এলডিসি গ্রাজুয়েশনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার প্রস্তুতি নিতে হবে আগামী বাজেট থেকেই
স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ হওয়ার পর শুল্কমুক্ত সুবিধা হারানো, আমদানি পণ্যে বাড়তি ট্যারিফের মাধ্যমে স্থানীয় শিল্পকে দেওয়া প্রতিরক্ষণ কমিয়ে আনার বাধ্যবাধকতাসহ বেশকিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কী করতে হবে, তা নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে। এখন দরকার দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া এবং তা শুরু করা দরকার আগামী বাজেট থেকেই।
এ লক্ষ্যে কিছু ক্ষেত্রে ট্যারিফ কমানোর উদ্যোগ আগামী বাজেট থেকে শুরু করা এবং বাজেটে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনভিত্তিক একটি কৌশলপত্র থাকা উচিত বলে তারা মনে করেন।
শনিবার রাজধানীর মতিঝিলে ফেডারেশন ভবনে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই) আয়োজিত এক সেমিনারে তারা এসব কথা বলেন।
স্থানীয় শিল্পের সুরক্ষা কমিয়ে আনতে হবে বলে ব্যবসায়ী নেতাদের কোন কোন প্রতিনিধিও ওই আলোচনায় স্বীকার করেছেন এবং তারাও নিজেদের প্রস্তুতি নেওয়ার গুরুত্ব তুলে ধরেছেন।
এছাড়া ব্যবসা সহজ করা, ব্যয় কমানোর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ব্যর্থতায় অসন্তোষ প্রকাশ করা, সরকারের নীতি সহায়তা তৈরি পোশাক খাত নির্ভর হওয়ায় তা রপ্তানি বহুমুখী করণের ক্ষেত্রে বাধা বলে উঠে আসে আলোচনায়।
'এক্সপোর্ট চ্যালেঞ্জেস অব বাংলাদেশ আফটার গ্রাজুয়েশন ফ্রম এলডিসি স্ট্যাটাস: অপশনস ফর দ্য প্রাইভেট সেক্টর' শীর্ষক ওই সেমিনারে বাংলাদেশের এলডিসি থেকে উত্তরণের সময় ২০২৬ সালের পর আরো ৫ বছর বাড়ানোর আলোচনাও আসে। কেউ কেউ এই সময় বাড়বে বলে আশার কথা জানালেও সরকারের দায়িত্বশীলদের পক্ষ থেকে বলা হয়, এ বিষয়টি এখনো নিশ্চিত নয়।
এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন; সেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমেদ কায়কাউস।
সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের সাবেক সদস্য ড. মোস্তফা আবিদ খান।
সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, 'এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনে বাংলাদেশের হাতে সময় আছে মাত্র চার বছর। গ্র্যাজুয়েশন পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আগামী বাজেটেই কিছু পদক্ষেপ থাকতে হবে।' এছাড়া একই বাজেটে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনভিত্তিক একটি কৌশলপত্রও থাকা দরকার বলে মত দেন তিনি।
অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, 'আমদানিতে উচ্চ হারের ট্যারিফ কমাতে হবে এবং এজন্য আমাদের এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে।'
আলোচনায় পণ্য বহুমুখীকরণে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া, এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং এ লক্ষ্যে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো, এ কার্যক্রমে সরকারের সংশ্লিষ্ট ২৬টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে সমান্তরালভাবে এগিয়ে আনা, ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট ও প্রেফারেন্সিয়াল ট্রেড এগ্রিমেন্টে ইউরোপের মত অঞ্চলের দেশসমূহের লেবার সহ অন্যান্য শর্ত পরিপালনের যোগ্যতা অর্জন করার গুরুত্ব তুলে ধরেন বক্তারা।
সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, 'বর্তমানে বাংলাদেশ ইউরোপের বাজারে পণ্য রপ্তানিতে কোন শুল্ক দেয় না। ২০১৬ সালের পর বাংলাদেশকে শুল্ক পরিশোধ করতে হবে আর ইউরোপের সঙ্গে এফটিএ থাকায় ভিয়েতনামকে শুল্ক দিতে হবে না। এর অর্থ হলো ওই সময়ে গিয়ে ভিয়েতনামের বিবেচনায় বাংলাদেশি পণ্যে ইউরোপের ক্রেতাদের বাড়তি ১৪ থেকে ১৬% ইফেক্টিভ শুল্ক হবে। বাংলাদেশের কি ১৬% বাড়তি কমপিটিটিভনেস তৈরি হয়েছে?'
