জাপানি অর্থনৈতিক অঞ্চল: আগামী বছরের শুরুতে উৎপাদনে যেতে জোর চেষ্টা
নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে অবস্থিত বাংলাদেশ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, যা জাপানি অর্থনৈতিক অঞ্চল নামেও পরিচিত, আগামী বছরের শুরুতে উৎপাদন শুরুর লক্ষ্যে যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করছে। বাংলাদেশ সরকার ও জাপানের যৌথ উদ্যোগে ১,০০০ একর জমিতে এই বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণ করা হচ্ছে।
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বহুজাতিক ইলেকট্রনিক্স এবং হোম অ্যাপ্লায়েন্স নির্মাতা প্রতিষ্ঠান সিঙ্গার বাংলাদেশ লিমিটেড ২০২৪ সালের মার্চের মধ্যে উৎপাদন শুরু করবে। ইতিমধ্যে ৩৩.৪ একর জমি লিজ নিয়ে কারখানা নির্মাণ করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) নির্বাহী চেয়ারম্যান শেখ ইউসুফ হারুন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছেন, চারটি কোম্পানি কারখানা নির্মাণ শুরু করেছে এবং আরও চারটি বর্তমানে চুক্তি স্বাক্ষর প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে। এছাড়াও, ২২টি নতুন কোম্পানি এই প্রতিশ্রুতিশীল অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
বেজার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, জাপানি অর্থনৈতিক অঞ্চলে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ ও অন্যান্য সুবিধা নিশ্চিত করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
কর্মকর্তারা জানান, অর্থনৈতিক অঞ্চলে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ কর্তৃক ২৩০ কেভি সাবস্টেশন নির্মাণ করা হবে। সাবস্টেশন নির্মাণের কাজ ২০২৫ সালের মধ্যে শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এ ছাড়া হরিপুর থেকে গ্যাস সঞ্চালন লাইন নির্মাণের জন্য সরকার দ্রুত জমি অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানান কর্মকর্তারা। নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে জমি অধিগ্রহণ করা হবে।
গত মাসে এ বিষয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) বৈঠক করে বেজা।
জাপানিজ ইকোনমিক জোন প্রকল্পের অবকাঠামো উন্নয়ন পরিচালক সালেহ আহমেদ বলেন, অর্থনৈতিক অঞ্চলে বর্তমানে একটি ৩৩ কেভি বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন চালু রয়েছে। সেখান থেকে বিদ্যুৎ ব্যবহার করে কারখানা স্থাপন করছে সিঙ্গার বাংলাদেশ লিমিটেড। ভবিষ্যতের চাহিদা মেটাতে একটি ২৩০ কেভি সাবস্টেশন তৈরি করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, হরিপুর থেকে গ্যাস লাইন আনতে ইতোমধ্যে পাইপ কেনা হয়েছে। গ্যাস লাইনের জন্য এখন জমি অধিগ্রহণ করতে হবে।
অর্থনৈতিক অঞ্চলে মাটি ভরাটের কারণে সংলগ্ন এলাকার পানি ধারণ ক্ষমতা কমে গেছে বলে পিআইসি সভায় আলোচনা হয়। ফলে অতিরিক্ত পানি নিষ্কাশনের জন্য খাল খনন করা না হলে অর্থনৈতিক অঞ্চলে জলাবদ্ধতার আশঙ্কা রয়েছে।
কমিটি এখন অর্থনৈতিক অঞ্চলের আশেপাশে খাল পুনঃখননের কাজ হাতে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সালেহ আহমেদ বলেন, আসন্ন শুষ্ক মৌসুমে আমরা তিনটি খাল খনন করতে চাই। আমরা ইতিমধ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাথে এই পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করেছি।
জুন ২০২৩ পর্যন্ত, জাপানিজ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি ৮৫.৮২ শতাংশ, এবং ভৌত অগ্রগতি প্রায় শতভাগ। প্রকল্পের আওতায় ভূমি অধিগ্রহণ কার্যক্রমও প্রায় শতভাগ সম্পন্ন হয়েছে।
