যে কারণে নতুন ৩টি গার্মেন্টস কারখানায় বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এল নোমান গ্রুপ
একের পর এক ব্যবসার প্রসার ঘটাতে থাকা নোমান গ্রুপ নতুন করে ৩টি তৈরি পোশাক শিল্প কারখানায় বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিলেও, সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে। বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান নোমান গ্রুপের বর্তমানে ৩২টি কারখানা রয়েছে, প্রায় ৮০ হাজার শ্রমিক কাজ করেন এসব কারখানায়।
নতুন বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার মূল কারণ হিসেবে জ্বালানির দাম বৃদ্ধি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরবর্তী প্রভাব ছাড়াও স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক কিছু কারণকে দায়ী করেছেন নোমান গ্রুপের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম।
গত বুধবার রাতে গুলশানে নিজ বাসভবনে তিনি কথা বলেছেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে।
নুরুল ইসলাম বলেন, "ইচ্ছা ছিল নতুন করে ৩টি গার্মেন্টস কারখানা করবো, যেখানে ১৫০০০ শ্রমিকের কর্মসংস্থান হতে পারতো। কিন্তু পরে এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছি। এখন কোন বিনিয়োগ করবো না।"
"আগে মাসে আমাদের প্রতিষ্ঠানের (গ্রুপের সব প্রতিষ্ঠান) গ্যাসের বিল দিতে হতো ৩৫ থেকে ৪০ কোটি টাকা, মূল্য বাড়ানোর পর এখন দিতে হচ্ছে ১২০ কোটি টাকা। অর্থাৎ ৮০ কোটি টাকা বাড়তি দিতে হচ্ছে," বলেন তিনি।
তিনি আরো বলেন, "প্রতিযোগী দেশগুলোর গ্যাসের মূল্য বাড়েনি। আবার তাদের নিজস্ব কটন ও ডাইস কেমিক্যাল আছে। ইউরোপে রপ্তানির ক্ষেত্রে লিড টাইমে আমাদের চেয়ে এগিয়ে। এসব কারণে আমরা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে যাচ্ছি।
এর সঙ্গে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে চাহিদা কমে যাওয়ায় এর চাপ রপ্তানিকারকদের উপর পড়ছে জানিয়ে তিনি বলেন, "সেখানে চাহিদা কমে গেছে। আমাদের প্রতি কেজি ইয়ার্ন উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে ০.৪০ ডলার। অথচ তারা বাড়তি দাম দিচ্ছে না।"
"কারণ তারা চীন, ভারত, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়ায় আমাদের চেয়ে কম দামে পাচ্ছে। ফলে আমরা দাম বাড়াতে পারছি না," বলেন তিনি।
আগে গড়ে ৩ শতাংশ মুনাফা থাকত, এখন ৩ থেকে ৫ শতাংশ লোকসান দিতে হচ্ছে বলে জানান নুরুল ইসলাম। এর মূল কারণ হিসেবে যুদ্ধ ও স্থানীয়ভাবে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধিকে দায়ী করেন তিনি।
"এক সময় ফুল ক্যাপাসিটিতে উৎপাদন হতো। এখন কারখানাগুলো গড়ে ৬৫ শতাংশ ক্যাপাসিটিতে উৎপাদন করছে," বলেন তিনি।
এর সঙ্গে আমদানিতে ডলারের মূল্য বৃদ্ধির প্রসঙ্গ তুলে তিনি একটি কারখানায় আমদানিতে ৯০ কোটি টাকা লোকসানের উদাহরণ দেন।
নুরুল ইসলাম বলেন, "নাইস স্পিনিং কারখানার কার্যক্রম প্ল্যান করার পর আমদানির জন্য এলসি খোলা হলো। নিয়ম হলো রপ্তানিকারক বন্দরে পণ্য শিপমেন্ট হলে এর পরবর্তী পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে আমার ব্যাংক অর্থ পরিশোধ করবে। কিন্তু স্থানীয় ব্যাংক (ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড) ডলারের সংকটের কারণে তা করেনি, তা পরিশোধ করা হয় ৯ মাস পর। ফলে যে আমদানি মুল্য পরিশাধ করার জন্য ডলার প্রতি ৮৪ টাকা দিতে হতো, তা ব্যাংক পরিশোধ করলো ১০০ টাকার বেশি দরে। ফলে এক্ষেত্রে লস হয়েছে ৯০ কোটি টাকা।