আলোচনায় পণ্য বহুমুখীকরণের ক্ষেত্রে সরকারের নীতি সহায়তায় বৈষম্যের বিষয়টি তুলে ধরেন শিল্পোদ্যোক্তাদের পাশাপাাশি আরো একাধিক বক্তা। সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, 'পলিসি মেকিংয়ে তৈরি পোশাক শিল্পের আধিপত্য রয়েছে কারণ তাদের সংসদে বেশ কয়েকজন এমপি রয়েছে, কিন্তু আমাদের, (নন আরএমজি) নেই।'
'তারা আয়ের উপর ১২% ট্যাক্স আর গ্রিন কারখানায় ১০% ট্যাক্স দেয়, কিন্তু আমাদের সেই সুবিধা (হ্রাসকৃত হারে ট্যাক্স) নেই। যতদিন এই বৈষম্য না কমানো হবে, তাতে কেবল কথাই হবে, পণ্য বহুমুখীকরণ হবে না।'
প্রসঙ্গত, বর্তমানে ট্যাক্স সুবিধা ছাড়াও আরএমজি খাত রপ্তানির জন্য কাঁচামাল আমদানির জন্য বন্ড লাইসেন্স সুবিধার ক্ষেত্রে অন্যান্য খাতের তুলনায় বাড়তি সুবিধা পায়। এছাড়া কোভিডকালীন প্রণোদনায়ও এ খাত বাড়তি সুবিধা পেয়েছে।
ইজ অব ডুয়িং বিজনেস: এনবিআরের অগ্রগতি নিয়ে অসন্তোষ
ব্যবসা সহজ করা ও ব্যবসায়ে ব্যয় কমানোর আলোচনায় এনবিআরের কাস্টমস সংক্রান্ত বিভিন্ন কার্যক্রম এখনো অটোমেশন না হওয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করেন বক্তারা। বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মজিবুর রহমান জানান, ২০০৯ সাল থেকে কাস্টমসের ন্যাশনাল সিঙ্গেল উইন্ডো (এনএসডব্লিও) বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়। ২০২২ সালে এসেও তা সম্পন্ন হয়নি। অপর একজন বক্তা বলেন, চার বছর আগে তিনটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অথোরাইজড ইকোনমিক অপারেট (এইও) শুরু করার পর এখনো ওই সংখ্যা তিনেই রয়ে গেছে। এ সময় ড. মুজিবুর রহমান অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, 'কাজ না করতে পারলে এনবিআরকে ভেঙ্গে দেন।'
বক্তব্য প্রদানকালে ড. আহমেদ কায়কাউস বলেন, 'এক হিসেবে আমাদের আসলে বাজার অর্থনীতি। এক্ষেত্রে বিদ্যমান বাধা দূর করা আমাদের কাজ।'
এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনে আরো পাঁচ বছর সময় বাড়বে?
আলোচনায় এফবিসিসিআইর উপদেষ্টা মঞ্জুর আহমেদ ২০২৬ সালের পর আরো পাঁচ বছর সময় বাড়ানোর লক্ষ্যে কাজ শুরু করার উপর গুরুত্ব দেন। তিনি বলেন, 'কোভিডের কারণে এই সময় দুই বছর বেড়েছে। রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণ দেখিয়ে বাংলাদেশ এ জন্য আলোচনা চালিয়ে যেতে পারে।'
এ সময় ড. মজিবুর রহমান বলেন, 'আরো পাঁচ বছর বেড়ে যাবে। চিন্তার কোন কারণ নেই। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিওটিও) এটি বিবেচনা করছে।'
তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, 'আরো এক্সটেনশন হবে কিনা, তা এখনো বলা যায় না। মাঝামাঝি অবস্থানে রয়েছে। কেননা কিছু দেশ এই এক্সটেনশনের বিষয়ে তীব্র আপত্তি জানাচ্ছে।'
এদিকে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সচিব) শরিফা খান বলেন, 'রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের ইস্যুকে সামনে এনে বাংলাদেশ এই সময় বাড়ানোর জন্য প্রস্তাব দিতে পারে। এটিকে বাংলাদেশ ট্রাম্প কার্ড হিসেবে কাজে লাগাতে পারে।'