‘বিপজ্জনক পণ্য’ পরিবহন করছে না শিপাররা, কেমিক্যাল নির্ভর কারখানায় কাঁচামাল সংকট
চট্টগ্রাম বন্দরে বিপজ্জনক পণ্য খালাসে 'জটিলতা'র কথা উল্লেখ করে শিপিং লাইনগুলো বিপজ্জনক রাসায়নিকযুক্ত কার্গো পরিবহন বন্ধ করে দিয়েছে।
সীতাকুণ্ডের বিএম কন্টেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণের ঘটনার পরই এই সিদ্ধান্ত নেয় তারা।
সমুদ্র পথে কেমিক্যাল পণ্য পরিবহন না করায় দেশের বিভিন্ন কারখানায় কাঁচামাল সংকট দেখা দিয়েছে। কেমিক্যাল নির্ভর প্রতিষ্ঠানগুলোতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে উৎপাদন।
মেডিকেল ডিভাইস উৎপাদনকারী, চামড়া, টেক্সটাইল এবং তৈরি পোশাক শিল্পের সাথে সম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতে সৃষ্টি হয়েছে এমন সংকট।
এদিকে কেমিক্যাল সংকটের কারণে দেশের বৃহৎ মেডিক্যাল ডিভাইজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান জেএমআই গ্রুপের উৎপাদনও সংকটের মুখে পড়েছে।
চলতি বছরের ৭ জুন শিপিং এজেন্ট ওশান ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড বিপজ্জনক পণ্য পরিবহন বন্ধ করার বিষয়ে জেএমআই ইন্ডাস্ট্রিয়ালকে একটি চিঠি পাঠায়। যেসব পণ্যের পরিবহন বন্ধ করা হবে সেগুলোর একটি তালিকা পাঠানো হয় চিঠিতে।
চিঠিতে উল্লেখ করা দ্রব্যগুলো হলো- অগ্নি নির্বাপক, রেফ্রিজারেন্ট গ্যাস, ইথিলিন অক্সাইড, সালফার ডাই অক্সাইড গ্যাস সিলিন্ডার, সালফার হেক্সাফ্লোরাইড, অর্গানিক পারঅক্সাইড, হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড, অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট, পটাসিয়াম নাইট্রেট, পটাসিয়াম ক্লোরেট, অ্যাসিটোন, বুটানল, সাইক্লোহেক্সানোন, মিথানল, ইথানল, প্রোপানল, বুটানল, বিউটাইল অ্যাসিটেট, আইসোপ্রোপাইল, অ্যালকোহল, থিনার, জাইলিন, ইথাইল অ্যাসিটেট, দ্রাবক এমটিটি, মিথাইল ইথাইল কিটোন, মিথাইল আইসোবিউটাইল কিটোন, টুলিন, সোডিয়াম নাইট্রেট এবং সালফার।
এমন অবস্থা থেকে পরিত্রান পেতে গত ২৬ জুন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়েছে জেএমআই গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান জেএমআই ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্যাস লিমিটেড।
জেএমআই গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো: আবদুর রাজ্জাক স্বাক্ষরিত চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, "জেএমআই ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্থানীয় ভাবে উৎপাদিত মেডিকেল ডিভাইস জীবাণুমুক্ত করার জন্য ব্যবহৃত ইথিলিন অক্সাইড আমদানি করে ব্যবহারকারীদের চাহিদা অনুসারে তা কার্বন ডাই অক্সাইডের সাথে মিশ্রিত করে সরবরাহ করে থাকে।"
"ইথিলিন অক্সাইড বিপদজনক/হ্যাজার্ডাস কার্গোর অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় শিপিং লাইনসমূহ চট্টগ্রাম বন্দরে এসব পণ্য খালাসের প্রতিবন্ধকতার অযুহাত দেখিয়ে আমাদের কোন কার্গো পরিবহনের অনুমতি দিচ্ছে না।"
চট্টগ্রাম বন্দরের পরিচালক (ট্রাফিক) এর দৃষ্টি আকর্ষণ করে দেওয়া ওই চিঠিতে আরো উল্লেখ করা হয়, জেএমআই ইন্ডাস্ট্রিয়াল দেশের একমাত্র ইথিলিন অক্সাইড এবং কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস মিশ্রনকারী প্রতিষ্ঠান ও সরবরাহকারী। অর্থাৎ স্থানীয় মেডিকেল ডিভাইস উৎপাদনকারী সকল প্রতিষ্ঠান তাদের উৎপাদিত পণ্য জীবাণুমুক্ত করার জন্য জেএমআই ইন্ডাস্ট্রিয়াল কর্তৃক সরবরাহকৃত ইথিলিন অক্সাইড এবং কার্বন ডাই অক্সাইডের গ্যাস মিশ্রণের উপর নির্ভরশীল।
