নওগাঁ অর্থনৈতিক অঞ্চল কি আলোর মুখ দেখবে না?
উত্তরের পিছিয়ে পড়া সীমান্তবর্তী জেলা নওগাঁয় বড় কারখানা বলতে কিছুই নেই। ধান আর আমের শক্তির ওপর ভর করে চলা এই জেলায় অর্থনৈটিক অঞ্চল করার ঘোষণা আসে ২০১৯ সালে। ঘোষণার পর কেটে গেছে প্রায় ৫ বছর, অথচ অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য এখনও জমি অধিগ্রহণ করা যায়নি।
জমি—সুনির্দিষ্ট করে বললে, 'খাস' জমির অভাব নওগাঁয় অর্থনৈতিক অঞ্চল করার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে হতাশ দীর্ঘদিন ধরে মূলধারার অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার আশায় থাকা স্থানীয় ব্যবসায়ীরা।
শিল্পের বহুমুখীকরণ এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নকে উৎসাহিত করতে দেশের সম্ভাব্য এলাকাগুলোতে অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের সরকারি প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে পরিকল্পিত অর্থনৈতিক অঞ্চলটির কাজ গত চার বছরে মাত্র ৬-৭ একর জমি অধিগ্রহণে আটকে রয়েছে।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) কর্মকর্তাদের তথ্যমতে, জেলার সাপাহার অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য প্রস্তাবিত জায়গার জমির একটি বড় অংশ ব্যক্তি মালিকানাধীন।
এছাড়া অর্থনৈতিক অঞ্চল করার জন্য সরকারি মালিকানাধীন 'খাস' জমিকে অগ্রাধিকার দেওয়ার নির্দেশনা আছে প্রথানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। আর ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি অধিগ্রহণে সাধারণত তিনগুণ দাম দিতে হয় বলে জানান বেজা কর্মকর্তারা।
২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে প্রাথমিক অনুমোদনের পর ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে অর্থনৈতিক অঞ্চলটি করার জন্য ২৫০.৬৩ একর জমি অধিগ্রহণের প্রশাসনিক অনুমোদন দেয় বেজা।
ওই বছরেই জমি অধিগ্রহণের জন্য প্রায় ৭১.৮২ কোটি টাকা বরাদ্দের অনুরোধ জানিয়ে বেজাকে চিঠি পাঠায় জেলা প্রশাসন। তবে এরপর থেকে অর্থনৈতিক অঞ্চলটি প্রতিষ্ঠার বিষয়ে আর কোনো অগ্রগতি হয়নি।
নওগাঁর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মিল্টন চন্দ্র রায় বলেন, '২০২১ সালে বেজাকে আমরা একটি চিঠি পাঠিয়েছিলাম। এরপর বেজা ওই চিঠির কোনো আপডেট আমাদের জানায়নি।'
বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান শেখ ইউসুফ হারুন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'নওগাঁর সাপাহারে অর্থনৈতিক অঞ্চল করার নীতিগত অনুমোদন হলেও এখনই তা করতে পারছি না। কারণ সেখানে মাত্র ৬ থেকে ৭ একর জমি খাস। বাকি জায়গা ব্যক্তি-মালিকানাধীন।'
তিনি আরও বলেন, 'অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি সার্কুলার আছে, জমি অধিগ্রহণ আপাতত করা যাবে না। আমরা এজন্য একটু পিছিয়েছি। তবে দীর্ঘমেয়াদে এগুলো আমাদের পরিকল্পনায় আছে। আমরা প্রতিটি জেলায় অর্থনৈতিক অঞ্চল করব।'
অর্থনৈতিক অঞ্চলের দাবি স্থানীয়দের
নওগাঁর ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা বলছেন, অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা হলে এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়ন উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়বে, প্রচুর কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে।
তারা বলেন, সাপাহার অঞ্চলের প্রধান অর্থকরি ফসল আম, ধান ও গম। এখন এই এলাকার কৃষকরা অন্যান্য ফসলের চেয়ে বেশি ঝুঁকেছেন আম চাষে। চাঁপাইনবাবগঞ্জকে ছাড়িয়ে এখন নওগাঁতে বাণিজ্যিকভাবে দেশের মধ্যে সবেচেয়ে বেশি আম উৎপাদিত হয়।
সাপাহারে অর্থনৈতিক অঞ্চল হলে এর আশপাশের পোরশা, নিয়ামতপুর, পত্নীতলা, ধামইরহাট, মহাদেবপুর এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার কয়েকটি উপজেলার ব্যাপক উন্নয়ন হবে। কর্মসংস্থান মিলবে অনেকের। নওগাঁয় অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ ভারতের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য বাড়ানোর জন্য স্থলবন্দর করার দাবিও জানাচ্ছেন ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা।
আম চাষিরা বলছেন, সংরক্ষণাগারের অভাবে ওই অঞ্চলে প্রতি বছর কোটি টাকার আম নষ্ট হয়ে যায়। উদ্যোক্তারা চান সাপাহারে অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন হলে সেখানে যেন আমের জুসের কারখানা করা হয়।
ঢাকায় সাংবাদিকতা ছেড়ে সাপাহারে সফল উদ্যোক্তা হয়ে নজির সৃষ্টি করেছেন আম চাষি সোহেল রানা। তিনি বলেন, প্রতি বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে হাজার হাজার মণ আম নষ্ট হয়। সংরক্ষণাগারের অভাবে তীব্র গরমেও পেকে নষ্ট হয় আম। অর্থনৈতিক অঞ্চলে ভালো মানের জুসের কারখানা হলে এই অঞ্চলের চাষিরা ব্যাপক লাভবান হবেন বলে উল্লেখ করেন তিনি।
দেশে সর্বোচ্চ উৎপাদিত আম থেকে বহুমুখী পণ্য তৈরির কারখানা করার জন্য অর্থনৈতিক অঞ্চল ব্যাপক জরুরি উল্লেখ করে নওগাঁ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি ইকবাল শাহরিয়ার রাসেল বলেন, 'এই বিষয়টি নিয়ে আমরা বারবার তাগাদা দিচ্ছি। আমাদের ভৌগোলিক অবস্থার কারণে ইকোনোমিক জোন ও স্থলবন্দর খুব জরুরি। এই দুটি হলে আমাদের অর্থনৈতিক দুরবস্থা কাটিয়ে ওঠার সুযোগ আছে। এছাড়া অন্য কোনো শিল্পকারখানা নেই নওগাঁয়। নওগাঁয় ব্যবসা-বাণিজ্য সচল করতে হলে এই দুটি প্রতিষ্ঠানের বিকল্প আপাতত নেই।'
নওগাঁ সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ শরিফুল ইসলাম বলেন, 'আমাদের এই অঞ্চল এমনিতেই পিছিয়ে পড়া। এই এলাকাকে এগিয়ে নিতে হলে বড় বড় শিল্পকারখানার কোনো বিকল্প নেই। নওগাঁর আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় ইকোনোমিক জোন গড়তে যত দ্রুত সম্ভব প্রশাসনকে পদক্ষেপ নিতে হবে। জমি অধিগ্রহণ করতে হবে।'