স্যানিটারি, পাইপ ও টিউবওয়েল ব্যবসা হুমকির মুখে
করোনার ধকলে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকার স্যানিটারি পণ্য, পাইপ ও টিউবওয়েল ব্যবসা হুমকির মুখে পড়েছে। প্রায় প্রতিটি দোকানেই ৬০-৭০ শতাংশ বিক্রি কমেছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ফাউন্ডেশন (এসএমই) এ খাতকে কারোনাকালীন প্রণোদনার তালিকাভুক্ত না করায় এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িতরা সরকার ঘোষিত আর্থিক কোনো ঋণ সুবিধা পাননি।
কিছু কিছু ব্যবসায়ী দোকান ভাড়া, কর্মচারীদের বেতন ও ব্যাংক ঋণ পরিশোধে হিমশিম খেয়ে ছেড়ে দিয়েছেন ব্যবসা।
ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা বলছেন, তাদের ব্যাংক ঋণগুলোর কিস্তি পরিশোধের মেয়াদ আরও পিছিয়ে দেওয়া হোক এবং পাশাপাশি আমদানি শুল্কের পর এ খাতে নতুন করে ৫ শতাংশ ভ্যাট-ট্যাক্স আরোপ বাদ দেওয়া হোক; নয়তো এ ব্যবসায় টিকে থাকা তাদের পক্ষে কঠিন হয়ে যাবে।
ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের একজন আশরাফ আলী। ২০ বছর ধরে পুরান ঢাকার সিদ্দিক বাজারে স্যানিটারি পণ্য, পাইপ ও টিউবওয়েল ব্যবসা করেছেন। এসব পণ্যের ওপর সরকার নতুন করে কর আরোপ করায় ২০১৮ সাল থেকে ব্যবসায় মন্দা যাচ্ছিল তার। সর্বশেষ করোনা মহামারিতে চূড়ান্ত ধস নেমে আসে আশরাফ আলীর ব্যবসায়। ৫ মাস দোকান সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল। দোকান ভাড়া, কমচারীদের বেতন ও ক্ষতি পোষাতে না পেরে শেষ পর্যন্ত ব্যবসা ছাড়তে বাধ্য হন তিনি।
আশরাফ আলী বলেন, 'আমাদের কাস্টমার মূলত খুচরা কাস্টমার, যারা নতুন বাসাবাড়ির কনস্ট্রাশনের কাজ করেন; কিন্তু করোনায় মানুষের হাতে টাকা না থাকায় এখন কনস্ট্রাকশনের কাজ প্রায় বন্ধ, তাই আমাদের কাস্টমার নেই বললেই চলে। বিক্রি না থাকায় দোকান ভাড়া,কর্মচারীর বেতন এবং ব্যাংক ঋণ পরিশোধের কোনো উপায় ছিল না, তাই এ ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছি।'
আশরাফ আলীর মতো আরেক ব্যবসায়ী কামরুল ইসলাম খোকন, যিনি ২৩ বছর ধরে পুরান ঢাকার আলু বাজারে স্যানিটারি পণ্য, পাইপ ও টিউবওয়েল ব্যবসায় জড়িত। তিনি বলেন, 'আগে মাসে যেখানে ২৫-৩০ লাখ টাকা বিক্রি করতাম, এখন সেখানে বিক্রি হয় মাসে মাত্র ৫-৮ লাখ টাকা। আজ সকাল থেকে এখন বিকাল পাচঁটা পর্যন্ত ১২ হাজার টাকার পণ্য বিক্রি করেছি। আমার দোকানে আগে আটজন লোক কাজ করতেন, এখন আছেন মাত্র দুজন। আমি এখন দোকানটি বিক্রি করে দিতে চাচ্ছি; কিন্তু এ অবস্থায় দোকান কেনার মতো কোনো ক্রেতা পাচ্ছি না।'
এ অবস্থা শুধু আশরাফ আলী ও খোকনেই নয়, প্রায় অধিকাংশ ব্যবসায়ীই এসব ক্ষতি পোষাতে পারছেন না।
রাজধানীর পুরান ঢাকার আলু বাজার, নবাবপুর, সিদ্দিক বাজার, হাজী ওসমান গণি রোড এলাকায় প্রায় আড়াই হাজার মতো স্যানিটারি পণ্য, পাইপ ও টিউবওয়েল পণ্যের দোকান রয়েছে। এই দোকানগুলোতে করে খুচরা ও পাইকারি পণ্য বিক্রি করা হয়। পুরান ঢাকার এ দোকানগুলোতে একসময় ছিল অনেক কর্ম ব্যস্ততা, কিন্তু মহামারির প্রভাবে এখন সেখানে প্রায় ক্রেতাশূন্য।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ বাংলাদেশ পাইপ অ্যান্ড টিউবওয়েল মার্চেন্টাইজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মুহাম্মদ রবিউল হক বাদশা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'করোনায় এ ব্যবসা ব্যাপক ক্ষতির শিকার হয়েছে। প্রায় ৭০ শতাংশ ব্যবসায়ীরই রয়েছে ব্যাংক ঋণ। করোনায় অধিকাংশ দোকানের বিক্রি কমেছে প্রায় ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ। প্রায় ২০-৩০ জন ব্যবসায়ী ক্ষতি পোষাতে না পেরে দোকান বিক্রি করে দিয়েছেন।'
তিনি আরও বলেন, 'আগে সরকার এসব পণ্যের ওপর শুধু আমদানি শুল্ক আরোপ করত, কিন্তু ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে নতুন করে প্রত্যেক পণ্য বিক্রির ওপর আবার ৫ শতাংশ ভ্যাট-ট্যাক্স আরোপ করে। এ কারণে অনেক পণ্যের দাম হু হু করে বেড়ে যাওয়ায় ক্রেতা কমে গেছে অনেক।'
'সরকার ঘোষিত ক্ষুদ্র শিল্পের জন্য প্রণোদনার একটি টাকাও আমরা পাইনি। দোকান ভাড়া এবং ব্যাংক ঋণের মাসিক কিস্তি শোধ করতে পারছেন না বেশিরভাগ ব্যবসায়ী। তাই অনেকে দোকান বিক্রি করে ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন,' বলেও জানান রবিউল হক বাদশা।