সালেহ আহমেদ বলেন, চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে আরেকটি জাপানি অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণের কাজ চলছে।
তিনি বলেন, 'উভয় অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ এবং ভূমি উন্নয়নের জন্য আনুমানিক ৩,১৯৫ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া এই প্রকল্প শেষ হবে ২০২৪ সালের ৩০ জুন।'
সালেহ আহমেদ বলেন, বাংলাদেশ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের জমি অধিগ্রহণ ও উন্নয়ন ব্যয় প্রায় ২,৪০০ কোটি টাকা।
কর্মকর্তাদের মতে, অর্থনৈতিক অঞ্চলে অবকাঠামোগত উন্নয়ন কাজ জুন ২০২৫ সালের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।
পাঁচটি কোম্পানি জমি ইজারায় চুক্তি করেছে
নারায়ণগঞ্জের অর্থনৈতিক অঞ্চলে কারখানা নির্মাণে এখন পর্যন্ত পাঁচটি কোম্পানি বেজার সঙ্গে জমি ইজারা চুক্তি করেছে।
কোম্পানিগুলো হলো- সিঙ্গার বাংলাদেশ লিমিটেড (৩৩.৪ একর) জার্মান কোম্পানি রুডলফ জিএমবিএইচ (৫ একর)। জাপানের লায়ন কর্পোরেশন (৮.৪ একর), ওনোদো (৫ একর), নিক্কা ক্যামিকেল কো. লিমিডেট (৩.২ একর)।
এরমধ্যে সিঙ্গার বাংলাদেশ লিমিটেড ২০২৪ সালের মার্চের মধ্যে তাদের ৭৮ মিলিয়ন ডলারের গ্রিন ফ্যাক্টরিতে উৎপাদন শুরু করতে প্রস্তুত।
রুডলফ জিএমবিএইচ বাংলাদেশের টেক্সটাইল রাসায়নিক এবং সংশ্লিষ্ট পণ্যের বৃহত্তম সরবরাহকারী।
বাংলাদেশি কোম্পানি কল্লোল লিমিটেডের সাথে একটি যৌথ উদ্যোগ কাজ করবে বলে জানিয়েছে লায়ন কর্পোরেশন।
১০টি দেশে টেক্সটাইল রাসায়নিক তৈরিতে ৮১ বছরের অভিজ্ঞতা আছে নিক্কা কেমিক্যাল কোম্পানি লিমিটেডের। প্রতিষ্ঠানটি ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের টেক্সটাইল শিল্পে রাসায়নিক সরবরাহ করে আসছে।
স্থানীয়ভাবে রাসায়নিক সরবরাহের জন্য এই অর্থনৈতিক অঞ্চলে একটি শুল্কহীন গুদাম এবং রাসায়নিক উৎপাদন কারখানা স্থাপন করা হবে। এটি বাংলাদেশের টেক্সটাইল শিল্প এবং রাসায়নিক শিল্পের প্রবৃদ্ধি বাড়াতে সাহায্য করবে।
এছাড়া তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের সঙ্গে যৌথভাবে একটি গ্যাস মিটার অ্যাসেম্বলিং কারখানা নির্মাণ করবে ওনোদো।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) নির্বাহী চেয়ারম্যান শেখ ইউসুফ হারুন বলেন, বাংলাদেশ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে (বিএসইজেড) বেজা, জাইকা এবং সুমিটোমো কর্পোরেশনের যথাক্রমে ২৪%, ১৫% এবং ৬১% শেয়ার থাকবে।
তিনি আশা করেন যে এই অর্থনৈতিক অঞ্চলে ১.৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ আসবে এবং এটি সম্পূর্ণরূপে চালু হয়ে গেলে প্রায় এক লাখ লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে।
শেখ ইউসুফ বলেন, গত এক দশকে আমরা যে উদ্যোগ নিয়েছি সে বিষয়ে আমি আশাবাদী। বাংলাদেশ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে জাপানি কোম্পানিগুলো আমাদের লক্ষ্যের চেয়ে অনেক বেশি বিনিয়োগ করবে। এই অর্থনৈতিক অঞ্চলের প্রথম ধাপ চালু হলে এফডিআই বাড়বে।
বেজা সূত্রে জানা গেছে, অর্থনৈতিক অঞ্চলে অটোমোবাইল অ্যাসেম্বলি, মোটরসাইকেল, মোবাইল হ্যান্ডসেট, কৃষি পণ্য, গার্মেন্টস ও ফার্মাসিউটিক্যালসসহ বিভিন্ন খাতের কোম্পানি কারখানা স্থাপন করবে।
টয়োটা, মিতসুবিশি এবং সুমিতোমোর মতো জাপানি কোম্পানি ইতিমধ্যেই এখানে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখিয়েছে।
বেজা ২০৪১ সালের মধ্যে সারা দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করছে।