শুরুতেই আভাস ছিল বিআরটিতে যানজট বাড়বে; এবার তা-ই নিশ্চিত করল সরকারি সংস্থা
ঢাকা বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত বিস্তৃত ঢাকা বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্প নগরের ক্রমবর্ধমান ট্রাফিক সমস্যার সমাধান হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। তবে এটি এখন দুর্বল নকশা, তাড়াহুড়ো করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং বিশেষজ্ঞদের মতামত ও সঠিক পরিকল্পনার উপেক্ষার উদাহরণে পরিণত হয়েছে।
শুধু বিশেষজ্ঞরা নন, সরকারের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) থেকেও প্রকল্পটি নিয়ে নতুন করে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে, যা বিআরটি প্রকল্পকে আরও প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
আইএমইডির সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে প্রকল্পের নকশা নিয়ে সমালোচনা করা হয়েছে। এতে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, ডেডিকেটেড লেনগুলো শহরের বিদ্যমান যানজট কমানোর বদলে নন-বিআরটি লেনে ট্রাফিকের চাপ বাড়াতে পারে কি না।
২৩ ডিসেম্বর প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, 'সম্পূর্ণরূপে চালু হলে ডেডিকেটেড লেনগুলো অন্যান্য লেনে যানজট বাড়াতে পারে, যা জনদুর্ভোগ বাড়াবে এবং সমস্যার সমাধান করবে না।'
৪,২৬৮ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এ প্রকল্পটি শুরু থেকেই সমালোচনার মুখে পড়েছিল। পরামর্শক সংস্থাগুলোসহ বিশেষজ্ঞরা প্রথম থেকেই সতর্ক করেছিলেন যে, ঢাকায় কার্যকর বিআরটি ব্যবস্থার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো এবং পরিচালন কাঠামো স্পষ্টতই অনুপস্থিত।
বিশেষজ্ঞদের মতে, অতি উৎসাহী আমলা ও রাজনীতিবিদদের একটি অংশ দ্রুত সমস্যা সমাধানের আশায় এবং রাজনৈতিক লাভের প্রত্যাশায় প্রকল্পটি এগিয়ে নিয়ে যান।
বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ও এ প্রকল্পের সাবেক পরামর্শক মো. শামসুল হক বলেন, 'বাসের জন্য ডেডিকেটেড লেন যোগ করলে যানজট দূর হবে না। বিআরটি ব্যবস্থা টেকসই হওয়ার সম্ভাবনা কম। এখানে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও অপারেশনাল কাঠামো নেই। তাড়াহুড়ো করে এলিভেটেড রাস্তা তৈরি করায় পুরো করিডোর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।'
তিনি আরও বলেন, নকশার ত্রুটির পাশাপাশি দেশে জবাবদিহিতার অভাব প্রকল্পের ব্যর্থতার অন্যতম বড় কারণ। 'আমলারা প্রকল্পে জোর দেন, কিন্তু তাদের ভুলের জন্য কখনো জবাবদিহি করতে হয় না। এ ত্রুটিগুলো পরিবহন খাতে গুরুতর পরিণতি ডেকে আনতে পারে,' তিনি মন্তব্য করেন।
তবে ঢাকা বিআরটি কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মনিরুজ্জামান এ সমালোচনাকে আগ বাড়ানো ও ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, 'আইএমইডির প্রতিবেদন অনুমাননির্ভর। সিস্টেম চালু হলে বিআরটির প্রকৃত প্রভাব মূল্যায়ন করা যাবে।'
মনিরুজ্জামান মেট্রোরেল প্রকল্পের উদাহরণ দিয়ে বলেন, যাত্রী প্রবাহের কারণে সেটি যানজট হ্রাসে ভূমিকা রেখেছে। তিনি আরও বলেন, 'যখন বিআরটি প্রকল্পটি প্রস্তাব করা হয়েছিল, বিশেষজ্ঞরা এটি সমর্থন করেছিলেন এবং মিডিয়া তখন এর বিরোধিতা করেনি।'
বিআরটি যদি ব্যর্থ হয়, তখন বিশেষায়িত লেনে অন্যান্য যানবাহন চলবে কি না তা নিয়ে সরকার সিদ্ধান্ত নেবে বলেও জানান তিনি। তবে এতে প্রকল্পটির পরিকল্পনা ও দূরদর্শিতা নিয়ে আরও প্রশ্ন উঠতে পারে।
১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্পোরেশন (বিআরটিসি) ৯৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ কাজ শেষ হওয়া বিআরটি রুটে ১০টি বাস দিয়ে পরীক্ষামূলক পরিষেবা চালু করেছে। এ বাসগুলো বর্তমানে অন্যান্য যানবাহনের সঙ্গে লেন ভাগ করে চলছে। প্রকল্পটি এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে সম্পূর্ণরূপে চালু হবে বলে আশা করা হচ্ছে, তখন ডেডিকেটেড লেনগুলো একচেটিয়াভাবে বিআরটি বাসের জন্য সংরক্ষিত থাকবে।
শুরু থেকেই সতর্কতা
অধ্যাপক শামসুল হক জানান, বুয়েট এবং ভারতের সিইপিটি ইউনিভার্সিটি বিআরটি কর্তৃপক্ষকে প্রায় দুই বছর ধরে সম্ভাব্য সমস্যাগুলোর ব্যাপারে সতর্ক করার চেষ্টা করেছিল।
