আবাসনকে সহজলভ্য করতে বন্ধকী ঋণ পুনঃঅর্থায়নের পরিকল্পনা করছে সরকার
আবাসন খাতে ঋণের প্রবাহ বাড়ানোর পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগকে উৎসাহিত করতে এবং সাশ্রয়ী মূল্যের আবাসন সুবিধা নিশ্চিত করতে সরকার একটি মর্টগেজ রিফাইন্যান্স কোম্পানি (এমআরসি) গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে। এই পদক্ষেপ আবাসন খাতকে চাঙ্গা করতে বড় উৎসাহ হতে পারে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, প্রস্তাবিত কোম্পানিটি সরাসরি বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণাধীন হবে; এবং কর্পোরেট বন্ড ও বন্ধকী-সমর্থিত (মর্টগেজ ব্যাকড) সিকিউরিটিজ ইস্যু করে পুঁজিবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহ করবে। পরে এই মূলধন দিয়ে এখাতে ঋণ দেওয়া ব্যাংকসহ অন্যান্য ঋণদাতাদের পুনঃঅর্থায়ন করবে, এতে তারা আরও বন্ধকী ঋণ দিতে পারবে।
এমআরসি গঠনের প্রাথমিক কাজের অংশ হিসেবে, গত অক্টোবরে একটি কর্মশালা করেছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। সেখানে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের আবাসন খাতের আধুনিক অর্থায়ন মডেলগুলো নিয়ে আলোচনা হয়।
এছাড়া বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে গত ২০ ডিসেম্বর এমআরসি ব্যবস্থাপনার বিষয়ে একটি 'পলিসি নোট' সংগ্রহ করেছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।
নথিটি দেখেছে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড। এতে এ ধরনের কোম্পানি প্রতিষ্ঠার নানান চ্যালেঞ্জ তুলে ধরা হয়। পাশাপাশি বাংলাদেশের নিজস্ব এমআরসি কাঠামো গড়ে তুলতে– ভারত, মালয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশে কোন পদ্ধতিতে এমআরসি কোম্পানি পরিচালিত হচ্ছে, তারও বাস্তব উদাহরণ দেওয়া হয়েছে।
এমআরসি গঠনের সভাব্যতা অধ্যয়ন পরিচালনা করতে সহায়তা করবে বিশ্বব্যাংক।
নাম না প্রকাশের শর্তে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের একজন কর্মকর্তা টিবিএস'কে বলেন, মূলত দুটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা: আবাসনকে সহজলভ্য করা এবং আর্থিক খাতের স্থিতিস্থাপকতা দৃঢ় করতে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, মর্টগেজ রিফাইন্যান্স কোম্পানি (এমআরসি)-র উদ্দেশ্য হলো– ব্যাংক ও ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই)-গুলোর জন্য আরও বেশি বন্ধকী সম্পত্তিকে উন্মুক্ত করা; ফলে তারা ফ্ল্যাট বা বাড়ির জন্য আরও ঋণ দিতে পারবে। বাড়ির মালিকানা আরও বেশি মানুষের সাধ্যের মধ্যে চলে আসবে।
"এই কোম্পানি একটি ঢাল হিসেবেও কাজ করবে, এবং দীর্ঘমেয়াদি আবাসন ঋণের সাথে সংশ্লিষ্ট ঝুঁকি থেকে রক্ষা করবে। এমআরসি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে থাকা বিদ্যমান আবাসন তহবিল রি-চ্যানেল করবে। ফলে ব্যাংক ও এনবিএফআই-গুলো তাদের বিনিয়োগ বহুমুখীকরণের মূলধন পাবে," যোগ করেন তিনি।
এমআরসি গঠনের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন আবাসিক খাতের উদ্যোক্তারা। তারা বলছেন, এতে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের মাধ্যমে আবাসন ঋণের সুদহার কমবে।
এমআরসির উদ্দেশ্য
মর্টগেজ রিফাইন্যান্স কোম্পানি হচ্ছে একটি নিয়ন্ত্রিত আর্থিক প্রতিষ্ঠান, যার মূল উদ্দেশ্য– আবাসনের খাতের প্রাথমিক ঋণদাতাদের দীর্ঘমেয়াদি তহবিল জোগান দেওয়া। এই কোম্পানি বন্ড বাজার এবং আবাসন খাতের প্রাথমিক ঋণদাতাদের মধ্যে একটি মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করে– আবাসন খাতে দীর্ঘমেয়াদী ঋণ কার্যক্রমকে সমর্থন দেয়।
