ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা যেভাবে পুরান ঢাকাকে ৩০ হাজার কোটি টাকার বৈদ্যুতিক পণ্য হাবে পরিণত করেছেন
পুরান ঢাকার কদমতলীর বাসিন্দা মুমিনুর রহমান মিঠু। আর্থিক অনটনে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার পর পড়াশোনা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। পড়াশোনা ছেড়ে ২০০৫ সালে তিনি মাত্র ৮০০ টাকা বিনিয়োগ করে বৈদ্যুতিক পণ্য বিক্রি শুরু করেন। কঠোর পরিশ্রম ও দৃঢ় সংকল্পের বদৌলতে অল্প সময়ের মধ্যেই সাফল্য ধরা দেয় মিঠুর হাতের মুঠোয়।
কিন্তু তরুণ এই উদ্যোক্তার স্বপ্ন ছিল আরও বড় কিছু করার। ২০১৭ সালে তিনি একটি এলইডি বাল্ব তৈরির কারখানা স্থাপন করেন। সেই উদ্যোগটিও অচিরেই সাফল্যের মুখ দেখে।
মিঠুর কারখানায় এখন ৫০ জন শ্রমিক প্রতিদিন প্রায় ১৫ হাজার বাল্ব উৎপাদন করে। কারখানাটির বার্ষিক টার্নওভার ৯ কোটি টাকা। তার কার্যকরী মূলধন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ কোটি টাকা।
পুরান ঢাকার বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি তৈরির ক্লাস্টারের আরেক সফল উদ্যোক্তা আলমগীর কবির। ২০১৭ সালে তিনি যাত্রাবাড়ীতে ২০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে কেব্ল উৎপাদন শুরু করেন। বর্তমানে তার কারখানায় প্রতিদিন ৭০০ থেকে ১ হাজার কয়েল কেব্ল—প্রতিটি কয়েলে ১০০ মিটার তার থাকে—উৎপাদন হয়। কারখানাটির বার্ষিক টার্নওভার ৪ কোটি টাকা।
আলমগীর দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, সরকারের কাছ থেকে কিছুটা সহযোগিতা পেলে আগামী ৫-১০ বছর পর তার কারখানার বার্ষিক টার্নওভার হবে অন্তত ১৫-২০ কোটি টাকা। সেইসঙ্গে কর্মসংস্থান হবে বহু লোকের।
শুধু মুমিনুর রহমান ও আলমগীর কবিরই নন, রাজধানীর পুরান ঢাকার কদমতলী, কুদরত আলী বাজার, পাটের বাজার, দক্ষিণ দনিয়া, কাজলা, মাতুয়াইল, পশ্চিম ধোলাইপাড়, মীরহাজিরবাগ, জুরাইন, এবং তৎসংলগ্ন বিস্তৃত শ্যামপুর-কদমতলী এলাকায় বৈদ্যুতিক পণ্য উৎপাদন করে অনেক উদ্যোক্তাই নীরবে নিজেদের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দিয়েছেন। পুরান ঢাকার এই ক্লাস্টারটিকে তারা বৈদ্যুতিক পণ্য উৎপাদন হাবে পরিণত করেছেন।
বৈদ্যুতিক পণ্যের কারখানার এই ক্লাস্টারটির বার্ষিক টার্নওভার প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। প্রায় ৫-৬ লাখ লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে এ ক্লাস্টার।
বাংলাদেশ ইলেকট্রিক্যাল মার্চেন্ডাইজ ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুসারে, ১৯৯৫ সালের দিকে ৫-৬টি কারখানা সর্বপ্রথম পুরান ঢাকার এই ক্লাস্টারটিতে বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি উৎপাদন শুরু করে।
২০০৫ সাল নাগাদ এখানে কারখানার সংখ্যা বেড়ে প্রায় ১০০ হয়। পরের ১০ বছরে ক্লাস্টারটি সবচেয়ে বেশি সম্প্রসারিত হয়েছে। এ সময় এখানে প্রায় ৬০০টি নতুন কারখানা স্থাপিত হয়।
বর্তমানে এখানে ক্ষুদ্র ও মাঝারি মিলে প্রায় ৮০০ কারখানা সিলিং ফ্যান, সুইচ, হোল্ডার, প্লাগ, ফিউজ কাট-আউট, রেগুলেটর প্রভৃতি পণ্য তৈরি করে। এর মধ্যে নিবন্ধিত কারখানা রয়েছে ২০০টি।
সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা বলছে, সরকার সহায়তা করলে এই শিল্প ক্লাস্টারটি আগামী ১০ বছরে ১৫ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারবে।
এখানকার উৎপাদিত পণ্যের দাম কিছুটা কম ও গুণগত মান ভালো হওয়ায় সারা দেশে এই ক্লাস্টারের উৎপাদিত পণ্যের চাহিদা ব্যাপক। ঢাকার গুলিস্তান ও নবাবপুর রোডের পাইকারি বাজারের মাধ্যমে এসব পণ্য বাজারজাতকরণ করা হয়।
উদ্যোক্তারা জানান, কাঁচামাল হিসেবে তারা কপার, অ্যালুমিনিয়াম, ব্লেড, কয়েল, ক্যাপাসিটর, ইউরিয়া রেজিন, পিতলের শিট, লোহা, মোল্ডিং পাউডার প্রভৃতি ব্যবহার করেন। এসব কাঁচামাল তারা পুরান ঢাকার নবাবপুর, শনির আখড়া, বাবুবাজার থেকে সংগ্রহ করেন।
শ্যামপুর-কদমতলী ক্লাস্টারটির বেশিরভাগ উদ্যোক্তাই একসময় বিভিন্ন কারখানায় শ্রমিক-কারিগর হিসেবে কাজ করতেন। বর্তমানে তাদের কারখানায় কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন শত শত মানুষ।
শার্ক ইলেকট্রিকের স্বত্বাধিকারী মিঠু টিবিএসকে বলেন, 'প্রথমে আমি নিজে থেকে চাইনিজ এলইডি লাইট উৎপাদনের প্রযুক্তি শেখার চেষ্টা করি। এরপর চীন ও ভিয়েতনাম সফর করি। তারপর আমি এলইডি লাইট তৈরির জন্য চীন থেকে কাঁচামাল আমদানি করার সিদ্ধান্ত নিই।'
'তবে এখন বুয়েটের প্রকৌশলীদের সাহায্যে আমি স্থানীয় এবং চাইনিজ উভয় উৎসের কাঁচামাল ব্যবহার করে লাইট তৈরি করি'- যোগ করেন তিনি।
করোনার ধাক্কা:
উদ্যোক্তারা বলছেন, বাজারে আমদানিকৃত পণ্য বাড়ায় এবং কিছু বড় কোম্পানির উত্থানে এই ক্লাস্টারের ব্যবসা চ্যালেঞ্জে পড়ে গেছে।
এছাড়া করোনা মহামারির প্রভাবেও কিছু উদ্যোক্তা ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন। মহামারিকালে প্রায় ৩০ শতাংশ শ্রমিক চাকুরি হারিয়ে অন্য পেশায় চলে গেছে বলে জানান তারা।
রাজধানীর একটি এলইডি লাইট কারখানায় পাঁচ বছর ধরে কাজ করছেন ইউসুফ হোসেন। তিনি বলেন, 'আমি ৮ হাজার টাকা বেতনে প্রথমে এই কারখানায় চাকরি শুরু করি, কাজ করতে করতে এখন আমি একজন কারিগর, বর্তমানে আমার বেতন মাসে ১৮ হাজার টাকা। তবে ভয়ে থাকি, করোনা বা অন্য কোন কারণে কখন আবার কারখানা বন্ধ হয়ে যায়- তাহলে আমি চাকরি হারাব।'
অন্যান্য প্রতিকূলতা:
উদ্যোক্তারা অবশ্য বলেন, সরকারি সহায়তা আর আধুনিক উৎপাদন ব্যবস্থার অভাব, সহজ শর্তে ও স্বল্প সুদে ব্যাংক ঋণের অভাব তাদের প্রধান বাধা।
শ্রমিকদের অনিরাপদ এবং অস্বাস্থ্যকর কর্ম-পরিবেশ, কাঁচামালের উচ্চমূল্য, পণ্যের মান উন্নয়নে গবেষণাগার এবং সার্টিফিকেশন না থাকার মতো নানাবিধ কারণেও এ শিল্পের বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে বলে জানান তারা।
এছাড়াও কিছু অসাধু কারখানায় নকল পণ্য উৎপাদন এবং ভারত ও চীন থেকে নিম্নমানের পণ্য আমদানির কারণে তাদের বাজার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে তারা উল্লেখ করেন।