তবে বুয়েট ও সিইপিটির মতো প্রতিষ্ঠানের বিআরটি ব্যবস্থা পরিচালনার সফল অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও উভয় প্রতিষ্ঠান শেষ পর্যন্ত প্রকল্প থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে। তিনি আরও বলেন, উন্নয়ন সহযোগীরাও দায় এড়াতে পারে না। তারা অনেক সময় বাস্তব অবস্থা না বুঝে শুধুমাত্র বাংলাদেশের ক্রেডিট রেটিং দেখে ঋণ দেয়।
তিনি মন্তব্য করেন, 'এ প্রকল্পে ঋণ দেওয়ার সময় এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের এ ত্রুটিগুলো বোঝা উচিত ছিল। কিন্তু তাদের মনোযোগ শুধুমাত্র তহবিল বিতরণে ছিল।'
অধ্যাপক হক আরও উল্লেখ করেন, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক মন্ত্রণালয় অবকাঠামো নির্মাণে সক্ষম হলেও গণপরিবহন পরিচালনার অভিজ্ঞতার অভাব রয়েছে, যা প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক।
ঢাকা বিআরটি কোম্পানির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম শফিকুল ইসলাম জানান, প্রাথমিকভাবে অস্ট্রেলিয়ান কনসালটেন্সি ফার্ম এসএমইসির সঙ্গে ভবিষ্যৎ পরিবহন মডেল নিয়ে মতবিরোধের কারণে বুয়েট এবং সিইপিটি প্রকল্প থেকে সরে যায়। তিনি বলেন, বিষয়টি প্রযুক্তিগত একটি সমস্যা ছিল।
২৭৫ শতাংশ সময় বৃদ্ধি
ঢাকা ও গাজীপুরের মধ্যে যাত্রীদের সহজ, দ্রুত এবং মসৃণ ভ্রমণের সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য ২০১১ সালে বিআরটি-৩ প্রকল্প চালু করা হয়।
এডিবি, ফরাসি দাতা সংস্থা এএফডি, গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট ফ্যাসিলিটি এবং বাংলাদেশ সরকার যৌথভাবে প্রকল্পটি অর্থায়ন করছে। এর মধ্যে রয়েছে ১০ লেনবিশিষ্ট টঙ্গী সেতু এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ফ্লাইওভার নির্মাণ।
তবে, ২০১২ সালে কাজ শুরু হওয়ার পর প্রায় ১২ বছর পেরিয়ে গেলেও প্রকল্পটি সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত হয়নি।
আইএমইডির প্রতিবেদনে পর্যাপ্ত কর্মী ও সরঞ্জাম ব্যবহারে ঠিকাদারদের গাফিলতি এবং প্রকল্প কর্তৃপক্ষের দুর্বল তদারকির কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সড়ক ও জনপথ বিভাগ (আরএচডি), বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ (বিবিএ), স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ (এলজিইডি) এবং ঢাকা বিআরটি কোম্পানিসহ বিভিন্ন সংস্থা জড়িত।
আরএচডি ১৬ কিলোমিটার সড়ক উন্নয়ন, ছয়টি ফ্লাইওভার, ২৫টি বিআরটি স্টেশন এবং দুটি টার্মিনাল নির্মাণের দায়িত্বে রয়েছে। তাদের অগ্রগতি ৯৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ।
বিবিএ ৯৬ দশমিক ৫৭ শতাংশ অগ্রগতি নিয়ে সাড়ে চার কিলোমিটার এলিভেটেড বিআরটি লেন এবং টঙ্গী সেতুর কাজ পরিচালনা করছে। এলজিইডি গাজীপুরে ফিডার রোড এবং বিআরটি বাস ডিপোর কাজ শতভাগ সম্পন্ন করেছে।
প্রকল্পের মোট ব্যয় প্রথমে ২,০৪০ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয় এবং ২০১৬ সালে এটি সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ব্যয় ১০৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে এবং সময়সীমা ২৭৫ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে।
২০২৪ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পের সময়সীমা বাড়িয়ে ডিসেম্বর ২০২৫ পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে ২০২৩ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে আন্দোলনের সময় ১৩টি বিআরটি স্টেশনের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় অতিরিক্ত মেরামতের প্রয়োজন পড়ে।
এ ছাড়া বিআরটি এবং নন-বিআরটি লেনের মধ্যে ধাতব বেড়া স্থাপন করতে আরও তিন মাস সময় লাগবে বলে অনুমান করা হচ্ছে।
বিআরটি ব্যবস্থার জন্য ১৩৭টি বিশেষায়িত বাস সংগ্রহের কাজও এখনও সম্পন্ন হয়নি।
আইএমইডি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নির্মাণ কাজের বিভিন্নতার অনুমোদনে প্রশাসনিক বিলম্বের কারণে প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি স্থবির হয়ে পড়েছে।
ঠিকাদারদের অর্থ পরিশোধে বিলম্ব হওয়ায় কাজের অগ্রগতি আরও বাধাগ্রস্ত হয়েছে। ফলে প্রকল্পটি সময়মতো শেষ হবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে।