চলতি মাসেই বৃহৎ পরিসরে উৎপাদনে যাবে অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো
চলতি মাসেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর সহ ৫টি অর্থনৈতিক অঞ্চলে ১৪টি শিল্প-কারখানার বাণিজ্যিক উদ্বোধন করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যেখানে বিনিয়োগ হয়েছে ৮৭৫ মিলিয়ন ডলারের ওপর। এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থান হয়েছে ৪,৮৭১ জনের।
বেজা ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানগুলো মোট বিনিয়োগ প্রস্তাব দিয়েছে ১,২০৪ মিলিয়ন ডলারের; ১৪টি কারখানায় পর্যায়ক্রমে কর্মসংস্থান হবে ৯,২৫৬ জনের।
একই সময় ৯টি অর্থনৈতিক অঞ্চলে নির্মাণাধীন ২৯টি শিল্প-কারখানার ভিক্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন প্রধানমন্ত্রী। যেখানে বিনিয়োগ প্রস্তাব দেয়া হয়েছে ২,৫৩২ মিলিয়ন ডলারের। ইতোমধ্যেই প্রতিষ্ঠাগুলো ৬১০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। প্রতিষ্ঠানগুলো পুরোপুরি উৎপাদনে গেলে কর্মসংস্থান হবে ২৭,৬০৯ জনের।
বিনিয়োগের সব সুযোগ দিয়ে একটি অঞ্চলে পরিকল্পিত শিল্পায়ন করে দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) ২০১০ সালে যাত্রা শুরু করে। ২০১৪ সালে শুরু হয় অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার মূল কাজ। এরপর একসঙ্গে এতগুলো উৎপাদনে যাওয়া শিল্প-কারখানা সহ অন্যান্য অবকাঠামো উদ্বোধন এবারই প্রথম।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) নির্বাহী চেয়ারম্যান শেখ ইউসুফ হারুন টিবিএসকে বলেন, "আগামী ২৬ অক্টোবর সময় দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। আটটি ভেনুতে আমাদের অনুষ্ঠান হবে। শিল্প এবং অবকাঠামোসহ সব মিলে ৫৩টি অবকাঠামো উদ্বোধন হবে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছি আমরা।"
এর মধ্যে দুটি নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চলও রয়েছে বলে তিনি জানান। এগুলো হলো- কুমিল্লা অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং পূর্বগাঁও অর্থনৈতিক অঞ্চল।
শেখ ইউসুফ হারুন বলেন, "বিনিয়োগকারীদের ওয়ান স্টপ সেবা দেয় বেজা। বিনিয়োগকারীদের থেকে আমরা প্রচুর সাড়া পাচ্ছি। অর্থনৈতিক অঞ্চলে যে পরিমাণে জমি আছে তার চেয়ে বিনিয়োগকারীর চাহিদা বেশি। এজন্য দ্রুত সময়ের মধ্যে আরও কিছু অর্থনৈতিক অঞ্চল ডেভেলপ করছি। অর্থনৈতিক অঞ্চলে ইউটিলিটি কানেকশন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, নেটওয়ার্কিং এগুলো আমরা করে দেই।"
চট্টগ্রামের মিরসরাই ও সীতাকুণ্ড উপজেলা এবং ফেনীর সোনাগাজী উপজেলায় ৩০ হাজার একর জমিতে নির্মিত হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ অর্থনৈতিক অঞ্চল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর।
যে ১৪টি শিল্প-কারখানার বাণিজ্যিক উদ্বোধন হচ্ছে এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরের ৪টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
এই ১৪টির মধ্যে একটি হলো ম্যাকডোনাল্ড স্টিল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, যারা প্রি-ফেব্রিকেটেড স্ট্রাকচারাল স্টিল তৈরি করে, যা স্টিল ব্রিজ এবং স্টিলের উঁচু ভবন, কারখানা ও পাওয়ার প্ল্যান্টে ব্যবহৃত হয়।
নিপ্পন এবং ম্যাকডোনাল্ড স্টিল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড আমদানি করা ইস্পাত, পুরলিন, স্লিটিং শীট এবং কয়েল থেকে এমএস প্লেট উৎপাদন করে।
এছাড়াও এশিয়ান পেইন্টস বাংলাদেশ লিমিটেড অর্থনৈতিক অঞ্চলে ৩৪ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে।
এশিয়ান পেইন্টস গ্লোবাল ইন্টারন্যাশনালের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা প্রজ্ঞান কুমার বলেন, "আমরা আধুনিক কারখানা করেছি। ইতোমধ্যেই সেখানে পণ্য উৎপাদন শুরু হয়েছে।"
এদিকে পিএইচসি পাইলের প্রস্তুতকারক সমুদা কনস্ট্রাকশন লিমিটেড ৪ একর জমিতে কারখানা গড়ে তুলেছে। সেখানে বিনিয়োগ হয়েছে ৮.২ মিলিয়ন ডলার।
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চল মেঘনা ইকোনমিক জোনে মেঘনা পিভিসি, সোনারগাঁ সোলার এনার্জি লিমিটেডের দুটি কারখানা উদ্বোধন করা হবে।
একই এলাকায় মেঘনা গ্রুপের আরও একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল, মেঘনা শিল্প অর্থনৈতিক অঞ্চলে ৫টি কারখানার বাণিজ্যিক উদ্বোধন হবে। এগুলো হলো- মেঘনা ফয়েল প্যাকেজিং লিমিটেড, মেঘনা বাল্ক ব্যাগ লিমিটেড, সাকাতা ইনক্স (বাংলাদেশ) প্রাইভেট লিমিটেড, সিগওয়ার্ক বাংলাদেশ লিমিটেড, টিআইসি ইন্ডাস্ট্রিজ বাংলাদেশ পিটিওয়াই লিমিটেড।