ডলার সংকটের কারণে সময়মত এলসি খুলতে পারছেন না জানিয়ে তিনি বলেন, "প্রতি মাসে আমার কারখানাগুলোর জন্য ১০ হাজার টন তুলা দরকার। কিন্তু এলসি হচ্ছে না, এজন্য ৫ হাজার টন পাচ্ছি। আড়াইশ কোটি টাকার তুলা প্রয়োজন হয় প্রতি মাসে। আমদানিতে ডলার ১০৯ টাকা বলা হলেও ব্যাংকগুলো চাচ্ছে ১১৪ টাকা।"
দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ হোমটেক্সটাইল জাবের অ্যান্ড জুবায়ের ফেব্রিকস লিমিটেড এবং নোমান টেরি টাওয়েল মিলস লিমিটেড গত দেড় বছর আগেও বছরে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ডলারের উপরে রপ্তানি করলেও তা বর্তমানে ৩০০ মিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।
সার্বিকভাবে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষে এখন ব্যাংকের ঋণ পরিশোধও কঠিন হয়ে পড়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, "আমাদের এখনো কোন ওভারডিউ কিংবা লোন ক্লাসিফাইড হয়নি। কিন্তু সময়মত ব্যাংকের অর্থ পরিশোধ করা কঠিন হয়ে গেছে।"
এর কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, "আমাদের অর্ডারের একটি বড় অংশই এখন ভারত ও পাকিস্তানে চলে যাচ্ছে। ভারত গত দেড় বছরে হোম টেক্সটাইলে কয়েকটি বড় বিনিয়োগের কারখানা স্থাপন করেছে। পাকিস্তানেও একই অবস্থা। তাদের নিজস্ব তুলা ছাড়াও কারেন্সি আমাদের তুলনায় বেশি হারে ডিভ্যালুয়েশন, ইউরোপের সঙ্গে দুরত্ব কম হওয়ায় প্রতিযোগিতায় এগিয়ে আছে। অন্যদিকে আমাদের জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় আমরা আরো পিছিয়ে গিয়েছি।"
এসব কারণে হোম টেক্সটাইল খাতে বেশকিছু কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে জানিয়ে তিনি বলেন, বেডশিট জাতীয় পণ্য তৈরি করা ১৯টি কারখানার মধ্যে এখন ২টি কারখানা টিকে আছে।
সব মিলিয়ে আগামী বছরের আগস্টের আগে এ পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না বলে মনে করেন বাংলাদেশের টেক্সটাইল খাতের অন্যতম অভিজ্ঞ এ উদ্যোক্তা।
সংকট কাটিয়ে ওঠার উপায়
সমস্যা তুলে ধরার পাশাপাশি তা সমাধানের পথও বাতলে দিয়েছেন ৫ দশকের অভিজ্ঞ এ উদ্যোক্তা।
তিনি বলেন, "অবশ্যই গ্যাসের মূল্য কমাতে হবে।"
"আগে আমদানিকৃত জ্বালানির (এলএনজি) দাম পার এমএমবিটিইউ ৬৩ ডলারে উঠল, তখন সরকার গ্যাসের দাম ১৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা করলো। এখন একই পরিমাণ জ্বালানির দাম কমে ১২ ডলারে এসেছে। ফলে গ্যাসের দাম আসের অবস্থানে নিয়ে আসা উচিত," বলেন তিনি।
সরকার পলিসি সাপোর্ট দিলে বিনিয়োগ বাড়বে। তিনি আরো পরামর্শ দেন, জ্বালানি নীতি দিতে হবে অন্তত পাঁচ বছরের জন্য। "বলতে হবে, এই পাঁচ বছরের জন্য জ্বালানির দাম এই থাকবে, তাহলে আমরা ইনভেস্ট করতে পারবো," বলেন তিনি।
এছাড়া রপ্তানির সোর্স ট্যাক্স আগের ন্যায় ০.৫% করা, প্রণোদনার অর্থ থেকে ট্যাক্স কর্তন না করা, হোম টেক্সটাইল খাতের জন্য ইনসেনটিভের হার বাড়ানোর মাধ্যমেও এ সংকট কাটিয়ে ওঠা যাবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
নুরুল ইসলাম আরো বলেন, এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ড (ইডিএফ) এর আওতায় স্বল্প সূদে ঋণ সুবিধা অব্যাহত রাখা দরকার।