এই অবস্থায় জরুরী ভিত্তিতে বিদেশ থেকে ইথিলিন অক্সাইড আমদানি করা না গেলে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত মেডিকেল ডিভাইস জীবাণুমুক্তকরণ বিঘ্নিত হবে।
সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনিস্টিক সেন্টারসহ সকল চিকিৎসা ব্যবস্থায় ধস নেমে আসবে যা জনস্বাস্থ্যের জন্য প্রচন্ড হুমকিস্বরূপ।
বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে জরুরী ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানকে অনুরোধ করা হয় ওই চিঠিতে।
তবে, জেএমআই গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুর রাজ্জাকের সাথে মোবাইলে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
এদিকে নিরাপত্তা ও ইয়ার্ডের ধারণক্ষমতা ছাড়িয়ে যাওয়ার অজুহতে গত ৯ জুন বাংলাদেশ থেকে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডের চালান সীমিত করার নির্দেশনা দেয় সিঙ্গপুরের পিএসএ কর্পোরেশন।
বিএম ডিপোর দুর্ঘটনার পর থেকে বিদেশি এমএলও (মেইন লাইন অপারেটর) বাংলাদেশে বিপজ্জনক আমদানি ও রপ্তানি পণ্য পরিবহন না করার সিদ্ধান্ত নেয়।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক আইন মেনে পণ্য পরিবহনের নির্দেশনা দিলেও এমএলও গুলো কেমিক্যাল পণ্য পরিবহন শুরু করেনি।
বাংলাদেশের কেমিক্যাল-নির্ভর শিল্প কারখানা চীনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে কেমিক্যাল আমদানি করে। নানা দেশ থেকে আনা কেমিক্যালের চালান জাহাজে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া কিংবা কলম্বো বন্দর হয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছায়। এখান থেকে খালাস করে বিভিন্ন শিল্প কারখানায় ব্যবহার করা হয়।
চট্টগ্রাম বন্দর সুত্র জানায়, চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে আমদানি-রপ্তানিযোগ্য বিপজ্জনক/হ্যাজার্ডাস কার্গো/কন্টেইনার বিদ্যমান নীতিমালা অনুযায়ী পরিবাহিত হয়। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর নির্দেশনা অনুসরণ করে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এ ধরনের পণ্য হ্যান্ডলিং করে।
বিপজ্জনক পণ্য হ্যান্ডলিং সম্পর্কে বন্দর কর্তৃপক্ষ কোনো পরিবর্তন, আদেশ কিংবা নিষেধাজ্ঞা জারি করেনি। প্রচলিত নিয়মেই চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে এ ধরনের পণ্য এবং কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করা হচ্ছে।
এদিকে বিভিন্ন তৈরী পোশাক এবং টেক্সটাইল কারখানাগুলোতে কেমিক্যাল সংকটের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। যেসব কারখানায় আমদানি করা হাইড্রোজেন পার অক্সাইড ব্যবহৃত হতো সেুগলো এখন দেশীয় হাইড্রোজেন পার অক্সাইড দিয়ে তাদের চাহিদা পুরণ করছে।
বিজিএমইএ'র সহ সভাপতি রাকিবুল আলম চৌধুরী এবং বিকেএমইএ'র পরিচালক শাসছুল আজমের সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা বলেন, তৈরী পোশাক কারখানাগুলো এখনো দেশে উৎপাদিত কেমিক্যাল দিয়ে উৎপাদন চালিয়ে যাচ্ছে। শিগগিরই কেমিক্যাল আমদানি স্বাভাবিক না হলে সামনে কারখানাগুলোতে সংকট তৈরী হতে পারে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো: ওমর ফারুক এবং পরিচালক (ট্রাফিক) এনামুল করিমের সাথে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে কেউ সাড়া দেননি।