ব্যাংকগুলো স্বল্পমেয়াদি আমানত নিয়ে অনেক সময় দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ করে। কিন্তু, স্বল্পমেয়াদি আমানতের মেয়াদ দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের আগেই উত্তীর্ণ হয়। অর্থাৎ, উভয়ক্ষেত্রে মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার মধ্যে একটি অসামঞ্জস্য থাকে। বিশ্বব্যাংকের নথি অনুযায়ী, এমআরসির প্রধান সুবিধা হলো– মেয়াদোত্তীর্ণ সমস্যা সমাধানে এটি সাহায্য করে।
অবকাঠামো ঋণের ডেভেলপারদের তুলনায় ঝুঁকি কম থাকায়– এমআরসি সাধারণত শুধুমাত্র আবাসন খাতের বন্ধকী ঋণ পুনঃঅর্থায়ন করে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, কোনো ঋণের বিপরীতে এমআরসির পুনঃঅর্থায়ন সুবিধা পেতে হলে– সেটিকে অবশ্যই চলতি ঋণ হতে হবে। এবং বন্ধকীর মূল্য প্রদত্ত ঋণের মূল অংকের চেয়ে বেশি হতে হবে। এই সুবিধা পেতে ইচ্ছুক ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানকে অবশ্যই আর্থিকভাবে স্থিতিশীল হতে হবে।
এমআরসির শক্তিশালী কর্পোরেট কাঠামো এবং প্রাতিষ্ঠানিক ঋণদান কার্যক্রমে স্বল্প ঝুঁকির কারণে– এই কোম্পানির বন্ড প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে আকর্ষণীয় হয়। এর মাধ্যমে প্রাথমিক ঋণদাতারা আরও ভালো সুদহার ও শর্তে দীর্ঘমেয়াদি তহবিল নিতে পারবে বলে জানান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
শুরুর দিকে কয়েক বছর সরকারের আর্থিক সহায়তা পায় বেশিরভাগ এমআরসি।
রিহ্যাব স্বাগত জানিয়েছে
আবাসনখাতের ব্যবসায়ীদের সংগঠন– রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) এর সাবেক সভাপতি শামসুল আলামিন টিবিএসকে বলেন, "আবাসনখাতে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের জন্য রিহ্যাব দীর্ঘদিন মর্টগেজ রিফাইন্যান্স কোম্পানি গঠনের দাবি জানিয়ে আসছিল। এ ধরণের কোম্পানি হলে পুঁজিবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহ করে দীর্ঘমেয়াদে আবাসনখাতে বিনিয়োগ করা যাবে। এতে হাউজিং লোনের সুদহার এখনকার চেয়ে অনেক কম হবে। মধ্যবিত্তের আবাসনের স্বপ্ন পূরণ হবে।"
"বর্তমানে ব্যাংকগুলো ডেভেলপার কোম্পানিগুলোকে কোনো ঋণ দেয় না; ফ্ল্যাট বা বাড়ির মালিককে ঋণ দেয়। এমআরসি হলে ডেভেলপার কোম্পানিগুলোও ঋণ পাবে"- জানান তিনি।
রিহ্যাবের তথ্য অনুযায়ী, আবাসনখাতে বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় এক লাখ কোটি টাকা। নির্মাণখাতের সাথে সিমেন্ট, রডসহ অন্যান্য খাত সরাসরি সম্পৃক্ত। আবাসনখাত চাঙ্গা হলে এসব খাত তথা সার্বিক অর্থনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
আগে আবাসনখাতের সমস্যা সমাধানের কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা
ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন টিবিএসকে বলেন, "বিশ্বব্যাংকের পলিসি নোটে– আবাসন খাতের অদক্ষতা, ভূমি বা প্লট বরাদ্দ, অপর্যাপ্ত জোনিং ডেভেলপমেন্টসহ যেসব সমস্যা চিহ্নিত করা হয়েছে, এমআরসি গঠনের আগে সেগুলোর সমাধান করতে হবে।"
"এমআরসি পুঁজিবাজারে বন্ড ইস্যু করে অর্থ সংগ্রহ করবে বলে বলা হলেও– বাংলাদেশে উপযুক্ত কোনো বন্ড মার্কেট নেই। সরকারি বন্ডগুলোও এখনও সেকেন্ডারি মার্কেটে ঠিকমতো লেনদেন হচ্ছে না। শক্তিশালী বন্ড মার্কেট নিশ্চিত না করে এমআরসি গঠন করে বন্ড ছাড়লে– তার আল্টিমেট ক্রেতা হবে ব্যাংকগুলোই। তাতে কোন লাভ হবে না।"
এমআরসি গঠন করার আগে পূর্বশর্তগুলো পূরণ করার ওপর তাগিদ দিয়ে বিশিষ্ট এই অর্থনীতিবিদ বলেন, বাধাগুলো দূর না করে এমআরসি গঠন করা হবে– 'ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেওয়া'র শামিল। তাতে শুধু সরকারের একটি প্রতিষ্ঠান হবে, আর কোন লাভ হবে না।