বর্তমানে নানাবিধ কারণে এই ক্লাস্টারের প্রায় তিন হাজার কারখানা বন্ধ রয়েছে। অনেকে উৎপাদনে ফেরার চেষ্টা করলেও, কেউ কেউ মনে করছেন সরকার এ শিল্পের সমস্যা সমাধানে দরকারি পদক্ষেপ না নিলে ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা খুবই কম।
আবুল কাশেম চৌধুরী ২০০০ সালে ৫০ লাখ টাকা পুঁজি ও ৩০ জন শ্রমিক সিলিং ফ্যান বানানো শুরু করেন। ব্যবসা বড় হতে হতে একসময় কারখানায় দৈনিক ৮০০-১০০০ হাজার ফ্যান উৎপাদন করতেন। বছরে টার্নওভার ৩০ কোটি টাকা পর্যন্ত হয়ে যায়। কিন্তু বড় বড় কোম্পানিগুলোর সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে ২০২০ সালের শেষের দিকে বন্ধ হয়ে যায় আবুল কাশেমের কারখানাটি। এখন তার ব্যাংক ঋণের পরিমাণ ৭ কোটি টাকা।
তিনি বলেন, 'যখনই আমাদের কোনো পণ্য বাজারে ভালো করে, তখন বড় কোম্পানিগুলো আমাদের হারানোর জন্য সবকিছু করে। তারা বেশি অর্থের প্রস্তাব দিয়ে আমাদের কর্মী নিয়োগ করে। আমাদের পাইকারি গ্রাহকদের মূল্যছাড় দিয়ে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করে।'
তিনি আরও বলেন, '২০০০ সালের পর যাত্রাবাড়ির মীরহাজিরবাগ এলাকায় কম করে হলেও ৭০টি ছোট ও মাঝারি আকারের সিলিং ফ্যান কারখানা গড়ে উঠেছিল। এখন মাত্র ২৫-৩০টি টিকে আছে। সরকারের ক্ষুদ্র শিল্পের প্রতি বাড়তি মনোযোগ, প্রণোদনা ও তদারকি না থাকলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প টিকে থাকাই দায়।'
দনিয়ার কুদরত আলী বাজারের কারখানার মালিক নাসির উদ্দিন বলেন, 'বিএসটিআই সনদের সরকারি ফি ৭ হাজার টাকা, ৫০ হাজার টাকা ঘুষ দিয়ে এক বছরেও তা পাইনি।'
তার মতে, 'বিএসটিআই, শ্রম মন্ত্রণালয়, পরিবেশ মন্ত্রণালয়, ফায়ার সার্ভিস ইত্যাদি থেকে দ্রুত ও সহজে প্রয়োজনীয় নথি আর সনদ পেলে আমাদের অধিকাংশ সমস্যার সমাধান হবে।'
প্রয়োজন সরকারি প্রণোদনার:
বাংলাদেশ ইলেকট্রিক্যাল মার্চেন্ডাইজ ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র সহ-সভাপতি আবুল কালাম আজাদ টিবিএসকে বলেন, 'এই ক্লাস্টারটির উদ্যোক্তারা করোনাকালীন সরকারি প্রণোদনা পাননি বললেই চলে। এখন তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণে স্বল্প সুদে দীর্ঘমেয়াদী জামানতবিহীন ব্যাংক ঋণ প্রয়োজন।'
তিনি আরও বলেন, উন্নত বাজারজাতকরণ পদ্ধতি, রপ্তানির ক্ষেত্রে সরকারের সহযোগিতা, বিদেশি ক্রেতাদের আকৃষ্টকরণ, প্রযুক্তির ব্যবহার (ই-কমার্স, ই-মার্কেটিং), প্রধান কাঁচামালের দাম কমানো হলে এই ক্লাস্টারের পণ্যের উৎপাদন আরও বাড়ানো যাবে। তার ফলে এ খাত আগামী ১০ বছরে ১৪-১৫ লাখ লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারবে।
এসএমই ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ মফিজুর রহমান বলেন, 'আমরা ক্লাস্টারটির সম্প্রসারণে এবং স্থিতিশীল বাজার ও টেকসই ব্যবসায়ীক পরিবেশ সৃষ্টিতে সর্বোচ্চ সহযোগিতা দেব। বিশেষ করে, বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিয়ে আর ই-কমার্স, ই-মার্কেটি ইত্যাদির মাধ্যমে পণ্যের প্রমোশনে। উদ্যোক্তাদের নানাবিধ সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে অবিলম্বে সেগুলো সরকারের কাছে তুলে ধরবে এসএমই ফাউন্ডেশন।'