রড-সিমেন্ট কারবারে করোনার হানা
প্রবাসী অধ্যুষিত জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়া। এ জেলার লাখো প্রবাসী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে থাকেন। ডিসেম্বর থেকে মার্চ এই সময়ে বেশিরভাগ প্রবাসী দেশে ফিরে বাড়ি বানানোর কাজ করে থাকেন। তাই রড-সিমেন্ট বিক্রির জন্য এই চার মাসকে মৌসুম ধরা হয়।
তবে বিশ্বব্যাপি করোনাভাইরাসের কারণে এ বছর প্রবাসীদের আয়েও প্রভাব পড়েছে। অন্যান্যবারের তুলনায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রবাসী আয়ে নির্মাণ কাজ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। করোনা পরিস্থিতির আগে যারা বাড়ি বানানো শুরু করেছিলেন তারাও কাজ বন্ধ রেখেছেন। এর প্রভাব পড়েছে স্থানীয় রড-সিমেন্ট ব্যবসায়। একই চিত্র দেখা গেছে নোয়াখালী ও মৌলভীবাজারে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, অন্যান্য বছর এই সময় তারা যে পরিমান পণ্য বিক্রি করেন, চলতি বছর বিক্রি হচ্ছে তার প্রায় অর্ধেক। আবার ব্যবসাটি যেহেতু বাকিতে হয়ে থাকে, আগের বছর যারা পণ্য নিয়েছিলেন তারাও অর্থাভাবে বকেয়া পরিশোধ করছেন না।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় ছোট-বড় সব মিলিয়ে দুই শতাধিক রড-সিমেন্টের দোকান রয়েছে। এর মধ্যে শুধুমাত্র জেলা শহরেই রয়েছে শতাধিক দোকান। বড় দোকানগুলোতে মৌসুমের সময় প্রতি মাসে গড়ে পাঁচশ টন রড ও পাঁচ হাজার বস্তা সিমেন্ট বেচাকেনা হয়। আর ছোট দোকানগুলোতে পঞ্চাশ থেকে একশ টন রড এবং সিমেন্ট বেচাকেনা হয় তিন থেকে চার হাজার বস্তা।
শুক্রবারের বাজার দর অনুযায়ী, প্রতি এক টন রডের পাইকারি দাম ছিল ৫৮ হাজার টাকা, আর এক হাজার বস্তা সিমেন্টের মূল্য চার লাখ ৪০ হাজার টাকা।
কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, চাকরি হারিয়ে অনেক প্রবাসী দেশে ফিরে এসেছেন। দেশে তাদের অধিকাংশই এখন কর্মহীন অবস্থায় আছেন। আর প্রবাসীদের এই দূরাবস্থা রড-সিমেন্টের ব্যবসাতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। কারণ ডিসেম্বরের পর থেকে অনেক প্রবাসীই দেশে ফিরে বাড়ি তৈরির কাজে হাত দেন। কিন্তু এবার নির্মাণ নেই বললেই চলে। বাড়ি তৈরির জন্য কারো হাতেই পর্যাপ্ত টাকা নেই।
এ দিকে, রড-সিমেন্ট ব্যবসা মন্দা হওয়ায় এর সঙ্গে জড়িত শ্রমিকরাও প্রায় উপার্জনহীন হয়ে পড়েছেন। এখন দোকান খুললেও আগের মতো কাজ নেই শ্রমিকদের। এর ফলে বাজারে এসে অলস সময় পার করছেন তারা।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের টানবাজার এলাকার ভ্যানচালক বাচ্চু মিয়া জানান, ১০ বছর ধরে তিনি বাজারে বিভিন্ন দোকানে রড-সিমেন্ট পরিবহনের কাজ করেন। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরুর আগে দিনে চার-পাঁচ ভ্যান রড-সিমেন্ট পরিবহন করতেন। এখন দিনে এক ভ্যানও পরিবহন করতে পারছেন না। ফলে রোজগারও হচ্ছে কম। আর করোনাকালে মালিক পক্ষও শ্রমিকদের কোনো সহযোগীতা করেননি বলে জানান তিনি।
জেলার টানবাজার এলাকার সেলিম ট্রেডার্সের ব্যবস্থাপক আতিকুর রহমান জানান, মৌসুমের সময় তার দোকানে প্রতি মাসে গড়ে পাঁচ থেকে ছয়শ টন রড বেচাকেনা হয়। সিমেন্টও বেচাকেনা হয় কয়েক হাজার বস্তা।
''কিন্তু এখন ব্যবসা অর্ধেকে নেমে এসেছে। এ ছাড়া করোনাভাইরাসের আগে বিক্রিত পণ্যের বিল এখনও পাইনি। ফলে ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণও পরিশোধ করা যাচ্ছে না। অথচ সুদ ঠিকই দিতে হচ্ছে। এ অবস্থায় আমাদের আবার ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ প্রয়োজন'', বললেন আতিকুর।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের পুনিয়াউট বাসস্ট্যান্ড এলাকার মেসার্স আল মদিনা ট্রেডিংয়ের সত্ত্বাধিকারী সালাহ উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরুর আগে গড়ে প্রতি মাসে ১৫/২০ লাখ টাকার রড-সিমেন্ট বিক্রি করতে পারতাম। এখন মাসে দুই-আড়াই লাখ টাকার মাল বিক্রি করতেও কষ্ট হচ্ছে।
