স্বল্পোন্নত দেশ হতে উত্তরণ: যে অপেক্ষা বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদ
স্বল্পোন্নত দেশ হতে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক অনুমোদনের বিষয়টি গত ২ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে উদযাপন করেছে বাংলাদেশ। কোনো দেশ পরপর দুটি ত্রিবার্ষিক পর্যালোচনায় উত্তরণের মানদণ্ড পূরণে সক্ষম হলে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের চূড়ান্ত সুপারিশ পায়। বাংলাদেশ দ্বিতীয় বারের মতো মানদণ্ডগুলো অর্জন করেছে। সেকারণে গত বছরের ২৫ নভেম্বর বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা হতে উত্তরণের চুড়ান্ত সুপারিশ অনুমোদন করেছে। তবে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের চূড়ান্ত স্বীকৃতি মিলবে ২০২৬ সালের ২৪ নভেম্বর।
২০২৪ সালের নভেম্বরেই বাংলাদেশের এই স্বীকৃতি পাওয়ার কথা থাকলেও করোনা মহামারির অভিঘাতে বিশ্বজুড়েই অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তা সামাল দিতে এ সময়সীমা দুই বছর বাড়ানো হয়েছে। এই অপেক্ষাটা বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদ। এলডিসি তালিকা থেকে বের হলে বাংলাদেশ বৈদেশিক বাণিজ্যে অনেক ধরণের সুবিধা হারাবে। সেই পরিস্থিতি মোকাবেলার প্রস্তুতির জন্য এই সময়টা কাজে লাগাতে পারবে।
বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘ আলাদাভাবে পৃথিবীর দেশগুলোর শ্রেণিবিন্যাস করে। বিশ্বব্যাংক প্রতিবছর ১ জুলাই মাথাপিছু মোট জাতীয় আয় অনুসারে আনুষ্ঠানিকভাবে দেশগুলোকে চারটি আয় গ্রুপে ভাগ করে। যাদের মাথাপিছু জাতীয় আয় ১ হাজার ৪৫ ডলার বা তার নিচে, তাদের বলা হয় নিম্ন আয়ের দেশ। বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ এ তালিকাতেই ছিল। মূলত ১ হাজার ৪৬ ডলার থেকে শুরু করে যেসব দেশের মাথাপিছু জাতীয় আয় ১২ হাজার ৭৩৬ ডলার, তারা মধ্যম আয়ের দেশের অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশের ১০ বছরের প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে উত্তীর্ণ হওয়ার কথা বলা ছিল। সেই বিবেচনায় অনেক আগেই বাংলাদেশ (২০১৫) লক্ষ্যে পৌঁছায়। যদিও বিশ্বব্যাংক মধ্যম আয়ের দেশগুলোকে 'নিম্ন মধ্যম' ও 'উচ্চ মধ্যম' দুই ভাগে ভাগ করেছে। আমরা নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের তালিকায়।
যাদের গড় মাথাপিছু আয় ৪ হাজার ১২৫ ডলারের মধ্যে সেসব দেশ 'নিম্ন মধ্যম' আয়ের দেশ। নুতন হিসাব অনুযায়ী, আমাদের গড় মাথাপিছু আয় এখন ২ হাজার ৫০০ ডলারের উপরে। অর্থনীতির হিসাবের জন্য ২০০৫-২০০৬ অর্থবছরকে ভিত্তিবছর ধরে আমাদের সকল হিসাব নিকাশ করা হত। কিন্ত এখন ভিত্তিবছর হিসাবে ২০১৫-১৬ অর্থবছর নির্ধারিত হওয়াতে আমাদের গড় মাথাপিছু আয় ২ হাজার ২২৭ ডলারের সাথে আরও ৩২৭ ডলার যুক্ত হওয়াতে ২ হাজার ৫৫৪ ডলারে উন্নীত হয়েছে। সে কারণে একজন মন্ত্রী রসিকতা করে বলছিলেন, 'ঘুম থেকে উঠেই শুনি, আমরা ধনী হয়ে গেছি।'
