উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমরা সব করব: প্রধানমন্ত্রী
স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের পূর্ণ যোগ্যতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘ নির্ধারিত তিনটি মানদণ্ডে এবারও সফলতার সঙ্গে উত্তীর্ণ হওয়ায় ২০২৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পাবে বাংলাদেশ।
বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর প্রাক্কালে দেশের এই অর্জনকে 'মহৎ ও গৌরবোজ্জল' হিসেবে উল্লেখ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার গণভবন থেকে ভার্চুয়াল এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, 'সমগ্র জাতির জন্য এটা অত্যন্ত আনন্দের ও গর্বের।'
দেশের আপামর জনসাধারণকে এর কৃতিত্ব দিয়ে উন্নয়ন সহযোগীদেরও ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী। এই অর্জনকে দেশের নতুন প্রজন্মের জন্য উৎসর্গ করে তিনি বলেন, তারাই উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলবে।
'এলডিসি থেকে উত্তরণের পর বাংলাদেশ বর্হিবিশ্বে মর্যাদাশীল দেশে উন্নীত হবে। ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রা অর্জন, ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়া ও ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে উন্নীত হওয়ার জন্য এটি আমাদের জন্য বিশেষ একটি ধাপ'- যোগ করেন প্রধানমন্ত্রী।
গত ২২-২৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) জাতীয় মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান পর্যালোচনা করে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের জন্য চূড়ান্তভাবে সুপারিশ করেছে। এর আগে ২০১৮ সালেও তিনটি মানদন্ডে উত্তীর্ণ হয়েছিল বাংলাদেশ।
আগামী জুন নাগাদ ইউনাইটেড ন্যাশনস ইকোনমিক এন্ড সোশ্যাল কাউন্সিল (ইকোসক) একটি বৈঠক করে তা অনুমোদন দিয়ে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে অনুমোদনের জন্য পাঠাবে। তারপর বাংলাদেশ আগ্রহী হলে ২০২৪ সালেই উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে স্বীকৃতি পেত। তবে করোনা পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির কারণে বাংলাদেশ আরও দুই বছর পরে অর্থাৎ ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হবে।
২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের পরপরই বিভিন্ন দেশে শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা হারাবে বাংলাদেশ। তবে বাংলাদেশের প্রধান বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য ও তুরস্কের বাজারে অতিরিক্ত তিন বছর জিএসপি সুবিধা পাওয়া যাবে।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডাব্লিউটিও) এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের পর বাড়তি শুল্কের কারণে বাংলাদেশের রপ্তানি কমতে পারে প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা। তবে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের রপ্তানি বাড়তে পারে বলে মনে করছে সংস্থাটি। সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের হিসাব অনুযায়ী এর পরিমাণ হতে পারে সাত বিলিয়ন ডলার, ২০৩১ সাল নাগাদ রপ্তানি ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে ১৩ বিলিয়ন ডলার হতে পারে। বাণিজ্য সংক্রান্ত মেধাসত্ত্বের (টিআরআইপিএস) আওতায় বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প যে সুবিধা পাচ্ছে, তা বাতিল হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে।
রপ্তানির ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বাংলাদেশ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) স্বাক্ষরের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এছাড়া, নতুন বাজার ও নতুন পণ্য রপ্তানিতে জোর দিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে অন্তত দুই বিলিয়ন ডলার রপ্তানি বাড়ানো সম্ভব হবে বলে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছেন বাণিজ্য সচিব মো. জাফর উদ্দিন।
এছাড়া, উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের পরও যাতে বাণিজ্য সুবিধা ১২ বছর বহাল থাকে ডাব্লিউটিও'র আগামী মিনিস্ট্রিয়াল কনফারেন্সে সে প্রস্তাব উত্থাপন করবে বাংলাদেশসহ এলডিসি দেশগুলো।
