মিরপুর-পল্লবীর পাদুকা শিল্পের প্রসারে প্রয়োজন সরকারি সহায়তা
কে প্রথম শুরু করেছিলেন, তা কেউ-ই সঠিক বলতে পারেন না। তবে ৮০'র দশকের শেষের দিকে দুয়েকটি কারখানা থেকে আজ রাজধানীর মিরপুর-পল্লবী এলাকায় প্রায় ২০০ হস্তনির্মিত পাদুকা শিল্প কারখানা গড়ে উঠেছে। বর্তমানে ক্লাস্টারটিতে ১০০ কোটি টাকার অধিক বার্ষিক টার্নওভার। ক্লাস্টারটিতে কারিগর-শ্রমিক মিলে পাঁচ হাজারের অধিক লোকের কর্মসংস্থান রয়েছে বলে জানিয়েছেন সেখানকার কারখানার মালিক-ব্যবসায়ীরা।
মোহাম্মদ আকাশ আহমেদ, ১৯৯৮ সালে মিরপুরে একটি জুতার কারখানায় শ্রমিক হিসেবে কাজ নেন। ৫ বছরে শ্রমিক থেকে কারিগরে পরিণত হন তিনি। ২০০৪ সালে নিজের জমানো এক লাখ টাকা পুঁজি ও ৩ জন শ্রমিক নিয়ে পল্লবী ১১ সেকশনে নিজেই জুতার কারখানা গড়ে তোলেন। বর্তমানে তার কারখানায় ২৫ জন কারিগর-শ্রমিক কাজ করেন, বছরে ২-৩ কোটি টাকা টার্নওভার।
মোহাম্মদ আকাশ আহমেদ টিবিএসকে বলেন, 'আমি যখন ঢাকায় এখানে শ্রমিক হিসেবে কাজ নিই, তখন মিরপুর পল্লবী এলাকায় ১০-১২টি কারখানা ছিল, ২০১০ সালের দিকে এর সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ১২০-১৫০টি কারখানায়। করোনার আগ পর্যন্ত ২৫০-৩০০ কারখানা ছিল পুরো এলাকায়। বর্তমানে করোনায় কিছু কারখানা ধসে যাওয়ার পরেও অন্তত ২০০টির বেশি কারখানা এখনো অবশিষ্ট রয়েছে।'
মোহাম্মদ আকাশ আহমেদ আরও বলেন, 'এখন আমি বছরে প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার পিস জুতা উৎপাদন করি, ঢাকায় এবং জেলা শহরগুলোতেও আমার জুতা পাইকারি বিক্রি হয়। এই কারখানার আয় দিয়ে গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জে জমি কিনেছি এবং বিল্ডিং বাড়িও নির্মাণ করেছি। আশা আছে কারখানার আয় দিয়ে ঢাকায়ও একদিন বাড়ি করবো।'
মোহাম্মদ আকাশের মতোই আরেক কারখানা মালিক নুরুল হক। তিনিও শ্রমিক থেকে কারিগর, তারপর এখন মালিক হয়েছেন।
তিনি টিবিএসকে বলেন, '২০০২ সালে মাত্র ৫০ হাজার টাকা ও ২ জন শ্রমিক নিয়ে কারখানা শুরু করি, বর্তমানে আমার কারখানায় ২০ জন লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে, করোনার আগে ৩০ জন শ্রমিক ছিল। আমার কারখানায় মাসে প্রায় ১০-১৫ লাখ টাকার জুতা বিক্রি হয়। কারখানার আয় দিয়ে গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জে জমি কিনেছি।'
রাজধানীর মিরপুরের পল্লবী থানার সেকশন-১১, লালমাটিয়া, পলাশনগর ইত্যাদি এলাকায় বিচ্ছিন্নভাবে গড়ে উঠেছে এসব হস্তনির্মিত ক্ষুদ্র পাদুকা শিল্প কারখানা।
কারখানা মালিকদের ৮০-৯০ শতাংশই এক সময় এ খাতের শ্রমিক বা কারিগর ছিলেন। পাঁচ-দশ বছরের কাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে পরবর্তীতে নিজেই প্রতিষ্ঠান খুলে মালিক বনে যান। এসব কারখানার মালিক-শ্রমিকের প্রায় ৯৫ শতাংশই কিশোরগঞ্জ জেলার বাসিন্দা।
২০০৮ সালে জুতা কারখানায় সামান্য বেতনে শ্রমিকের কাজ শুরু করেন আবদুল কুদ্দুস (৫০)। বর্তমানে তিনি মাসে ৩০ হাজার টাকার অধিক আয় করেন জুতা তৈরি করে।
আবদুল কুদ্দুস বলেন, 'গত ১৪ বছরে আমি জুতা তৈরির একজন দক্ষ কারিগরে পরিণত হয়েছি, বর্তমানে আমার পরিবারে তেমন অর্থকষ্ট নেই, বউ-বাচ্চা সবাইকে গ্রাম থেকে ঢাকা নিয়ে এসেছি। আশা করি আগামী ৫ বছরে কাজের অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে আমার বেতন ৪৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা হয়ে যাবে।'
আরেকজন অভিজ্ঞ কারিগর জামাল হোসেন মাসে ২৫ হাজারের অধিক টাকা আয় করেন। টিবিএসকে তিনি বলেন, 'ছোটবেলায় চাচাতো ভাইয়ের সাথে ঢাকার এই পল্লবী এলাকায় জুতার কারখানাতে কাজ নেই, তখন আমার বেতন ছিল ৩ হাজার টাকা (২০০২ সালে)। এখন আমি যে বেতন পাই তাতে পল্লবী এলাকায় বর্তমানে ভালোভাবেই চলতে পারি, কারণ এই এলাকায় বাসাভাড়া ও থাকা-খাওয়ার খরচ ঢাকার অন্যান্য এলাকার তুলনায় একটু কম।'
