৭২ বিলিয়ন ডলারের উচ্চ রপ্তানি লক্ষ্য অর্জনে জ্বালানি ও ডলার সংকটের সমাধান দরকার: বলছেন ব্যবসায়ীরা
৭২ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রাকে 'উচ্চাভিলাষী' বলে বর্ণনা করেছেন ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা। একইসঙ্গে তাদের আশঙ্কা যে, গ্যাস-বিদ্যুৎ ও ডলার সংকট দূর নাহলে – সদ্যসমাপ্ত অর্থবছরের চেয়েও চেয়েও রপ্তানি কমে যাবে।
তারা বলেছেন, ডলার সংকটের কারণে যদি এলসি খোলা না যায়, এবং গ্যাস-বিদ্যুতের অভাবে যদি সক্ষমতা অনুযায়ী শিল্প-কারখানা সচল রাখা না যায়, তাহলে গত অর্থবছরের রপ্তানির তুলনায় ১১ শতাংশের বেশি লক্ষ্যমাত্রা কীভাবে অর্জন হবে?
এছাড়া, আগামী নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক অনিয়শ্চতা সৃষ্টি না হওয়া এবং রাজনৈতিক কর্মসূচিকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে রাখার ওপর জোর দেওয়ার পাশাপাশি নতুন বা অপ্রচলিত বাজারে (নন-ট্রাডিশনাল মার্কেট) রপ্তানি বাড়ানোর জোর দেওয়ার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও শীর্ষ ব্যবসায়ীরা।
বুধবার (১২ জুলাই) সচিবালয়ে রপ্তানিকারকদের সঙ্গে সভা-শেষে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৭২ বিলিয়ন ডলার রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। এরমধ্যে পণ্য রপ্তানি থেকে ৬২ বিলিয়ন এবং সেবা রপ্তানি থেকে ১০ বিলিয়ন ডলার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
ব্যবসায়ীরা বলেছেন, বাংলাদেশের প্রধান পণ্য তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে থেকে আয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, তা অর্জন করতে হলে অন্যান্য রপ্তানিকারক দেশগুলো থেকে ২০-২৫ শতাংশ রপ্তানি অর্ডার বাংলাদেশকে আনতে হবে। ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে, যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপে চীনের রপ্তানি কমায় সরবরাহের যে ঘাটতি তৈরি হচ্ছে, তা পূরণ করার সুযোগ বাংলাদেশের সামনে রয়েছে।
কিন্তু, গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটের কারণে যদি শিল্প-কারখানাই অচল থাকে এবং ডলারের অভাবে যদি প্রয়োজনীয় পণ্য বা কাঁচামাল আমদানি ব্যাহত হয়, তাহলে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে সৃষ্ট সুযোগ কাজে লাগাতে ব্যর্থ হবেন রপ্তানিকারকরা। তাই এসব সংকট সমাধানে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ করেন তারা।
রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সরকারের দেওয়া নগদ সহায়তা প্রাপ্তি সহজ করা, কাস্টমস ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের ওপর গুরুত্ব দেন তারা।
ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (এফবিসিসিআই)- এর সভাপতি মো. জসিমউদ্দিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত হলে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন খুবই সহজ হবে। 'গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটই এখন আমাদের মাথাব্যথার বড় কারণ'।
তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায়, বাংলাদেশের প্রধান বাজারগুলোতে রপ্তানি কমে যাচ্ছে। এই সময়ে ভারত, চীন, জাপানসহ নন-ট্রাডিশনাল মার্কেটে রপ্তানি বাড়াতে জোর দিতে হবে। এছাড়া, যেসব দেশে রপ্তানি বৃদ্ধির সুযোগ রয়েছে, সেখানে বাংলাদেশের সেরা মানের পণ্য নিয়ে আন্তর্জাতিক মানের প্রদর্শনী করতে হবে।
ব্যবসায়ীদের আশঙ্কাগুলোর সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট দূর করার পাশাপাশি- রপ্তানিতে নগদ প্রণোদনা অব্যাহত রাখার ওপর জোর দিয়েছেন তিনি।
