কৃষকের মার্কেট ব্যবসায়ীদের দখলে
প্রায় ১৫ বছর আগে প্রান্তিক কৃষক পর্যায়ে ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে বগুড়ায় চারটি গ্রোয়ার্স মার্কেট চালু হয় 'উত্তর-পশ্চিম শষ্য বহুমুখীকরণ' প্রকল্পের (এনসিডিপি) আওতায়। এই মার্কেটের মাধ্যমে কৃষকরা নিজেরা তাদের উৎপাদিত পণ্য সরাসরি বড় পাইকারদের কাছে বিক্রি করবেন। নারীর অংশগ্রহণ আর ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা সৃষ্টিরও লক্ষ্য ছিল। কিন্তু এ কার্যক্রম বাস্তবে কাজে আসেনি। মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্যেই আটকে গেছে সব। লাভবান হচ্ছেন তারাই ।
এই চিত্র কেবল বগুড়ায় নয় উত্তরবঙ্গের ১৬ জেলাতেই। রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে মোট ৭৬ টি মার্কেট নির্মাণ করা হয়। এর মধ্যে ৬০টি খুচরা বাজার আর ১৬টি পাইকারি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গ্রোয়ার্স মাকের্টের অধিকাংশই এখন অচল অবস্থায় রয়েছে। যেগুলো চালু রয়েছে সেগুলো আবার অন্য প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের দখলে। নারীর সম্পৃক্ততা ও ক্ষমতায়নের বিশেষ ব্যবস্থার কথা বলা হলেও মার্কেটে খোঁজ নিয়ে এমন চিত্র পাওয়া যায়নি।
৩৩টি উচ্চমূল ফসল (ফল, সবজি, মসলা ও দানা শষ্য) বহুমুখীকরণ ও নিবিড়করণের মাধ্যমে প্রান্তিক কৃষকদের আর্থিক উন্নয়ন, দারিদ্র হ্রাস ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যকে সামনে রেখে প্রকল্পটি নেওয়া হয়।
বগুড়ায় ২০০৭-২০০৮ অর্থবছরে প্রায় ৩ কোটি ৬০ লাখ টাকায় চারটি বাজার বা মার্কেট তৈরি হয়। উত্তরের ১৬ জেলায় মার্কেটগুলো নির্মাণে ব্যয় হয় ৫৭ কোটি ৬০ লাখ টাকা। এর অর্থায়ন করে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক। জেলা কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের পরিচালনায় বাস্তবায়ন করে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)।
প্যাকিং হাউস, গ্রেডিং, শর্টিং, ওয়াশিং, ড্রাইং ইউনিট, লোডিং, আনলোডিং এরিয়া, স্টোরেজ গোডাউন, নারী কর্নার, বাজার ব্যবস্থাপনা কমিটির কার্যালয় তথা ট্রেনিং সেন্টার, স্যানিটারি ল্যাট্রিনসহ ড্রেন, রাস্তা ও ডাস্টবিন নির্মাণ করা হয় এসব মার্কেটগুলোতে। মার্কেট এলাকার এক থেকে দেড় কিলোমিটারের মধ্যে কৃষকদের একটি দল এখানে তাদের উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করবেন। কৃষকদের মধ্যে কেউ এসব পণ্য ঢাকা বা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিক্রির জন্য নিয়ে যাবেন। এ জন্য কৃষকদের কয়েক ধাপে প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়। কিন্তু এসব সুবিধা থেকে বঞ্চিত কৃষকরা। তদারকির অভাবে কিছু বাজার প্রভাবশালীদের দখলে গেছে।
