থিতু হচ্ছেন যাযাবর বেদেরা, তবে ভুলছেন না পুরোনো ঐতিহ্য
বেদেরা যাযাবর জাতি। একটা সময় ঘুরে ঘুরেই তাদের জীবন কাটত, কোথাও থিতু হওয়ার অবকাশ ছিল না তাদের। বেদে রবিউল মনে করতে পারেন তার যাযাবর জীবনের কথা। তবে সেসব দিন আর এখন নেই, বেদেরা এখন তাদের জীবনযাত্রায় একটা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। নিজেদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা ভেবেই এ পরিবর্তন তাদের।
তরুণ বয়সে নৌকায় কাটিয়েছিলেন রবিউল। কিন্তু বেশ কয়েকবছর ধরে পরিবারকে নিয়ে সাভারের আরাপাড়ায় বাস করতে শুরু করেছেন তিনি। যদিও বেদেরা নৌকার ওপর বাস করে বলেই মানুষ জানে, তবে বর্তমানে রবিউলের মতো আরও ৫০০ থেকে ৮০০ বেদে সাভারের ওই এলাকায় কুঁড়েঘর বেঁধে কলোনি বানিয়ে বসবাস করছেন।
আরাপাড়ার চারদিকে গাছপালার ঘন জঙ্গল, ভেতরে বেদেপল্লী দুনিয়া থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন। ঢোকার পরে মনে হলো দুই দশক অতীতে ফিরে গেলাম।
রাস্তাগুলো সরু আর কাঁচা। বাঁশ ও কাঠের তৈরি ঘরগুলোতে বিদ্যুৎ বা পানির কোনো ব্যবস্থা নেই। ইট-সুরকির দেখা মিলল কেবল একটা দোকান আর কয়েকটা বাড়িতে। সেগুলোও আবার মূল পল্লি থেকে অনেক দূরে।
খালিগায়ে লুঙ্গিপরা রবিউলকে পেলাম একটা চায়ের দোকানে বসে সিগারেট ফুঁকছে। তার কাছ থেকে জানা গেল তাদের নদী থেকে জমিতে বসতি পরিবর্তনের গল্প। তার বাবা তাকে বলেছিলেন, 'আর কতদিন এভাবে চলবে? ছেলেমেয়েদের জন্য আরেকটু ভালো কিছু করতে হবে না?'
বেদেরা বাংলাদেশের একটি যাযাবর সম্প্রদায়। একসময় তাদের জীবন পুরোপুরি নৌকা ও নদীনির্ভর ছিল। নৌকায় থাকলেও কোনো জায়গায় কয়েক মাসের বেশি অবস্থান করত না বেদেরা।
কিন্তু এখন খেলা দেখিয়েই দিনাতিপাত করতে হয় তাদেরকে। বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে সাপের খেলা, বানরের খেলা, আর জাদু দেখিয়ে আয় করতে হয় বেদে সম্প্রদায়ের মানুষদের। অতীতে কোনো এক সময় বেদেরা সাপ ধরা ও বিক্রি করার ব্যবসায়তেও ছিলেন।
গ্রামের অনেক মানুষ বিশ্বাস করেন বেদেদের জাদুটোনা করার ক্ষমতা রয়েছে; শয়তান তাড়াতে দক্ষ বেদেরা। এজন্য বেদেরা তাবিজ, হারবাল ঔষধ এসবও বিক্রি করেন। কোনো খেলা দেখানোর পর এসব বিক্রি করেন তারা। মানুষ কখনো চাল, কখনো টাকা দিয়ে এগুলো কিনে নেন।
বেদেরা খুব প্রান্তিক একটি জনগোষ্ঠী। যেদিন কাজ করতে পারেন সেদিন ৩০০ থেকে ৫০০ টাকার মতো আয় হয় তাদের। রবিউল ব্যাখ্যা করেন, 'আমাদের জীবন কঠিন। প্রাথমিকভাবে, সরকার থাকার জন্য জায়গা দিয়েছিল। বাপ-দাদারেও কিছু পয়সাওয়ালা মানুষ জমি দিয়ে সাহায্য করেছিলেন। সেসব জমির মালিক এখন আমরা হয়েছি।