২৫ একর জায়গায় মেঘনা পিভিসি লিমিটেড কারখানা করেছে। এখানে প্লাস্টিক কাঁচামাল, পলিভিনাইল ক্লোরাইড (পিভিসি) রেজিন এবং পলিথিন টেরেফথালেট (পিইটি) উৎপাদন হচ্ছে।
মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের সিনিয়র ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার সুমন ভৌমিক টিবিএসকে বলেন, "আমরা গত মার্চ পর্যন্ত ২৯৩ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছি। এখন পণ্য উৎপাদন হচ্ছে। কর্মসংস্থান হয়েছে ১৯০০ জনের। প্রতিষ্ঠানের জন্য কিছু মেশিন আমদানি করা হয়েছে সেখানে বিনিয়োগ হয়েছে। সব মিলিয়ে এ প্রকল্পে খরচ হবে ৪০০ মিলিয়ন ডলার।"
তিনি জানান, দেশে প্লাস্টিকের কাঁচামালের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে, যা একটা সময় সম্পূর্ণভাবে আমদানির ওপর নির্ভরশীল ছিল।
"দেশে পিইটি রেজিনের চাহিদা বার্ষিক দুই লাখ টন, যেখানে আমাদের উৎপাদন ক্ষমতা এক লাখ টন। পিভিসি রেজিনের চাহিদা বছরে চার লাখ টনের বেশি, অন্যদিকে আমাদের উৎপাদন সক্ষমতা ১.৫ লাখ টন", যোগ করেন তিনি।
মেঘনা গ্রুপের আরেকটি কোম্পানি সোনারগাঁও সোলার এনার্জি লিমিটেড ৬ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ এবং ১৪.০৭ মেগাওয়াট উৎপাদন সক্ষমতা নিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে।
অস্ট্রেলিয়ান কোম্পানি টিআইসি ইন্ডাস্ট্রিজ বাংলাদেশ পিটিওয়াই লিমিটেড প্লাস্টিকের পোশাকের হ্যাঙ্গার, সাইজার এবং আনুষাঙ্গিক তৈরি করছে, এছাড়াও জার্মান সিগওয়ার্ক বাংলাদেশ লিমিটেড ছাপার কালি (প্রিন্টিং ইঙ্ক) তৈরি করছে।
সিটি গ্রুপের দুটি কোম্পানি- সিটি সিড ক্রাশিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড (ইউনিট-২) এবং সিটি পলিমারস লিমিটেড- নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার উত্তর রূপসী, গন্ধবপুর, চর গন্ধবপুর এবং নয়াগাঁও মৌজায় সিটি ইকোনমিক জোনে কাজ করছে।
৩৯৭ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগে সিটি সিড ক্রাশিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড (ইউনিট-২) সয়া কেক, রেপ সিড কেক এবং ক্রুড এডিবল অয়েল প্রস্তুত করছে।
মৌলভীবাজারের শ্রীহট্ট অর্থনৈতিক অঞ্চলে ডাবল গ্লেজিং লিমিটেড শব্দ হ্রাসকারী এবং শক্তি সাশ্রয়ী ইউপিভিসি দরজা ও জানালা তৈরি করছে বলে জানিয়েছেন কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মইনুল ইসলাম।
যে ২৯টি কোম্পানি ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবে তাদের একটি বসুন্ধরা মাল্টি স্টিল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড; ইতিমধ্যেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে তারা ৪৬৫ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। কোম্পানিটি রেবার, ওয়্যার রড, এলআরপিসি এবং ওয়েল্ডিং ইলেকট্রোড (মিগ অ্যান্ড স্টিক) উৎপাদন করবে।
বসুন্ধরা গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক (মার্কেটিং অ্যান্ড বিজনেস ডেভেলপমেন্ট) তৌফিক হাসান বলেন, "ইতিমধ্যে নির্মাণ কাজ শুরু করেছি। আমরা একটি দ্বিস্তরী ইস্পাত উৎপাদন কারখানা নির্মাণ করব।"
শিল্প, কর্মসংস্থান, উৎপাদন ও রপ্তানি বৃদ্ধি ও বহুমুখীকরণের মাধ্যমে দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নকে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে দেশের অনগ্রসর ও অনুন্নত অঞ্চলসহ সম্ভাব্য সকল এলাকায় অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য বেজার।
পরিকল্পিত ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের মধ্যে সরকার ৯৭টি অর্থনৈতিক অঞ্চল অনুমোদন করেছে, যার মধ্যে ২৮টি বর্তমানে উন্নয়নাধীন।
এখন পর্যন্ত ১২টি ব্যক্তিগত মালিকানাধীন অর্থনৈতিক অঞ্চল তাদের কার্যক্রম পরিচালনার লাইসেন্স পেয়েছে এবং এই অঞ্চলগুলিতে প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা হয়েছে।
এর লক্ষ্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ১ কোটি মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি। অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর মাধ্যমে বার্ষিক ৪০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য উৎপাদন এবং রপ্তানি করার প্রত্যাশা রয়েছে।
বিনিয়োগকারীরা অর্থনৈতিক অঞ্চলে কর অবকাশ, শুল্কমুক্ত কাঁচামাল এবং যন্ত্রপাতি আমদানি করতে পারবেন।