প্রথম দিকে এই এসব মার্কেটের নিয়ন্ত্রণ ছিল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের। দেখাশোনো করে আসছিল কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য পাওয়াই এসব বাজারের মূল উদ্দেশ্য ছিল। তবে কৃষি বিপণন বিভাগও জানে, খুচরা বাজারের মাধ্যমে প্রান্তিক কৃষকরা লাভবান হতে পারেনি। কৃষকদের অভিযোগ, খুচরা বাজার পরিচালনা কমিটির গাফিলতি ও জেলা বাজার কর্মকর্তার তদারকি না থাকা এর জন্য দায়ী।
বগুড়ার খুচরা বাজার মধ্যসত্ত্ব ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে। প্রভাব খাটিয়ে তারাই মালপত্র বাজারের (ভবন) ভিতরে রাখছেন। বগুড়ার মহাস্থান খুচরা বাজার ও আরডিএ এলাকার পাইকারি বাজারে সরেজমিন এর সত্যতা মিলেছে। সম্প্রতি মহাস্থান খুচরা বাজারে গিয়ে দেখা যায়, এখানে বিভিন্ন সবজি কিনছেন আইনুল হক ও সোহাগ। আইনুলের বাড়ি মহাস্থানে। কিন্তু সোহাগের বাড়ি বাগেরহাট জেলায়। তার দুজনে মিলে কয়েকবছর ধরে এ বাজারে ব্যবসা করছেন বলে জানালেন সোহাগ।
নারী কর্নার ১০ বছর ধরে বন্ধ বলে জানালেন এই বাজারের তত্ত্বাবধায়ক দাবিদার রাজিকুল ইসলাম। তিনি মহাস্থান বাজারের স্থানীয় ব্যবসায়ীদের মালামাল টাকার বিনিময়ে খুচরা বাজারে রেখে পাহারা দেন। অথচ খুচরা বাজার তৈরির উদ্দেশ্য প্রান্তিক কৃষকরা এখানে মালামাল সংরক্ষণ করবেন। কিন্তু বাজার বরাদ্দ দেওয়া রয়েছে ৩৭ জনের নামে।
বগুড়া জেলা কৃষি বিপণন অধিদপ্তর থেকে জানা গেছে, জেলায় তিনটি খুচরা বাজার (গ্রোয়ার্স) রয়েছে। খুচরা বাজারের মতো আরেকটি রয়েছে পাইকারি বাজার।
উত্তরবঙ্গের অন্যতম বড় পাইকারি সবজির বাজার মহাস্থানে একটি, শাহাজানপুর উপজেলার দুবলাগাড়ী হাটে একটি ও শেরপুর উপজেলা মির্জাপুরে একটি করে খুচরা বাজার তৈরি করা হয়। ওই প্রকল্পে পাইকারি বাজার নির্মাণ করা হয়েছে বগুড়ার শেরপুর উপজেলার পল্লী উন্নয়ন একাডেমী (আরডিএ) এলাকায়।
মহাস্থানের বাজার কমিটিতে থাকা শিবগঞ্জের রায়নগর ইউনিয়নের এক কৃষক বলেন, 'স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনীতিবিদের দখলে খুচরা বাজার। এগুলো তদারকির কেউ নেই। বিপণন কর্মকর্তা এই বাজারে কোনোদিন এসেছেন, এমন খবরও কেউ জানেন না। বাজার কমিটির কার্যক্রম নেই'।
শাজাহানপুর উপজেলার দুবলাগাড়ী হাটের খুচরা বাজারের অবস্থা কার্যত অচল। সপ্তাহে দুদিন এই মার্কেটে সচল থাকে। মার্কেট তৈরির পর থেকে নারী কর্নার খোলা হয়নি। স্থানীয় সদস্য কৃষকদের বাইরে আরেক ব্যবসায়ী দল এই মার্কেট পরিচালনা করেন।
উপজেলার সাজাপুর গ্রামের কৃষক আবদুর রহমান জানান, 'খুচরা বাজার এবং দুবলাগাড়ী হাটে সবজি বা পণ্য বিক্রির মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। সবই স্থানীয় ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে। কৃষকদের নিয়ন্ত্রণে কিছু নেই'।