গত বছরের ৫ এপ্রিল করোনাভাইরাসের অর্থনৈতিক ক্ষতি পোষাতে ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করে সরকার। এরমধ্যে কুটির, ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি খাতের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ফাউন্ডেশন (এসএমইএফ) এই প্রণোদনার অর্থ পাওয়ার তালিকায় রাখেনি স্যানিটারি, পাইপ ও টিউবওয়েল খাতকে।
করোনাকালে সরকার ঘোষিত এ প্রণোদনা বিতরণ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ টিবিএসকে বলেন, 'যারা প্রণোদনার ঋণ পেয়েছেন, এর অধিকাংশই লবিং-তদবিরে। তাছাড়া সরকারের কাছে দেশের সকল শিল্প খাতের সম্ভাবনা বা ক্ষতির সর্বশেষ আপডেট তথ্য নেই। যার কারণে স্যানিটারি, পাইপ ও টিউবওয়েল শিল্পের মতো এ রকম বহু সেক্টরের ক্ষতিগ্রস্তরা এই প্রণোদনার অর্থ পাননি।'
তিনি আরও বলেন, 'সরকারের উচিত দ্বিতীয় পর্বে প্রণোদনা দেওয়ার আগে এ সমস্ত খাতের প্রতি যথাযথ নজর দেওয়া।'
এ ব্যাপারে সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, 'সরকার ঘোষিত আর্থিক প্রণোদনায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা খুব একটা ঋণ সুবিদা পাননি। প্রণোদনায় বড় বড় শিল্পগোষ্ঠীগুলো বেশি লাভবান হয়েছে। নতুন প্রণোদনায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত, তারমধ্যে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এসব শিল্পকে আরও বেশি অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।'
বাংলাদেশ পাইপ ও টিউবওলে মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে প্রায় ১৫ হাজার স্যানিটারি, পাইপ ও টিউবওলের দোকান রয়েছে। শুধু ঢাকার শহরেই রয়েছে পাঁচ হাজারের মতো। এ ব্যবসায় সারা দেশে বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা। বেশির ভাগ দোকান বন্ধ থাকায় পুরো বিনিয়োগই হুমকির মুখে পড়েছে।
সমিতির তথ্যমতে, এ খাতে প্রায় ৫ লাখ লোক জড়িত। করোনায় এদের ৬০ ভাগই চাকরি হারিয়েছেন।
পুরান ঢাকার হাজী ওসমান গণি রোড এলাকায় ১০ বছর ধরে একটি দোকানে কর্মচারী হিসেবে কাজ করেন আনোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, 'এ রকম মন্দা আগে কখনো দেখিনি। মানুষের হাতে টাকা না থাকায় বাসাবাড়ির কাজ করছে। তাই এখন বাজারে ক্রেতা নেই বললেই চলে। আগে এ দোকানে আমরা ৭ জন কর্মচারী কাজ করতাম, বেচা-বিক্রি না হওয়ায় ৫ জনকে চাকরি থেকে বিদায় করে দেওয়া হয়েছে। এখন আমিও আশঙ্কায় আছি, মালিক কখন আমাকেও মানা করে দেন।'
বাংলাদেশ পাইপ ও টিউবওয়েল মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক পারভেজ আলম চুন্নু টিবিএসকে বলেন, 'করনোয় এ ব্যবসা ধসে গেছে। তারপর আমদানি শুল্কের পর অতিরিক্ত নতুন করে আবার ৫ শতাংশ ভ্যাট-ট্যাক্সে এ ব্যবসাকে আরও বেশি ক্রেতাবিমুখ করে দিয়েছে। সরকারের কাছে অনুরোধ, ঘোষিত প্রণোদনা থেকে আমাদের সহায়তা করা হোক, ব্যাংক ঋণগুলোর কিস্তি পরিশোধের মেয়াদ আরও পিছিয়ে দেওয়া হোক। এর পাশাপাশি নতুন ৫ শতাংশ ভ্যাট-ট্যাক্স বাদ দেওয়া হোক।'
এ ব্যাপারে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ফাউন্ডেশনের (এসএমইএফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ মফিজুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আমরা সকল ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাকে যথাযথ নিয়মে প্রণোদনা দেওয়ায় চেষ্টা করেছি। মূলত স্যানিটারি, পাইপ ও টিউবওয়েল শিল্পের উদ্যোক্তাদের কোনো ব্যক্তি ও সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ না থাকার কারণে প্রণোদনা দেওয়া সম্ভব হয়নি। এ রকম আরও কিছু খাত প্রথম পর্বে প্রণোদনা পায়নি।'
তিনি আরও বলেন, 'ইতোমধ্যে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য দ্বিতীয় পর্বে প্রণোদনা হিসেবে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ প্রণোদনা বিতরণের তালিকা আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে চূড়ান্ত করা হবে। এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা যদি তাদের অ্যাসোসিয়েশনের মাধ্যমে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, তাহলে দ্বিতীয় পর্বে প্রণোদনায় এ খাতকে গুরুত্বের সঙ্গে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে।'