ভ্রমণকারী বৃদ্ধি পাওয়ায় সম্প্রসারণ পরিকল্পনায় যাচ্ছে স্থানীয় এয়ারলাইনগুলো
এয়ারলাইনগুলোর জন্য ২০১৯ সালের পরিস্থিতি ফিরে এসেছে বলে মনে হচ্ছে।
প্রত্যাশার চেয়েও বেড়েছে মানুষের ভ্রমণ। এতে ফের লাভের মুখ দেখছে এয়ারলাইনগুলো। বছরের বাকি সময়ও এমন সুসময় অব্যাহত থাকবে বলে মনে হচ্ছে। এতে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছে কোভিডের কারণে সম্প্রসারণ পরিকল্পনা দু-বছরের জন্য হিমঘরে পাঠিয়ে দিতে বাধ্য হওয়া স্থানীয় এয়ারলাইনগুলোও।
২০২২ সালের শেষ দিকে দেশীয় বেসরকারি এয়ারলাইনস ইউএস-বাংলা, নভোএয়ার ও এয়ার-অ্যাস্ট্রা তাদের বহরে ১৩টি বিমান যুক্ত করার পরিকল্পনা করছে। নতুন যুক্ত হতে যাওয়া বিমানগুলোর মধ্যে এয়ারবাস ৩৩০, ড্যাশ ৩০০ ও এয়ারবাস ৯০০ রয়েছে। এই এয়ারলাইনগুলোর বহরে এখন বিমানের সংখ্যা ২২।
কর্মকর্তারা জানান, আগামী বছর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল উদ্বোধন ও সারা বাংলাদেশের উন্নত বিমান অবকাঠামোই এই সম্প্রসারণ পদক্ষেপকে উৎসাহ জুগিয়েছে।
ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ক্যাপ্টেন লুৎফর রহমানের তথ্যানুসারে, বর্তমানে বেসরকারি এয়ারলাইনগুলো প্রতিদিন ৫ হাজার যাত্রী পরিবহন করে। আগামী বছর দৈনিক বিমানযাত্রীর সংখ্যা হবে ৭ হাজার।
'এর মধ্যে বড় একটা অংশ আন্তর্জাতিক যাত্রী। তাই আমরা শারজাহ ও সিঙ্গাপুর রুটে আরও বেশিসংখ্যক ফ্লাইট পরিচালনা করতে যাচ্ছি,' দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন তিনি।
ইউএস-বাংলার সিইও বলেন, বর্তমান ১১টি আন্তর্জাতিক রুটের পাশাপাশি আগামী শীতে তারা ঢাকা-দিল্লি রুট চালু করবেন। নতুন বিমান বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান জনশক্তি রপ্তানি কেন্দ্র উপসাগরীয় দেশগুলোতে তাদের সক্ষমতা বাড়াবে।
সূত্রমতে, ২০২৩ সালের প্রথম প্রান্তিকে ইউএস-বাংলা, নভোএয়ার ও এয়ার-অ্যাস্ট্রার মোট বিমানের সংখ্যা হবে ৩০টি এবং দ্বিতীয় প্রান্তিকে এ সংখ্যা হবে ৩৩টি।
নভোএয়ার এখন অভ্যন্তরীণ রুটে এবং আন্তর্জাতিক রুটে শুধু ঢাকা-কলকাতা রুটে চলাচল করে। সম্প্রতি এই এয়ারলাইন এয়ারবাসের কাছ থেকে ন্যারোবডি জেট এয়ারলাইনার এয়ারবাস ৩২০ কেনার আগ্রহ প্রকাশ করে। সূত্রমতে, নভোএয়ারও সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিয়েছে।
আরেক স্থানীয় বিমান চলাচল কোম্পানি এয়ার-অ্যাস্ট্রা বলছে, অভ্যন্তরীণ রুটে প্রাথমিক কার্যক্রম শুরু করার জন্য চলতি বছরের নভেম্বরের মধ্যে তাদের বহরে চারটি বিমান যুক্ত করা হবে।
এয়ার-অ্যাস্ট্রার সিইও ইমরান আসিফ টিবিএসকে বলেন, 'এ বছর চারটি বিমান পেলে আমরা বরিশাল ছাড়া সবগুলো অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করব।'
তারা ঢাকা বিমানবন্দরে একটি হ্যাঙ্গারের পাওয়ার চেষ্টা করবেন বলে জানান তিনি। তা না পেলে বিমান পার্কিংয়ের জন্য তারা সিলেট বিমানবন্দর ব্যবহার করবেন।
বৈরী সময়
মহামারির পর থেকেই এয়ারলাইনগুলো মারাত্মক শ্রমিক সংকটে ভুগছে। সেইসঙ্গে জ্বালানির দামও বেড়ে গেছে। বৈশ্বিক অর্থনীতিও এখন টালমাটাল। তা সত্ত্বেও সমস্ত অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করে বিমান চলাচলের সম্ভাবনা উজ্জ্বল।
