রপ্তানিবান্ধব হচ্ছে টাকা
এক বছর আগেও ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর মুদ্রার তুলনায় টাকার মান বেড়ে যাওয়ায় রপ্তানিতে পিছিয়ে পড়ছিল বাংলাদেশ।
তবে বর্তমানে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে অনেকটাই। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলার কিনে নেওয়ার কারণে টাকার মূল্য স্বাভাবিক রয়েছে, একই সময়ে ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর মুদ্রার মান বেড়ে গেছে বহুগুণে।
সম্প্রতি ব্যাংকারদের এক বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী, মহামারির সময়ে ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে মাত্র দশমিক ১২ শতাংশ, সেসময় চীনা ইউয়ানের মূল্য বেড়েছে সর্বোচ্চ ৮ দশমিক ৯৫ শতাংশ। অন্যদিকে ডলারের বিপরীতে ভারতীয় রূপির মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে ৩ দশমিক ৪১ শতাংশ।
রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনামের মুদ্রার মান কমে যাওয়ায় দেশটি দ্রুতগতিতে রপ্তানির বাজার দখল করে নিচ্ছিল, মহামারির সময় জুন থেকে ডলারের বিপরীতে ভিয়েতনামিজ ডং-এর মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে দশমিক ৩৮ শতাংশ।
একই সময়ে ডলারের বিপরীতে কম্বোডিয়ান রিয়েলের মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে দশমিক ৭৬ শতাংশ ও ইন্দোনেশিয়ান রুপিয়াহর মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে দশমিক ৮৫ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টদের মতে, মহামারির সময়ে রপ্তানিকারকরা অর্ডারের অভাবে পড়লে, প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর মুদ্রার মান ডলারের বিপরীতে উচ্চহারে বেড়ে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে এর সুফল পেয়েছে বাংলাদেশের স্থানীয় রপ্তানিকারকরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক (গবেষণা) ড. মো হাবিবুর রহমান জানান, ডলারের বিপরীতে দেশীয় মুদ্রার মান বেড়ে গেলে রপ্তানির বাজারে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা কমে যায়, অন্যদিকে ডলারের বিপরীতে মুদ্রার অবচয় (মান কমে গেলে) হলে, রপ্তানির বাজারে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বেড়ে যায়।
তিনি জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপের কারণে বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর তুলনায় ডলারের বিপরীতে টাকার মান খুব বেশি বৃদ্ধি পায়নি। ফলস্বরূপ, রপ্তানির বাজারে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বেড়েছে।
দেশে বৈদেশিক মুদ্রা প্রবাহ বেশি থাকলে, দেশীয় মুদ্রার মান কমে যায়। বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বেশি থাকা সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলার কিনে নেওয়ার কারণে টাকার মূল্য কিছুটা বেড়েছে।
চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ৫ বিলিয়ন ডলার কিনে নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, টাকার হিসাবে যা ৪৬ হাজার ৫৬৩ কোটি টাকা। এ সংখ্যা ২০১৯-২০ অর্থবছরের তুলনায় প্রায় সাতগুণ বেশি।
বিদেশি লেনদেনের ক্ষেত্রে ডলারের মান স্থিতিশীল রাখতেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরে ডলারের বিপরীতে টাকার মান ৮৪.৮০ টাকায় স্থির ছিল।
গত বছরের জুলাই থেকে গড় মাসিক রেমিট্যান্স প্রবাহ ছিল ২ বিলিয়ন ডলার, ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রথমবারের মতো ৪৩ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে।
বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন জানান, মুদ্রার অবচয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অন্যান্য দেশের তুলনায় পিছিয়ে থাকায়, ডলারের বিপরীতে কম হারে টাকার মুল্যবৃদ্ধি রপ্তানিকারকদের জন্য সহায়ক হবে।
অন্যান্য দেগুলোর তুলনায় কম হারে মুদ্রার মূল্যবৃদ্ধির কী সুবিধা পাওয়া যাবে তা মুদ্রাস্ফীতির ওপরও নির্ভরশীল। অন্যান্য দেশগুলোর তুলনায় মুদ্রাস্ফীতি বেশি হলে বিনিময় মূল্যে প্রাপ্ত সুবিধাও কমে যায়। রিয়েল ইফেক্টিভ এক্সচেঞ্জ রেট (আরইইআর) এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, বাংলাদেশের আরইইআর কম আছে, অর্থাৎ তুলনামূলকভাবে দেশের মুদ্রাস্ফীতির হার কম। গত বছরের অক্টোবরে রিয়েল ইফেক্টিভ এক্সচেঞ্জ রেট ১১৪'র বেশি ছিল, যা গত ডিসেম্বরে ১১০ এ নেমে এসেছে।
আরইইআর বৃদ্ধি হলে রপ্তানির বাজার সংকুচিত আর আমদানি উৎসাহিত হয়। ফলে রপ্তানির প্রতিযোগিতার সক্ষমতা কমে যায়।
ড. জাহিদ হোসেন জানান, বিশ্বব্যাপী ডলারের মান কমে গেলে দেশীয় বাজারেও তাই হবে। মহামারির সময় আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের মান কমে গিয়েছিল বলে জানান তিনি। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগের কারণে ডলারের মান খুব একটা কমেনি।
বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার না কিনলে ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যও আরও বেড়ে যেতো। ভারতে আমদানি কমে গিয়ে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ায় ডলারের বিপরীতে রূপির মূল্য উচ্চহারে বেড়ে যায়। ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকও বৈদেশিক বিনিময় বাজারে হস্তক্ষেপ করেনি। ফলে বাংলাদেশে ডলারের মান প্রায় স্থিতিশীল হলেও ভারতে ডলারের মান অস্থিতিশীল ছিল বলে জানান ড. জাহিদ হোসেন।
২০১৯ সালে ভারত ও চীনের মতো প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোতে ডলারের বিপরীতে দেশগুলোর মুদ্রার মান কমে গেলেও, টাকার মান বেড়ে যায় ১ দশমিক ১৮ শতাংশ।
২০১৯ সালে ডলারের বিপরীতে ভারতীয় রূপির মান কমেছিল ২ দশমিক ৫৬ শতাংশ, চীনের মুদ্রার মান কমেছিল ১ দশমিক ৬১ শতাংশ। সেবছর বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ ভিয়েতনামের মুদ্রার মান বেড়েছিল দশমিক শুন্য এক শতাংশ।
গত বছরের ফেব্রুয়ারির শুরুতে, ফিচ সলিউশনের পূর্বাভাস ছিল, ২০২০ ও ২০২১ সালে টাকার মূল্য কমে যেতে পারে, যার সুফল ভোগ করবেন রপ্তানিকারক ও রেমিটারসরা। ফিচের পূর্বাভাস অনুযায়ী, এবছরের শেষে গিয়ে ডলারের বিপরীতে টাকার মান গড়ে কমে ৮৬টাকায় দাঁড়াবে, পরের বছর যা হবে ৮৮টাকা। ২০১৯ সালে ডলারপ্রতি টাকার গড় মান ছিল ৮৪.৯২ টাকা।