আমাদের বাড়িঘর খুবই ছোট, অথচ এগুলোর ভেতরেই আমাদের থাকতে হয়। আমাদের বেশিরভাগের পক্ষে নতুন জমি কেনা সম্ভব নয়।'
তবে এখন জীবন নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গি বদলাচ্ছে বেদেদের মধ্যে। 'আমাদের অনেকেই এখন দূরদূরান্ত থেকে ঢাকা আসছে কাজের সন্ধানে। বেদেরা এখন রাজধানীতে বাস করে। জীবন উন্নত করার চেষ্টা না করে বসে থাকার সুযোগ নেই,' বলেন রবিউল।
অনেক বেদে রিকশা চালান, কেউ কেউ কারখানায় কাজ করেন। এদের সন্তানেরা এখন স্কুলে পড়ালেখা করে। তবে বেশিরভাগ বেদেই জীবনযাপনের জন্য এখনো পুরনো পেশার ওপরই নির্ভরশীল। তবে পেশা যা-ই হোক, বেদেপল্লির প্রায় প্রতিটা বাড়িতেই এখনো পোষা সাপ রয়েছে।
সাপের সাথে বিশেষ সম্পর্ক
সাপুড়ে শামসুল একসঙ্গে তিনটি সাপ ধরে রাখতে পারেন। দুহাতে দুইটি, আর মুখ দিয়ে আরেকটি সাপ ধরে রাখার কৌশল জানা আছে তার। বর্তমানে একটি চা-দোকানের মালিক তিনি। চা বিক্রি করলেও তার এখনো একটি পোষা গোখরা ও একটি দুধরাজ সাপ রয়েছে।
'আমরা সাপের অনেক প্রজাতি চিনি। কোনোগুলো বিষাক্ত, আবার অনেক সাপের কোনো বিষ নেই। আমাদের কাছে দুটোই থাকে,' বলেন শামসুল। 'বাপ-দাদাদের দেখেছি এ সাপগুলো ধরতে, সেগুলো দিয়ে খেলা দেখাতে, সেগুলোর যত্ন করতে। সাপের সাথে আমাদের বিশেষ একটি সম্পর্ক রয়েছে।'
তবে বেদেরা সাপের চাষ করেন না। তাদের সব সাপ বন-জঙ্গল থেকে ধরা। কোনো বেদে সাপ ধরার পর তার প্রথম কাজটি হচ্ছে ওই সাপের বিষদাঁত ভেঙে দেওয়া। এরপর সেগুলোকে ছোট কাঠের বাক্সে রাখা হয়।
সাপুড়ে ও সাপ সময়ের সাথে সাথে নিজেদের মধ্যে একধরনের পারস্পরিক বোঝাপড়া তৈরি করে। সাপগুলো বুঝতে পারে কখন বাক্স থেকে বেরিয়ে আসতে হবে, খাওয়ার সময় কখন। তারা এটাও বোঝে যে তাদের মালিকেরা খেলা দেখানোর সময় তাদের কোনো ক্ষতি করবে না।
রবিউল বলেন, 'যখন আমার নতুন একটি সাপের দরকার হয়, তখন আমি কোদাল নিয়ে জঙ্গলে চলে যাই। গ্রামে, আশেপাশের জঙ্গলে সাপ খুঁজে বেড়াই। আমরা খুব ভালো করে জানি কোথায় সাপ পাওয়া যাবে। যখন কোনো গর্ত চোখে পড়ে, তখন আমি বুঝতে পারি ওটা কোনো সাপের গর্ত কিনা, অথবা সাপ ওখানে আছে কিনা।'
বেদেরা নিজেদের মধ্যেও সাপের কেনাবেচা করেন। ছোট প্রজাতির সাপগুলো ৩০০ থেকে ৪০০ টাকার মধ্যে বিক্রি হয়। অন্যদিকে গোখরার দাম ওঠে ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা পর্যন্ত। সাপুড়ের তত্ত্বাবধানে থাকা একটি সাপের বয়স ভিন্নভিন্ন হতে পারে। কখনো একটি সাপ অল্প কয়েক মাস বাঁচে, আকার কোনো কোনো সাপ পাঁচ থেকে ছয় বছর পর্যন্তও বাঁচতে পারে। কিছু সাপ ধরার দিন থেকেই মালিকের দেওয়া খাবার খেতে শুরু করে, আবার কোনোগুলোকে জোর করে খাওয়াতে হয়।