''মানুষের কাছে টাকা নেই, তাই বাড়ি তৈরির কাজও বন্ধ রয়েছে। দীর্ঘদিন বেচাকেনা বন্ধ থাকায় পুঁজি সংকট দেখা দিয়েছে। তাই সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ দিলে আমাদের সুবিধা হয়'', যোগ করেন তিনি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আজিজুল হক বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে সব ব্যবসাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রড-সিমেন্ট ব্যবসায় ক্ষতির পরিমাণ আমরা এখনও নিরূপণ করিনি। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারন করা হবে।
'সরকারের তরফ থেকে করোনাভাইরাসের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের ব্যাংক ঋণের সুদ মওকুফের বিষয়টি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বাস্তবায়ন করছে না। চার শতাংশ সুদে ঋণ দেওয়ার বিষয়টিও কয়েকটি ব্যাংক ছাড়া বাকিগুলো মানছে না। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসনের সাথে সমন্বয় করে সবগুলো ব্যাংকে আমরা কথা বলছি, যেন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা চার শতাংশ সুদে ঋণ পান'', যোগ করেন তিনি।
এ ব্যাপারে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ব্যাংকার্স ফোরামের সভাপতি ও সোনালী ব্যাংক লিমিটেডের ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রধান শাখার ব্যবস্থাপক ইকবাল হোসেন ভূইয়া বলেন, চার শতাংশ হারে প্রণোদনা ঋণ দেওয়ার জন্য সরকার কিছু খাত নির্ধারণ করে দিয়েছে। সেই খাত অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা চাইলে আমরা ঋণ দিব। আর করোনাভাইরাসে ক্ষতিগ্রস্ত কোনো ব্যবসায়ী যদি এসে ক্ষতির কথা বলেন, তাহলে তার সুদ মওকুফ হবে। কিন্তু আমাদের কাছে এমন কেউ আসেননি।
মৌলভীবাজারে গৃহ নির্মাণ কমেছে অর্ধেক
জেলার সদর উপজেলার শাহাবন্ধর এলাকার কয়ছর আহমদের ইচ্ছে ছিল এ বছর বাড়ি বানাবেন। কিন্তু করোনার কারণে ফ্রান্স প্রবাসী ভাই বেকার হয়ে যাওয়ায় তিনি সে সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে এসেছেন।
মৌলভীবাজার পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী সৈয়দ নকিবুর রহমান জানান, পৌর এলাকায় গত বছরের তুলনায় এ বছর বাড়িঘর ও মার্কেট নির্মাণ ৬০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে।
স্থানীয় রড-সিমেন্ট ব্যবসায়ী জাইন হার্ডওয়ারের পরিচালক হুমায়েদ আলী জানান, গত বছর এই সময় প্রতিদিন গড়ে আট থেকে ১০ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি হত, এখন হচ্ছে সর্বোচ্চ তিন লাখ।
গৃহ নির্মাণ কমেছে নোয়াখালীতে
নোয়াখালী জেলায় করোনা পরিস্থিতিতে বৈদেশিক আয় কমায় নতুন বাড়িঘর নির্মাণ প্রায় বন্ধ রয়েছে।
জেলা প্রবাসী কল্যাণ শাখা এবং জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, বৈশ্বিক করোনা পরিস্থিতিতে নোয়াখালীর অনেক প্রবাসী দেশে ফিরেছেন। অনেকে দেশে আসার পর আবার কর্মস্থলে ফিরতে পারছেন না। এই সময়ে যারা প্রবাসে অবস্থান করছেন তারাও সেখান থেকে আগের মতো বাড়িতে টাকা পাঠাতে পারছেন না।
জেলা শহর মাইজদীর নির্মাণ সামগ্রী বিক্রেতা মেসার্স দেশ বাংলার স্বত্বাধিকারী মোসলেহ উদ্দিন সোহেল জানান, গত মার্চ মাস থেকে তাদের রড, সিমেন্টসহ অন্যান্য নির্মাণ সামগ্রী বিক্রি অর্ধেকে নেমে এসেছে।
'এখন নতুন কোনো বাড়ি ঘর নির্মাণ হয় না বললেই চলে। শুধু কিছু সরকারি সড়ক ও পুল-কালভার্ট তৈরির কাজ হচ্ছে'', যোগ করেন তিনি।
সদর উপজেলার সোনাপুর বাজারের নির্মাণ সামগ্রী বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান রহমান টেডার্সের পরিচালক আদদান হোসের জানান, স্বাবাভিক সময়ে প্রতি মাসে যেখানে অন্তত ৫-৭ জন প্রবাসী বাড়ি তৈরির জন্য কয়েক কোটি টাকার নির্মাণ সামগ্রী কিনতেন সেখানে এখন কোনো নতুন ক্রেতা নেই বললেই চলে।
রড প্রস্ততকারী প্রতিষ্ঠান আর এস এম রডের নোয়াখালী অঞ্চলের সহকারী ব্যবস্থাপক ফখরুল ইসলাম জানান, মার্চের পর থেকে তাদের বিক্রি কমেছে ২৫ শতাংশ। তিনি বলেন, 'এখন নতুন কোনো বাড়ি হচ্ছে না। পুরোনা কিছু কাজ হচ্ছে মাত্র।'
সংবাদটি প্রস্তুতে আমাদের মৌলভীবাজার প্রতিনিধি ও নোয়াখালী সংবাদদাতা সহযোগীতা করেছেন।