত্ববাদী দলগুলো।
ইতিহাসবিদদের তথ্যমতে, ৭ম শতাব্দী পর্যন্ত হিন্দু রাজারা ও ১২ শতাব্দীর পর থেকে মুসলিম শাসকেরা বিভিন্ন মন্দির লুট, ধ্বংস বা মন্দিরের স্থানে অন্য কিছু তৈরি করেছেন। শত্রুভাবাপন্ন রাজা বা বিদ্রোহী কোনো শাসক যেসব মন্দিরের সমর্থক ছিলেন, সেসব মন্দিরের ওপর এসব অত্যাচার করেছিলেন তারা।
ইতিহাসবিদ রানা সাফভি বলেন, 'প্রতিটি শাসকই তার রাজনৈতিক কর্তৃত্ব, ও শাসনক্ষমতার নিদর্শন দেখাতে সবচেয়ে বড় ধর্মীয় স্থাপনাগুলো ধ্বংস করেছেন। এর মানে এ নয় যে সব মন্দির ধ্বংস করা হয়েছিল। কেবল সেগুলোই ধ্বংস করা হয়েছিল, যেগুলোর রাজনৈতিক গুরুত্ব ছিল।'
কুতুব মিনার কেন নির্মাণ করা হয়েছিল? সাফভি বলেন, এর একটা কারণ হতে পারে কমপ্লেক্সের ভেতরে থাকা মসজিদের মিনার হিসেবে এটি তৈরি করা হয়েছিল। আরেকটি সম্ভাব্য কারণ হিসেবে সাফভি বলেন, শত্রুর গতিবিধির ওপর নজর রাখতেও ওয়াচ টাওয়ার হিসেবে এটি তৈরি করা হতে পারে। তবে সবচেয়ে সম্ভাব্য কারণটি মনে হয় গজনির মতো এটিও একটি বিজয়স্তম্ভ হিসেবে নির্মাণ করা হয়েছিল।
কুতুব মিনার দুইটি বজ্রপাতের শিকার হয়েও এখনো টিকে আছে। তবে একটি বাজে এর চতুর্থ তলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তখন সুলতান মূল বেলেপাথরের বদলে মার্বেল ও বেলেপাথর দিয়ে আরও নতুন দুইটি তলা ও শীর্ষে একটি গম্বুজ তৈরি করেন।
ওই গম্বুজ মোট উচ্চতায় আরও ১২ ফুট যোগ করে। কিন্তু একটি ভূমিকম্পে গম্বুজটি পড়ে যায়। প্রসঙ্গত, কুতুব মিনার দুইটি ভূমিকম্পের পরেও টিকে আছে।
আজকের দিনে কুতুব মিনার স্রেফ একটি ঐতিহাসিক মিনারের চেয়ে অনেক বেশি কিছু। যেমন দীর্ঘদিন ধরে যারা দিল্লিতে বাস করছেন, কুতুব মিনার তাদের স্মৃতিতে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে।
কুতুব মিনার ভারতের একটি জনপ্রিয় পর্যটন স্থলও। ১৯৮১ সালে এখানে এক পদদলনের ঘটনায় অনেক স্কুলশিক্ষার্থীসহ ৪৫ জন মারা যাওয়ার পর দর্শনার্থীদের জন্য এটি বন্ধ করে দেওয়া হয়।
কুতুব মিনারের সৌন্দর্যের বাইরে এখন যেন ছাপিয়ে উঠেছে এটিকে নিয়ে বিতর্ক। এ মাসের শুরুতে হিন্দু ডানপন্থী দলের সদস্যরা মিনার কমপ্লেক্সের বাইরে বিক্ষোভ প্রদর্শনের জন্য গ্রেপ্তার হন।
গত সপ্তাহে হরিশঙ্কর জৈন আদালতকে জানিয়েছিলেন, একটি মন্দির ধ্বংস করলেও এর 'চরিত্র, বৈভব বা পবিত্রতা কখনো হারায় না'। তিনি বলেন, কুতুব মিনার কমপ্লেক্সে প্রার্থনা করার তার সাংবিধানিক অধিকার রয়েছে।
তখন বিচারক উত্তর দিয়েছিলেন: 'কোনো পূজাঅর্চনা ছাড়া গত ৮০০ বছর দেবতা ওখানে আছেন, তাকে সেভাবেই থাকতে দিন।'
আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে এ আবেদনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাবেন আদালত।
- বিবিসি থেকে অনূদিত