'সাপকে পোষ মানানো যায় না, কিন্তু আমরা প্রায়ই সাপের ওপরই আমাদের জীবিকার জন্য নির্ভর করি,' রবিউল বলেন। 'আমরা আমাদের সক্ষমতা অনুযায়ী তাদের সর্বোচ্চ যত্ন নেই। সাপকে আমরা ব্যাং, ইঁদুর, মাছ ইত্যাদি খাওয়াই। কখনো মাংস কিনতে পারলে তা সাপেদেরও খাওয়াই।
সাপ অসুস্থ থাকলে খেলার সময় ভালোমতো কাজ করতে পারে না, তখন আর খেলা জমে না। সাপ মারা গেলে প্রায়ই দেখা যায় আমাদের অনেকের জীবিকার জন্য আর কোনো পথ খোলা থাকে না।'
হাতসাফাই, খেলা ও বেদেদের জীবিকা
খুব কম সংখ্যক বেদেরই কোনো সাপ নেই। তাদের মধ্যে একজন হচ্ছেন মোহাম্মদ তারা মিয়া। তবে তার একটি বানর আছে। বাবার কাছ থেকে পেয়েছিলেন সেটাকে। বানরের খেলা ও জাদু দেখিয়ে নিজের জীবিকা অর্জন করেন তিনি।
'এ বানর থেকেই আমার খাওয়াপরার খরচ আসে। একে ছাড়া আমার আয়ের আর কোনো উপায় নেই। আমরা অনেক গরীব মানুষ, কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত ও আছে ততক্ষণ দু'পয়সা আয় করে আমি পরিবারের খরচ চালাতে পারি।
পহেলা বৈশাখসহ অন্যান্য উৎসবে মানুষজন আমাদের খেলা দেখানোর জন্য ডেকে নিয়ে যায়। তারা আমাদের কমিশনার রমজান আহমেদের সাথে চুক্তি করে, তিনিই বিভিন্ন জায়গায় আমাদের কাউকে সাপের খেলা, কাউকে বানরের খেলা দেখানোর জন্য পাঠান।'
একটা সময় বেদেরা ঢাকায় এসেও খেলা দেখিয়ে যেত। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তা কেবল বিভিন্ন গ্রামেই সীমাবদ্ধ। বেদেদের ছেলেমেয়েরা এখন স্কুলে যায়, কিশোরেরা বিভিন্ন কারখানায় কাজ করে। বড়রা রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহীর মতো বিভিন্ন দূরবর্তী জায়গায় গিয়ে হাতসাফাই, জাদুসহ অন্যান্য খেলা দেখায়।
সাপ বা বানরের খেলা সাধারণত বাজারে দেখানো হয়। মানুষ খেলা দেখে, এরপর যাওয়ার সময় বেদের কাছ থেকে তাবিজ, হারবাল ঔষধ ইত্যাদি কিনে নিয়ে যায়। একবার খেলা দেখালে কয়েক কেজি চাল, ১০০ থেকে ৫০০ টাকার মতো আয় হয়। তবে কোনো অনুষ্ঠানে বেদেদের খেলা দেখাতে নিয়ে যাওয়া হলে তখন পাঁচ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত সম্মানি মেলে।
তবে বেদেদের জাদু নিয়ে বেদেপল্লির মানুষদের কাছে জানতে চাইলে তারা দাবি করেন, জাদুর কোনো বিষয় নেই।
রবিউল বলেন, 'তাবিজ কাজ করবে কি করবে না সেটা আল্লাহর হাতে। আমরা যেসব ঔষধ বিক্রি করি সেগুলো বিভিন্ন গাছপালা থেকে তৈরি হয়। যেমন আমরা লজ্জাবতী গাছ থেকে বানানো ঔষধ বিক্রি করি, এটি পুরুষের যৌন অক্ষমতা সারাতে ব্যবহার করা হয়। কারও ক্ষেত্রে এ ঔষধ কাজ করে, কারও ক্ষেত্রে করে না।
জাদু বলে কিছু নেই। আমরা মাঝেমধ্যে যেসব হাতের খেল দেখাই সেগুলো কেবল হাতের কৌশল, আর কিছু নয়।'