সভা-শেষে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, 'আমরা জানি, দেশে জ্বালানি সরবরাহে সংকট রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারও অস্থির। আমরা যদি এই সমস্যাগুলো সমন্বিত আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে পারি; যদি ম্যানমেইড ফাইবারের মতো সম্ভাবনাময় খাতে ব্যবসায়ীদের প্রণোদনা দিতে পারি এবং একইসঙ্গে অন্যান্য রপ্তানি খাতে বিদ্যমান প্রণোদনা অব্যাহত রাখতে পারি – তাহলে এই উচ্চাভিলাষী রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হবে'।
মন্ত্রী বলেন, আন্তর্জাতিক রপ্তানি বাজারে আমাদের সম্ভাবনাও বাড়ছে। চীন থেকে অনেক শিল্প বাংলাদেশে স্থানান্তরিত হচ্ছে, ভিয়েতনাম থেকেও আসছে। 'আমাদের রপ্তানিকারক, উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের সাহসী চ্যালেঞ্জ নিতে প্রস্তুত'।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়ও ব্যবসা-বাণিজ্য পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকবে উল্লেখ করে টিপু মুনশি বলেন, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশে কোন কিছুই বন্ধ থাকবে না। অফিস-আদালত, ব্যাংক, বিমা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান স্বাভাবিকভাবেই চলবে।
অতএব, নির্বাচনী বছরের কারণে রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কোনো বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা নেই বলে মন্তব্য করেন তিনি।
পণ্য ও সেবা মিলিয়ে গত অর্থবছরে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫৮ বিলিয়ন ডলার। এর বিপরীতে, আয় হয়েছে ৫৫.৫৬ বিলিয়ন ডলার। চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা গতবারের তুলনায় ১১.৫৯ শতাংশ বেশি।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সভায় অংশ নেওয়া বাংলাদেশ টেক্সটাইলস মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ)-র সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন টিবিএসকে বলেন, জ্বালানি ও ডলার সংকটের সমাধান না করলে, এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা যাবে না। 'ডলার সংকটের কারণে যদি এলসি খোলা না যায়, গ্যাস সংকটের কারণে যদি শিল্প চালানো না যায়, তাহলে কীভাবে এ লক্ষ্য অর্জন হবে?'
সভায় অংশগ্রহণকারী আরেক ব্যবসায়ী নেতা – বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ)-র পরিচালক আসিফ আশরাফ বলেন, বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতায় এটি উচ্চাভিলাষী।
টিবিএসকে তিনি বলেন 'বৈশ্বিক অ্যাপারেল বাজার সংকুচিত হচ্ছে। অন্যদিকে আমাদের যে লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছে, তাতে অন্যান্য রপ্তানিকারক দেশগুলো থেকে আমাদের ২০ থেকে ২৫ শতাংশ ব্যবসা আনতে হবে। বর্তমান বাস্তবতায়, এটি সহজ কোন কাজ নয়' - টিবিএসকে ।
'দেশে গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট আছে। কাস্টমস ও বন্দরের সমস্যাও আছে। এসব সমাধান করে কনডিউসিভ এনভায়রনমেন্ট (সহায়ক পরিবেশ) নিশ্চিত করা নাহলে- রপ্তানির এই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়'- জানান তিনি।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ)-র নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেমও ছিলেন সভায়। তিনি বলেন, সরকার যে টার্গেট করেছে, তার চেয়েও বেশি রপ্তানি করা সম্ভব। "তবে কিছু 'কিন্তু ও যদি' আছে। সেগুলোর সমাধান নাহলে- চলতি অর্থবছরের রপ্তানি গতবারের চেয়েও ১০ শতাংশ কমে যাবে।"