সেপ্টেম্বরে ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশন (আইএটিএ) পূর্বাভাস দিয়েছে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি ধীর হলেও ২০২৪ সালে বিশ্বব্যাপী বিমানে ভ্রমণের হার সামগ্রিকভাবে ২০১৯ সালের পর্যায়ে ফিরে আসার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে।
এয়ারপোর্টস কাউন্সিল ইন্টারন্যাশনাল (এসিআই) ওয়ার্ল্ডও বলেছে, ২০২৪ সাল নাগাদ বিমান চলাচল খাতের সম্পূর্ণ পুনরুদ্ধার সম্পন্ন হবে।
এর আগে জুনে আইএটিএ বলেছিল, ২০২২ সালে এয়ার কার্গোর পরিমাণ রেকর্ড ৬৮.৪ মিলিয়ন টনে পৌঁছবে বলে আশা করা হচ্ছে।
সংস্থাটি বলেছে, এয়ারলাইনগুলো ব্যাপক দেউলিয়াত্ব ও ব্যর্থতার ভবিষ্যদ্বাণীকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আরও দৃঢ় ও দক্ষ হয়ে উঠেছে।
নভোএয়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মফিজুর রহমান টিবিএসকে বলেন, 'গত বছর জেট ফুয়েলের দাম ছিল লিটারপ্রতি ৬৪.৫০ টাকা। সেটি এখন ১০১.৭৫ টাকা।'
জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির জেরে তারা সমস্ত অভ্যন্তরীণ রুটে বিমান ভাড়া বাড়াতে বাধ্য হয়েছেন বলে জানান তিনি।
সাধারণত এয়ারলাইনের মোট ব্যয়ের ৩৩ শতাংশ যায় জ্বালানির পেছনে। কিন্তু গত এক বছর ধরে স্থানীয় বিমান চলাচল খাতে জ্বালানির পেছনেই মোট ব্যয়ের ৫০ শতাংশ গেছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
এভিয়েশন অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের মহাসচিব মফিজুর রহমান ইঙ্গিত দেন, বর্তমান কর কাঠামোও তাদের ওপর বোঝা হয়ে চেপে বসেছে।
'সরকার বিমানের খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানিতে চলতি অর্থবছরে ১৫ শতাংশ ভ্যাট বসিয়েছে। তাছাড়া বিমান আমদানিতে ৫ শতাংশ কাস্টম ডিউটি, ৫ শতাংশ অগ্রিম কর এবং যন্ত্রাংশের জন্য ৫ শতাংশ অগ্রিম আয়কর ও ইঞ্জিনের জন্য ৫ শতাংশ অগ্রিম কর দিতে হয়। কিন্তু ভারত, সিঙ্গাপুর বা মালয়েশিয়ায় এ ধরনের কোনো শুল্ক বা কর নেই,' বলেন তিনি।
তৃতীয় টার্মিনাল চালুর অপেক্ষা
আগামী বছরের অক্টোবরে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের কাজ শেষ হবে। এরপর বিমানবন্দরের বার্ষিক যাত্রী ও কার্গো হ্যান্ডলিং সক্ষমতা তিনগুণ বাড়বে বলে জানিয়েছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)।
বর্তমানে ঢাকা বিমানবন্দর বছরে ৭০-৮০ লাখ যাত্রী হ্যান্ডল করতে পারে। তৃতীয় টার্মিনাল চালু হওয়ার পর বিমানবন্দরটি প্রতি বছর প্রায় ২ কোটি ২০ লাখ যাত্রীকে সেবা দিতে পারবে।
এছাড়া তৃতীয় টার্মিনাল চালু হওয়ার পর ঢাকা বিমানবন্দর ৫ লাখ টন কার্গো হ্যান্ডল করতে পারবে। বর্তমানে বিমানবন্দরটির কার্গো হ্যান্ডল করার সক্ষমতা ২ লাখ টন।
বর্তমানে ২৮টি বিদেশি এয়ারলাইন বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনা করছে। সেগুলোর মধ্যে কাতার এয়ারওয়েজ, এমিরেটস, সৌদি এয়ারলাইন্স, ফ্লাইদুবাই ও এয়ার অ্যারাবিয়া এ বাজারে আধিপত্য ধরে রেখেছে।