তবে এখনো ক্লাস্টারটিতে কারখানার মালিকদের কোনো সমিতি গড়ে উঠেনি। যার ফলে এসব ক্ষুদ্র শিল্পের জন্য সরকারি বিভিন্ন আর্থিক সুযোগ-সুবিধা, কারিগরি প্রশিক্ষণ, করোনাকালীন ক্ষতিগ্রস্ত শিল্পের জন্য সরকারি প্রণোদনা ইত্যাদির ব্যাপারে কোন খবরই জানে না এখানকার মালিক-শ্রমিকরা।
এ ক্লাস্টারে সাধারণত সু/স্যান্ডেল (লেডিস,জেন্টস,বেবি) উৎপাদিত পণ্য। উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত কাঁচামাল চামড়া, রেক্সিন, রাবার, সুতা, সলিউশন, ফোম, রং ইত্যাদি।
এসব কাচাঁমাল পুরাতন ঢাকার আশেপাশের এলাকা যেমনঃ বংশাল, সিদ্দিকবাজার, হাজারীবাগ বাজার থেকে সংগ্রহ করা হয়।
দেশীয় এবং আমদানিকৃত কাঁচামাল দিয়ে সম্পূর্ণ দেশীয় যন্ত্রের সাহায্যে উন্নতমানের প্রযুক্তি ছাড়াই সু/স্যান্ডেল তৈরী হচ্ছে। এখানকার সু/স্যান্ডেল দেশের প্রত্যন্ত এলাকার ব্যবসায়ীদের অর্ডারের ভিত্তিতে উৎপাদন করা হয়। এছাড়াও ক্লাস্টারটির অনেক উদ্যোক্তার নিজস্ব শো-রুম আছে। সেখানে পাইকারি ও খুচরা সু/স্যান্ডেল বিক্রয় করে থাকেন।
করোনার আঘাত
করোনায় ব্যাপক ক্ষতির শিকার হয়েছে মিরপুর-পল্লবীর এই ক্লাস্টারটি।
ব্যবসায়ীদের তথ্য মতে, করোনায় কম করে হলেও ৩০-৪০ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে এবং ৭০-১০০টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে।
পলাশনগর এলাকায় পাদুকা কারখানার মালিক আমিনুর রহমান। তিনি বলেন, 'করোনায় এখানকার সব কারখানাই বন্ধ ছিল, বারবার লকডাউনে অনেক কারখানার মালিক পুঁজি খুইয়ে গ্রামে বাড়ি চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। এখানকার কোন ব্যবসায়ী করোনাকালীন সরকার থেকে ঘোষিত আর্থিক সহযোগিতা পায়নি। এমনকি ক্লাস্টারটি গড়ে উঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি কোন সহযোগিতাই পায়নি এখানকার ব্যবসায়ীরা।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
বর্তমানে এই ক্লাস্টারের উৎপাদিত পণ্য সরাসরি বিদেশ রপ্তানি হয় না। তবে ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন ডিজাইনের পণ্য যদি উৎপাদন করা হয় তাহলে দেশীয় বাজারের সাথে সাথে বিদেশেও এসব পণ্যের যথেষ্ট চাহিদা তৈরী হবে। প্রয়োজনীয় তথ্য ও প্রশিক্ষণ পেলে উক্ত ক্লাস্টারের উদ্যোক্তাগণ অদূর ভবিষ্যতে উন্নতমানের পণ্য উৎপাদন করে বিদেশ রপ্তানি করতে সক্ষম হবেন বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা।
তারেক রহমান (৪৫), বিগত ২০ বছর ধরে বিভিন্ন কারখানার মালিকদের থেকে পাইকারি দরে পাদুকা কিনে রাজধানীর বিভিন্ন শোরুমে সেল করে থাকেন।
তারেক রহমান টিবিএসকে বলেন, 'এই ক্লাস্টারের সকল পণ্য প্রধানত ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে উৎপাদন করা হয়। তবুও এই ক্লাস্টারের উৎপাদিত পণ্যের গুণগত মান মোটামুটি ভাল হওয়ায় এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তাই এই শিল্পে যদি আধুনিক প্রযুক্তির সংযোজন করা যায় এবং ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী আধুনিক ডিজাইনের সু/ স্যান্ডেল প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কারিগর দ্বারা উৎপাদন করা যায়, মালিকদের স্বল্পসুদে দীর্ঘমেয়াদী জামানতবিহীন লোন দেয়া যায় তাহলে এই ক্লাস্টারের উৎপাদিত পণ্যের গুণগত মান যেমন বৃদ্ধি পাবে তেমনি দেশের বাইরে তা রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব হবে।'
এ ব্যাপারে এসএমই ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মোঃ মুফিজুর রহমান বলেন, 'আমরা ২০১৬ সালের দিকে ক্লাস্টারটির একটি এসেসমেন্ট স্টাডি করেছি। মূলত কোন মালিক সমিতি বা ব্যবসায়ীদের সংগঠন না থাকায় তাদের সাথে আমাদের যথাযথ যোগাযোগ হয়নি। তবে ক্লাস্টারটি যাতে আরও বেশি ভালো করে তার জন্য সামনের দিনে কারিগর-শ্রমিকদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণসহ আর্থিক সহযোগিতা দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।'