শেরপুরের পাইকারি বাজারের অবস্থাও প্রায় একই। এখানে শ্রমিকের কাজ করা বেলাল হোসেন জানান, 'এই বাজার ছয়জন ব্যবসায়ী পরিচালনা করেন। তারা হলেন, হালিম, মোমিন, আলতাফ, নজরুল ইসলাম, হাফিজার ও হাফিজারের জামাই। এই মার্কেটে নিমাণ হওয়ার পর থেকেই কার্যত তারা এখানে ব্যবসা করেন'। তবে জেলা বিপণন সূত্র বলছে, এখানে ব্যবসা করার জন্য ১৫ জনের নামে মার্কেটের জায়গা বরাদ্দ দেওয়া রয়েছে।
ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম জানান, 'এখানে তারা ছয়জন ব্যবসা করেন। বরাদ্দ অনেকের নামে থাকলেও তারা ব্যবসা করেন না'।
গ্রোয়ার্স মার্কেটের সার্বিক বিষয় সম্পর্কে জানতে চাইলে জেলা বাজার কর্মকর্তা তারিকুল ইসলাম বলেন, 'জেলা শহরে নারী ব্যবসা এখনো বিকশিত হয়নি। এই কারণে আমাদের মার্কেটেও সমস্যা। নারীদের নামেই মার্কেট বরাদ্দ রয়েছে। কিন্তু কোনো নারী মার্কেটে বসেন না'।
বগুড়ার অবস্থা অন্য জেলার চেয়ে ভালো আছে দাবি করে তারিকুল বলেন, 'নওগাঁ ও নাটোরের অধিকাংশ গ্রোয়ার্স মার্কেট বন্ধ থাকে।'
খোঁজ নিয়ে জানা গেলো, কুড়িগ্রামের রাজারহাটে প্রায় ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে কৃষক পাইকারি সবজি বাজার এখনো চালু হয়নি। ভবনটি এখন পরিত্যক্ত। দিনাজপুরে গ্রোয়ার্স মার্কেটগুলো মধ্যস্বত্ব ব্যবসায়ীদের দখলে। ফলে কৃষকরা এখানে তাদের উৎপাদিত পণ্য নিয়ে আসতে না পারায় ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
ঠাকুরগাঁওয়ে উদ্বোধনের পর থেকেই কার্যত পরিত্যক্ত ছয়টি গ্রোয়ার্স মার্কেট। অথচ এই সব বাজারের মূল লক্ষ্য ছিল, কৃষক কম দামে যে পণ্য বিক্রি করবে তার সুফল যেন ভোক্তারা পায়। স্থানীয় কৃষকরা বলছেন, এই সব গ্রোয়ার্স মার্কেট বর্তমানে ধ্বংসের পথে।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের রংপুর বিভাগের উপপরিচালক আনোয়ারুল হক বলেন, 'এখন কৃষি বিপণন ব্যবস্থাও পাল্টে গেছে। এখন সবাই একইসাথে কৃষক এবং ব্যবসায়ী। এখন মাঠেই পণ্য বিক্রি হচ্ছে। এ কারণে অনেক কৃষককে মার্কেটে নিয়ে যাওয়া যাচ্ছে না। তারপরও রংপুর বিভাগের অধিকাংশ মার্কেট চালু রয়েছে। অল্প কিছুতে সমস্যা থাকতে পারে'।
জয়পুরহাটের কালাইয়ে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা প্রভাব খাটিয়ে মালপত্র রেখে গ্রোয়ার্স মার্কেট দখল করে আছে বলে অভিযোগ কৃষকদের। নওগাঁর মান্দায় কোটি টাকা মূল্যের সতিহাট গ্রোয়ার্স মার্কেটটি দখলে নিয়েছেন স্থানীয় কয়েক প্রভাবশালী। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে মার্কেটের ভেতরে বসানো হয়েছে ধানের আড়ৎ। কৃষকের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
তবে প্রায় সবগুলো গ্রোয়ার্স মার্কেট ভালোভাবে চালু আছে বলে দাবি করেছেন রাজশাহী বিভাগের কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের উপপরিচালক তাসলিমা খাতুন। তিনি বলেন, 'আমাদের আওতায় সব মার্কেট চালু রয়েছে। তবে কৃষকদের সম্পৃক্ততা কিছুটা কম থাকতে পারে। সেগুলোর খোঁজ-খবর নেওয়া হচ্ছে'।