পাশাপাশি স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা থেকে যে অনুদান ও কম সুদে ঋণ সুবিধা পায়, তা কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছে। এর আগে যেসব দেশ উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছে, তাদের সবারই অনুদান কমেছে। তবে দেশের ভাবমূর্তি বাড়ার কারণে দেশগুলোতে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে, যা বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও হবে বলে আশা করছে সরকার।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের তৈরি করা এক ধারণাপত্রে বলা হয়েছে, এলডিসি থেকে উত্তরণের পর মূল চ্যালেঞ্জ হচ্ছে 'মধ্যম মাথাপিছু আয়ের ফাঁদ'। এলডিসি থেকে উত্তরণ হওয়া সবকটি দেশ এখনও মধ্যম আয়ের দেশে রয়ে গেছে। উন্নয়নের ধারা ধরে রাখতে বাস্তবধর্মী নীতি গ্রহণ করতে হবে। স্থানীয় ও বৈদেশিক বিনিয়োগ আকৃষ্ট করে রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীতা সৃষ্টি করার কৌশল গ্রহণ করতে হবে। এজন্য দক্ষ, জবাবদিহিতামূলক এবং দুর্নীতিমুক্ত সরকারি প্রতিষ্ঠান গড়তে মূল ভূমিকা পালন করতে হবে।
সব ধরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে বলে মনে করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, 'উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করার জন্য ইতোমধ্যে আমরা প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছি। চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য যা যা করা দরকার, তা করতে প্রস্তুত আছি'।
'তিনটি সূচকেই নির্ধারিত মানদন্ডের চেয়ে অনেক ভালো করে আমরা উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পাচ্ছি। আমাদের এ অর্জনকে সুসংহত ও টেকসই করতে হবে। এটা ধরে রাখতে হবে এবং আমরা তা পারব। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে।'
তিনি বলেন, টেকসই উত্তরণের লক্ষ্যে বিভিন্ন কৌশল অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ে, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে ট্যানেল, রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, মহেশখালী-মাতারবাড়ি সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্পসহ বেশকিছু মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। এগুলোর কতগুলো এবছর বা আগামী বছরের শুরুতে চালু হবে।
'সারাদেশে একশ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, দুই ডজনের বেশি হাইটেক পার্ক এবং আইটি ভিলেজ নির্মাণের কাজ এগিয়ে চলছে। এসব বাস্তবায়ন হলে কর্মসংস্থান তৈরিসহ অর্থনীতিতে আরও গতি সঞ্চার হবে', আশা করেন প্রধানমন্ত্রী।
১৯৭১ সালে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা তৈরি করে জাতিসংঘ। ওই সময় ২৫টি দেশ এ তালিকায় ছিল। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়। এ পর্যন্ত ছয়টি দেশ এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে। বর্তমানে এলডিসির সংখ্যা ৪৬টি।
এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির সময়কার কথা স্মরণ করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মাত্র সাড়ে তিনবছরে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে ধ্বংসস্তুপের মধ্য থেকে টেনে তুলে স্বল্পোন্নত দেশের কাতারে নিয়ে গিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু সরকারের সময় দেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশ অতিক্রম করে। বাংলাদেশ উন্নয়নের মহাসড়কে প্রবেশ করে।
তিনি বলেন, 'স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে তারই হাতে গড়া বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দেশকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় উন্নীত করলো। আজকের যে অর্জন, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ, তা আমাদের গত ১২ বছরের নিরলস পরিকল্পনা, পরিশ্রম ও প্রচেষ্টার ফসল'।
'এক যুগ আগের বাংলাদেশ আর বর্তমান বাংলাদেশ এক নয়; এখনকার দেশ এক বদলে যাওয়া বাংলাদেশ। ধান উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয়। মাছ, মাংস, সবজি উৎপাদনেও বাংলাদেশ শীর্ষস্থানে। দেশের মানুষই সব করেছেন। আমরা সরকারে থেকে শুধু নীতি-সহায়তা দিয়ে সুযোগ তৈরি করে দিয়েছি', বলেন প্রধানমন্ত্রী।
করোনা পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশের মানুষের জীবন ও জীবিকা স্থিতিশীল থাকা সম্পর্কে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'এটা আমার কোন ম্যাজিক নয়, বাংলাদেশের ম্যাজিক'।
'করোনা মোকাবেলায় সরকার জনগণকে যেভাবে আহ্বান জানিয়ে, মানুষ তাতে সাড়া দিয়েছে। অর্থনৈতিক প্রভাবে কারও যাতে কষ্ট না হয়, সেজন্য গ্রাম পর্যন্ত বিভিন্নখাতে প্রণোদনা ঘোষণা করেছি। আগাম টাকা দিয়ে টিকা কেনার উদ্যোগ নিয়েছি। মানুষের পাশে থাকা আমার কর্তব্যবোধ, দায়িত্ববোধ', জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।