যদিও বিশ্বব্যাংক আমাদের বিবিএস-এর হিসাবের মধ্যে না থেকে তারা 'এটলাস মেথড' নামের বিশেষ এক পদ্ধতিতে মাথাপিছু জাতীয় আয় পরিমাপ করে থাকে। এই হিসাবের সাথে আমাদের পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবের মধ্যে বেশ খানিকটা পার্থক্য থাকে। এটলাস পদ্ধতিতে একটি দেশের স্থানীয় মুদ্রায় মোট জাতীয় আয়কে (জিএনআই) মার্কিন ডলারে রূপান্তরিত করা হয়। এ ক্ষেত্রে তিন বছরের গড় বিনিময় হারকে সমন্বয় করা হয়, যাতে করে আন্তর্জাতিক মূল্যস্ফীতি ও বিনিময় হারের ওঠা-নামা সমন্বয় করা সম্ভব হয়।
বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা হতে উত্তরণে চুড়ান্ত সুপারিশ জাতিসংঘ অনুমোদন করেছে গত বছরের নভেম্বরে। তিনটি মানদণ্ডে বাংলাদেশকে ধারাবাহিকভাবে উত্তীর্ণ হতে হয়েছে। জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট (সিডিপি) স্বল্পোন্নত দেশগুলোর অনুকূলে উন্নয়ন সহযোগিতা সম্পর্কিত নীতি-পরামর্শ দিয়ে থাকে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন পর্যবেক্ষণ করে থাকে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সিডিপি তিনটি মানদণ্ড নির্ধারণ করে। সেগুলো হলো, মাথাপিছু আয়, জনসম্পদ সূচক এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক।
মাথাপিছু আয় জাতিসংঘ হিসাব পদ্ধতিতে আমরা ধারাবাহিকভাবে ২ হাজার ডলারের উপরে অবস্থান করছি। জনসম্পদ সূচকের জন্য শিশুমৃত্যুর হার, মাতৃমৃত্যুর হার, অপুষ্টির কারণে খর্বকায় শিশুর সংখ্যা, সেকেন্ডারি স্কুলে ভর্তির অনুপাত, প্রাপ্তবয়স্কদের শিক্ষার হার, সেকেন্ডারি স্কুলে ভর্তির ক্ষেত্রে লৈঙ্গিক সমতা—এই ছয়টি বিষয় বিবেচনা করে জনসম্পদ সূচকটি তৈরি করা হয়। এর বাইরেও বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান এবং গড় আয়ু সবটাই পর্যালোচনা করা হয়।
বাংলাদেশের এই উত্তরণ অবশ্যই আমাদের অনেক গর্ব ও সম্মানের। একইসঙ্গে চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনার। স্বল্পোন্নত দেশগুলো অনেক ধরণের সুবিধা প্রাপ্ত হয়। প্রথমত: জিএসপি ও ডিউটি-ফ্রি কোটা-ফ্রি সুবিধা। দ্বিতীয়ত: বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার আওতায় বিভিন্ন অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা, প্রযুক্তিগত সহযোগিতা, নানা রকম ছাড়, দীর্ঘ বাস্তবায়ন কাল ইত্যাদি। তৃতীয়ত: আনুষ্ঠানিক উন্নয়ন সহযোগিতা। চতুর্থত: বিভিন্ন ধরনের উন্নয়ন ও প্রযুক্তিগত সাহায্য। তাছাড়াও স্বল্পোন্নত দেশের জন্য জাতিসংঘে চাঁদার পরিমাণ অনেক কম থাকে, সেটা আর থাকবে না। আইএলও ও জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জন্য জাতীয় আয়ের ০.০১ শতাংশ হারে বাৎসরিক চাঁদা পরিশোধ করতে হবে।
উত্তরণের সরাসরি প্রভাব পড়বে রপ্তানি বাণিজ্যে। কঠিন প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হবে বিশ্ব বাণিজ্যে। ইইউ-এর বাজারের শুল্ক সুবিধা না থাকলে কেবল পোশাকখাত নয় সকল রপ্তানি হুমকির মধ্যে পড়বে। ধারণা করা হয়, আজকের পোশাকখাতের অগ্রগমন সম্ভব হতো না, ইইউ-এর বাজারে শুল্ক সুবিধা না থাকলে। ইউরোপের বাজারে ২১ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি, যার মধ্যে সিংহভাগ বাংলাদেশের পোশাক। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতে ১২ শতাংশ অগ্রাধিকার ট্যারিফ ও রুলস অব অরিজিনের ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা দিয়ে থাকে।