মোহাম্মদ হাতেম বলেন, রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করার ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় হলো গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকট। সরকার নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ করার কথা বলে, গ্যাসের দাম ১৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা নির্ধারণ করেছে। 'কিন্তু, নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে না। গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা না গেলে, শিল্পের উৎপাদন কমে যাবে, রপ্তানিও কমবে'।
তিনি বলেন, নগদ সহায়তা ছাড় করার পদ্ধতি সহজ করতে হবে। যে পরিমাণ রপ্তানি আয় সরাসরি প্রত্যাবাসিত হবে, তার ওপর নগদ সহায়তা দিতে হবে। 'রপ্তানি পণ্যের উপর কোন ভ্যাট না থাকলেও, রাজস্ব বোর্ডের ভ্যাট কর্মকর্তাদের অত্যাচারে রপ্তানিকারকরা অতিষ্ঠ। এই হয়রানি বন্ধ করতে হবে'।
হাতেম বলেন, সামান্য এইচএস কোডের ভুলের কারণে কাস্টমসে আমদানি পণ্য দু-তিন মাস আটকে থাকে। বন্দরে ক্ষতিপূরণ দিতে হয়। এতে ব্যবসায়ীদের ক্ষতি হচ্ছে। এ ধরনের পরিস্থিতি পরিবর্তন দরকার।
আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানি বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে জানিয়ে হাতেম বলেন, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোতে চীনের রপ্তানি কমে যাওয়ায় সরবরাহের দিকে যে ঘাটতি তৈরি হচ্ছে, যা পূরণ করার মতো কেউ নেই। 'ফলে রপ্তানি অর্ডার বাড়বে। এই সময়ে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুৎ ও অন্যান্য সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে- লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় বেশি রপ্তানি করা সম্ভব হবে'।
বিগত দুই অর্থবছরের রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা এবং প্রকৃত রপ্তানি আয়সহ সাম্প্রতিক অর্থবছরে রপ্তানি খাতে অর্জিত প্রবৃদ্ধির গতিধারা; পণ্য ও বাজার সম্প্রসারণ এবং বহুমুখীকরণে সরকারের দেওয়া নগদ সহায়তা ও নীতি সহায়তা; বিশ্ববাণিজ্যের সাম্প্রতিক গতিধারা এবং দেশীয় ও বৈশ্বিক অর্থনীতিতে ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব বিশ্লেষণ করে– নতুন এই লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, এবছরের শেষদিকে দক্ষিণ এশিয়ার বেশিরভাগ অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি ঘটবে বলে বিভিন্ন সংস্থা পূর্বাভাস দিয়েছে। এই পূর্বাভাস ঠিক থাকলে- এ সময়ে বাংলাদেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৬.৮ শতাংশ।
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বাণিজ্য সংস্থা এখন পর্যন্ত যেসব পূর্বাভাস দিচ্ছে, তা বিবেচনায় নিলে চলমান বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দাভাব বছরের শেষ দিকে কাটতে শুরু করবে এবং আগামী বছর বিশ্ব অর্থনীতি পুনরায় প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরবে। ফলে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি বাজারগুলোতে ক্রেতাদের চাহিদা বাড়বে বলেও আশাপ্রকাশ করেন মন্ত্রী।
তবে চলমান বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায়, রপ্তানিতে ১১ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি আশা করা কিছুটা উচ্চাভিলাষী বলে মনে করছেন গবেষণা সংস্থা- রিসার্চ এন্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট' এর চেয়ারম্যান ড. এম এ রাজ্জাক।
তিনি বলেন, উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা খারাপ নয়। 'তবে এটি অর্জন নির্ভর করবে ডলার সংকট কাটিয়ে ওঠার ওপর। ডলার সংকট দূর হলে- গ্যাস-বিদ্যুৎ পরিস্থিতিরও উন্নতি হবে'।
এই অর্থনীতিবিদের মতে, বিশ্ব অর্থনীতি প্রত্যাশার চেয়ে অনেক ধীরগতিতে পুনরুদ্ধার হচ্ছে। এছাড়া, আগামী নির্বাচন ঘিরে বাংলাদেশে যাতে লম্বা সময় রাজনৈতিক অস্থিরতা যাতে নাহয়, সেদিকে গুরুত্ব দিতে হবে।