বিমান চলাচল সূত্র জানিয়েছে, স্থানীয় কোম্পানিগুলোর পাশাপাশি বিদেশি এয়ারলাইনগুলোও ফ্লাইটের সংখ্যা বাড়াতে চায়। কিন্তু স্থান সংকুলানের সমস্যায় বিমান কর্তৃপক্ষ তাদের অনুমোদন দিচ্ছে না।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ ও ভ্রমণ ম্যাগাজিন 'বাংলাদেশ মনিটর'-এর সম্পাদক কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, 'কাতার এয়ারওয়েজ আগে প্রতিদিন তিনটি ফ্লাইট পরিচালনা করত, এখন তারা প্রতিদিন চারটি পর্যন্ত ফ্লাইট পরিচালনা করে। আমি যতদূর জানি, এমিরেটস ও ইন্ডিগোসহ অনেক এয়ারলাইনই তাদের ফ্লাইট ফ্রিকোয়েন্সি বাড়াতে এবং রুট সম্প্রসারণ করতে চায়। অনুমতি পেলেই তারা তা করবে।'
ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে চায় জাতীয় পতাকাবাহী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসও। বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাহিদ হোসেন টিবিএসকে বলেছেন, নিজেদের পরিকল্পনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানাতে এক সপ্তাহের মধ্যে একটি সংবাদ সম্মেলন করবেন তারা।
দায়িত্ব গ্রহণের পর গত আগস্টে এক সংবাদ সম্মেলনে জাহিদ হোসেন বলেন, তারা বিমানের বিদ্যমান ২১টি এয়ারক্রাফটের বহরের সর্বোত্তম ব্যবহার করবেন।
সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেন, 'বিমান যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন নতুন গন্তব্যে রুট সম্প্রসারণ করবে। বিভিন্ন লাভজনক রুটে ফ্লাইটের সংখ্যাও বাড়াব আমরা।'
বর্তমানে বিমানের বার্ষিক টার্নওভার ৭০০ মিলিয়ন ডলার; নতুন এমডি একে ১ বিলিয়ন ডলারে নিয়ে যেতে চান।
দ্রুত বর্ধনশীল হেলিকপ্টার বাজার
ক্রমবর্ধমান এবং দ্রুত পরিবর্তনশীল অর্থনৈতিক ও ব্যবসায়িক পরিবেশের সুবাদে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হেলিকপ্টার ভাড়া করার চাহিদা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। ব্যবসা, চিত্তবিনোদন ও জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজনে আগের চেয়ে অনেক বেশি লোক হেলিকপ্টারে ভ্রমণ করছেন।
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, বর্তমানে নয়টি প্রতিষ্ঠান ৩২টি হেলিকপ্টার নিয়ে হেলিকপ্টার সেবা দিচ্ছে। আরও একটি কোম্পানি বাজারে আসার অপেক্ষায় আছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এ বাজার ক্রমেই বড় হচ্ছে।
বর্তমানে হেলিকপ্টার পরিচালনাকারী কোম্পানিগুলো হলো—স্কয়ার এয়ার, সাউথ এশিয়ান এভিয়েশন, মেঘনা এভিয়েশন, বিআরবি এয়ার, এটিএল এভিয়েশন, পারটেক্স এভিয়েশন, আরঅ্যান্ডআর এভিয়েশন, বাংলা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনস, বসুন্ধরা এয়ারওয়েজ ও বিসিএল এভিয়েশন।
চার্টার্ড এয়ারলাইন সাউথ এশিয়ান এয়ারলাইনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্যাপ্টেন মো. গুলজার বলেন, '২০০৫ সালেও মাত্র তিনটি হেলিকপ্টার ভাড়া দেওয়া হতো।' এ খাতে প্রতি বছর গড়ে পাঁচটি হেলিকপ্টার যোগ হয়েছে বলে জানান তিনি।
প্রতি মাসের ফ্লাইটসংখ্যা এখন ৩৫০। ২০৩০ সালে প্রতি মাসে ফ্লাইট সংখ্যা ৬০০-র বেশি হবে বলে পূর্বাভাস দেন ক্যাপ্টেন মো. গুলজার।