উন্নয়নশীল দেশ হলে সহজ শর্তে ও স্বল্প সুদে ঋণ পাওয়া সম্ভব হবে না। বৈদেশিক বাণিজ্যে ট্যারিফ বৃদ্ধি পাবে, রপ্তানি আয় কমবে, রপ্তানি আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে এ সবই সত্য। এ সকল বিষয় মোকাবেলার জন্য আমরা কতটা প্রস্তুত হচ্ছি, প্রশ্নটা সেখানে। প্রতিটি বিষয় ধরে নিবিড় গবেষণা প্রয়োজন। আমাদের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী (যাদের বয়স ১৫ থেকে ৬৪ বছর পর্যন্ত) মোট জনসংখ্যার ৬৬ শতাংশ। ২০৩০ সালে এটা বৃদ্ধি পেয়ে ৭০ শতাংশে উন্নীত হবে। এই বিপুল 'কর্মক্ষম' জনশক্তিকে কাজে লাগানোর পরিকল্পনা করতে হবে এখন থেকেই। ২০৩০ এর পর হতে এই গ্রাফ নামতে শুরু করবে। তখন অর্থনীতিতে কর্মহীন লোকের সংখ্যা বাড়তে থাকবে।
অর্থনীতির সম্ভাব্য সংকট নিয়ে কোন আলোচনা- সমালোচনা- বির্তক দেখি না। যেটুকু আছে সেটা খুবই গতানুগতিক ও সাধারণ মানের। আমরা রাজনীতির অদ্ভূত এক আবর্তের মধ্যে পড়ে আছি। একটা ব্যাপক রাজনৈতিক সংস্কারের দিকে যেতে হবে। কেবলমাত্র কমপ্লায়েন্স নিয়ে ভাবলে চলবে না। সর্বক্ষেত্রে আইনের শাসন ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। সুশাসনের প্রতিটি ক্ষেত্রের সংস্কার দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই হতে হবে। নিরপেক্ষ ও স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার সকল শর্ত পূরণ করতে হবে। সেই সাথে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো মজবুত হলে রাজনৈতিক সহিংসতা ও বৈরিতার পরিবর্তে রাজনৈতিক সহঅবস্থান সম্ভব হবে। ক্ষমতার পালাবদল হবে স্বাভাবিক ও শান্তিপূর্ণ, যার ভিত্তি হবে সংবিধান।
বাংলাদেশের এই উত্তরণের ফলে আগামী দিনগুলোতে আমরা আরও বেশি বিশ্বায়নের দিকে ধাবিত হবো। আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রগমন বহির্বিশ্বে প্রশংসিত। বৈদেশিক নীতি কৌশল সমাদৃত। তারপরও আইনের শাসন ও মানবাধিকার নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণ গভীরভাবে খতিয়ে দেখতে হবে। প্রয়োজনে কর্মপন্থায় পরিবর্তন আনতে হবে। বিশ্বে এখন আমাদের ভাবমূর্তি বাড়ানোর সময়। সতর্ক থাকতে হবে, যেন এরকম পরিস্থিতিতে আর কখনো পড়তে না হয়।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের তিন মূলস্তম্ভ- সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারকে ভিত্তি জ্ঞান করে আগামী বাংলাদেশের জন্য রোডম্যাপ প্রণীত হতে হবে। বাংলাদেশের গ্রাজুয়েশনের এই ক্ষণে সতর্ক থাকতে হবে, রাজনৈতিক বিভেদ আমাদের আবার পিছিয়ে দিতে পারে। যে বিষয়গুলো এখনও আমাদের সমাজেকে বিভক্ত করে রেখেছে সেগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি হওয়া দরকার, তা না হলে, কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছানো বাধাগ্রস্থ হবে।
- লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক