বছরের শেষ পর্যায়ে বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রতিকূলতার চাপ বাড়ছে
২০২১ সালের শেষ প্রান্তিক শুরু করতে চলেছে বিশ্ব অর্থনীতি, কিন্তু এ পর্যায়ে এসে একাধিক প্রতিকূল অনুঘটকের চাপ বাড়ছে, যা মহামারি থেকে উত্তরণকে আরো ধীরগতির করছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ে নীতিনির্ধারকদের উদার দৃষ্টিভঙ্গিও যে ভুল তা প্রমাণ করছে এ ঘটনা।
বিশ্বের অনেক অঞ্চলে মারাত্মক ডেল্টা ভেরিয়েন্টের বিস্তারে ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রের স্বাভাবিক পরিবেশ। বিশ্বের সেরা অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রও আছে আরেক মুসিবতে, মার্কিন আইনপ্রণেতারা সরকারি দেনার পরিধি বৃদ্ধি ও ব্যয় পরিকল্পনা নিয়ে বিরোধে জড়িয়েছেন।
দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতি চীন থেকেও শঙ্কামূলক খবরই মিলছে। দেশটি মারাত্মক এক বিদ্যুৎ ঘাটতিতে পড়েছে, একইসঙ্গে বড় বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের ওপর চলছে নিয়ন্ত্রক সংস্থার দমনাভিযান। চীনা অর্থনীতির কমপক্ষে ৩০ শতাংশ বিকাশের পেছনে অবদান রাখে আবাসন সম্পত্তি খাত, এ খাতের দ্বিতীয় বৃহৎ সংস্থা চায়না এভারগ্রান্ড গ্রুপ অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে লিপ্ত।
অন্যদিকে, পুরো বিশ্বজুড়ে খাদ্য ও জ্বালানির দর বাড়তে বাড়তে নিয়েছে আকাশচুম্বী রূপ। তার সঙ্গে, বন্দরে জাহাজ ও পণ্যজটের মিলিত প্রভাবে সংকুচিত হচ্ছে বৈশ্বিক সরবরাহ চক্র, যা মূল্য চাপ বৃদ্ধির পক্ষেই কাজ করছে। অনেকস্থানে কর্মী সংকটে উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে।
এ বাস্তবতায় প্রবৃদ্ধি এখনও অব্যাহত থাকলেও, নেপথ্যের এসব সংকট; দুর্বল বিকাশ ও সে তুলনায় দ্রুতগতির মূল্যস্ফীতির আশঙ্কা সৃষ্টি করছে।
বিশ্বব্যাপী কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সাম্প্রতিক সময়ে বাজারে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না করে ধীরে ধীরে প্রণোদনার পথ থেকে সরে আসার যেসব নব-উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, সেগুলোও এর ফলে অনেক জটিল হয়ে পড়বে।
এব্যাপারে এইচএসবিসি ব্যাংকের এশীয় অর্থনীতি গবেষণা বিভাগের সহকারী প্রধান ফ্রেডরিক নিউম্যান বলেন, "মহামারি থেকে দ্রুত উত্তরণের আশা সব সময়ই ভুল ছিল। কয়েক প্রান্তিকে নয়, সম্পূর্ণ উত্তরণের হিসাব কয়েক বছরে করতে হবে।"
প্রধান প্রধান ঝুঁকির দিকগুলো:
চীনে শক্তি উৎপাদনে ঘাটতি যখন বৈশ্বিক দুর্ভোগের কারণ:
চীনে বিদ্যুৎ সংকট কারখানায় উৎপাদন সীমিত রাখতে বাধ্য করেছে, সংকটের মাত্রা উপলদ্ধি করে এরমধ্যেই দেশটির প্রবৃদ্ধির আভাস সংশোধন করে কমিয়েছেন অর্থনীতিবিদেরা।
মহামারির প্রথমদিকে চীনের সরকার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে দেশজুড়ে কঠোর লকডাউনের পদক্ষেপ নিয়েছিল, এর ফলে অর্থনীতির যে বিপুল ক্ষতি হয়, সাম্প্রতিক বিদ্যুৎ সংকট তারপর সবচেয়ে বেশি ক্ষতির কারণ হবে, বলে অনুমান করছেন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক তথ্য বিশ্লেষক ও সংবাদ পরিবেশক ব্লুমবার্গের অর্থনীতিবিদেরা।
ঘাটতি মেটাতে যেসব অঞ্চলে বিদ্যুতের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে, সেসব অঞ্চল দেশটির মোট অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের দুই-তৃতীয়াংশের প্রতিনিধিত্ব করে। জিডিপি'তে শীর্ষ অবদান রাখা পাঁচটি প্রদেশ- গুয়াংডং, জিয়াংশু, শ্যানডং, ঝেঝিয়াং ও হেনানের মতো প্রদেশ রয়েছে এ তালিকায়।
গত সেপ্টেম্বরে মহামারির শুরুর পর প্রথমবারের মতো সংকুচিত হয়েছে কারখানা কার্যক্রম। সব মিলিয়ে চীনের প্রবৃদ্ধি আগামীতে আরো কমে আসার ইঙ্গিত মিলছে।
আবাসন বাজারের জায়ান্ট এভারগ্রান্ড, হয়ে পড়েছে বিশ্বের সবচেয়ে দেনা জর্জরিত ডেভেলপার সংস্থা। যা সার্বিকভাবে চীনের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ গৃহনির্মাণ খাত গতি হারানোর চিত্র তুলে ধরছে।
একইসঙ্গে, তথ্যপ্রযুক্তির মতো শিল্পে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বিধিনিষেধের কড়াকড়ি বিনিয়োগকারীদের উদ্বিগ্ন করছে।
আরও ব্যয়বহুল খাদ্য ও জ্বালানি:
চীনে বিদ্যুৎ সংকটের অর্থ, সেচের অভাবে- ভুট্টা, সয়া, বাদাম থেকে শুরু করে তুলা ফসল সংগ্রহ আসন্ন মৌসুমে কম হবে। ফলে ঘাটতি পূরণে বেইজিং ক্রয় শুরু করামাত্র, আরেকদফা দর বৃদ্ধি লক্ষ্য করবে বৈশ্বিক কৃষি ও খাদ্যপণ্যের বাজার।
স্থানীয় উৎপাদনের শূন্যতা পূরণে গত বছর জুড়ে রেকর্ড পরিমাণ কৃষিপণ্য কেনে বেইজিং, যা বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধির চালিকাশক্তি হয়ে খাদ্যপণ্যের মূল্য কয়েক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে নিয়ে যায়।
গত ১২ মাস জুড়ে জাতিসংঘের একটি খাদ্যমূল্য সূচক একারণে ৩৩ শতাংশ ঊধর্ধমুখী অবস্থানে ছিল। কয়লা, গ্যাস, কার্বন ও বিদ্যুতের মানদণ্ড নির্ধারক প্রধান প্রধান সূচকও এখন রেকর্ড মাত্রায় পৌঁছে যাচ্ছে।
গত তিন বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো ব্যারেলপ্রতি ৮০ ডলার ছাড়িয়েছে অশোধিত জ্বালানি তেলের দর। আর সাত বছরের মধ্যে সবচেয়ে দামী হয়ে উঠেছে প্রাকৃতিক গ্যাস।
ব্লুমবার্গের কমোডিটি স্পট ইনডেক্স যার ফলে এক বছরে সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধির রেকর্ড করেছে। জ্বালানি স্বল্পতায় পড়েছে ইউরোপও।
এব্যাপারে ফ্রান্স ভিত্তিক টোটালএনার্জি এসই-র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা প্যাট্রিক পোয়েন জানান, ইউরোপ বর্তমানে যে গ্যাস সংকটে ভুগছে, তা আসন্ন শীতকাল জুড়ে অব্যাহত থাকবে।
পরিস্থিতির আরো অবনতির শঙ্কাও রয়েছে। ব্যাংক অব আমেরিকার বিশ্লেষকদের মতে, অশোধিত জ্বালানি তেলের দর ব্যারেলপ্রতি ১০০ ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে, যা অর্থনৈতিক সংকটের সূচনা করবে।
সরবরাহ সংকোচন:
উত্তর গোলার্ধে শীতকাল নামছে, কিন্তু ডেল্টা ভেরিয়েন্ট বিস্তার এ মৌসুমে মারাত্মক আতঙ্ক হিসেবে রয়ে গেছে।
আগাম আমদানি বৃদ্ধির তাড়নায় আন্তর্জাতিক বানিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ সংযোগপথ সাংহাই থেকে শুরু করে লস অ্যাঞ্জেলস বন্দরে পণ্যজট বেড়েছে। শিকাগোর রেলইয়ার্ড থেকে শুরু করে যুক্তরাজ্যের গুদামঘরগুলোও এ অবস্থার শিকার।
শূন্য তাক পূরণে যুক্তরাষ্ট্রের বৃহৎ পাইকারি পণ্য বিক্রেতা কস্টকো হোলসেল কর্পের মতো প্রতিষ্ঠান আসন্ন লকডাউনের ভয়ে প্রায় সব ধরনের পণ্য অর্ডার করে রাখছে।
অন্যদিকে, সেমিকন্ডাক্টর চিপ, রাসায়নিক ও কাঁচের মতো প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সংগ্রহে সমস্যার মুখে পড়েছে উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলো।
দুবাইয়ের ডিপি ওয়ার্ল্ডের মতো বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ বন্দর পরিচালক সংস্থা, সরবরাহ চক্রের সংকোচন আরো অন্তত দুই বছর ধরে চলার আশঙ্কা করছে।
যুক্তরাষ্ট্রে অনুভূত হচ্ছে তীব্র শ্রমিক স্বল্পতা। আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে মার্কিন কর্মীদের বেতনভাতা বিষয়ক প্রতিবেদন সেপ্টেম্বরে উৎপাদকরা এনিয়ে কতোটা দুর্ভোগের শিকার হয়েছেন, সে চিত্র তুলে ধরবে।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