লেন্ডিং রেট বাজারের উপর ছেড়ে দিতে হবে, মত অর্থনীতিবিদদের
সরকার ডলারের এক্সচেঞ্জ রেট বাজারের উপর ছেড়ে দেওয়ায় (ফ্রি ফ্লোটিং রেট) তা ডলারের বাজারে স্থিতিশীলতা আনতে সহায়ক হবে; কিন্তু একই সাথে ইনফ্লেশন রেট বিবেচনায় ইন্টারেস্ট রেটও বাজারের উপর ছেড়ে দিতে হবে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলেন, এ জন্য ইন্টারেস্ট রেট বাড়বে এবং তা মেনে নিতে হবে।
শনিবার রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) ও একাত্তর টিভি'র যৌথ আয়োজনে 'ম্যাক্রো ইকোনমিক আনসার্টেইনটিস অ্যান্ড প্রায়োরিটিস ফর বাংলাদেশ' শীর্ষক শেষ মুহুর্তের বাজেট ভাবনা নামের ওই আলোচনায় তারা এসব কথা বলেন।
পিআরআই নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুরের সঞ্চালনায় এ আলোচনায় বক্তব্য দেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা এবি মির্জা আজিজুল ইসলাম।
বর্তমানে ব্যাংকগুলো ৬ শতাংশ রেটের আমানত নেয় এবং ৯ শতাংশ সুদ হারে অর্থ লগ্নি করে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)- এর বিশেষ ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, এখন ব্যাংকে সেভিংসে রেট ৬ শতাংশ, অথচ ইনফ্লেশন রেট ৬.৫ শতাংশ । তাহলে সঞ্চয়কারীদের জন্য তো এটা নেগেটিভ, তাদেরকে কী দিলাম। এজন্য ইন্টারেস্ট রেটও ফ্রি ফ্লোট-এ দিতে হবে এবং ইন্টারেস্ট রেট বাড়বে, তা মেনে নিতে হবে। এসময় একাধিক বক্তার বক্তব্যে এক্সচেঞ্জ রেট ফ্লোটিং করার পর ইন্টারেস্ট রেটকেও ফ্লোটিং করার গুরুত্ব উঠে আসে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের মূখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, "এক্সচেঞ্জ রেট বাজারের উপর ছেড়ে দেওয়া বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্ত সঠিক। কিন্তু যেখানে ডলার বিক্রি হচ্ছে ৯২ টাকা বা তারও বেশি হারে, সেখানে বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেই বিক্রি করছে ৮৮ টাকা রেট এর। কমদামে বিক্রি করে বেশি দামে ডলার কিনতে হবে – এটাতো আত্মহত্যার শামিল।"
তিনি চাহিদার ব্যবস্থাপনা ও সরবরাহ ঠিক রাখার উপর জোর দেন।
আলোচনায় সাম্প্রতিক পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশের উপর বাড়তি ইনফ্লেশনারি চাপ তৈরি হওয়া, বিপুল সংখ্যক মানুষকে সোশ্যাল সেফটি নেটের আওতায় আনার জন্য বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানো এবং টার্গেটেড মানুষের হাতে তা পৌঁছাতে যথাযথ মেকানিজম নিশ্চিত করা, চাহিদা ব্যবস্থাপনা ও সরবরাহ ঠিক রাখায় নজর দেওয়া, আমদানিতে বিকল্প উৎসের ব্যবস্থা রাখা, লোকসানি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানকে চলমান ব্যবস্থায় বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা ঠিক কিনা – এমন বক্তব্য উঠে আসে।
আলোচনায় বক্তারা বলেন, ভর্তুকি কমিয়ে আনার প্রয়োজন হলেও, বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নিম্ন আয়ের মানুষকে রক্ষায় আপাতত তা কমানো ঠিক হবে না।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা এবি মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, "সোশ্যাল সেফটি নেট এর আওতা বাড়াতে হবে এবং এবং তার সুষ্ঠু বিতরণ নিশ্চিত করতে হবে। আমরা অনেক সময় খবরে দেখি, যারা এ সুবিধার আওতায় আসার কথা নয়, তারাও চলে আসে; আর যারা পাওয়ার কথা, তারা পায় না। বাজেটে এ বিষয়ে দিকনির্দেশনা থাকা উচিত।"
এ সময় তিনি বলেন, বর্তমান ইনফ্লেশনারি চাপের সময়ে সংকোচনমূলক বাজেট দিয়ে তা মোকাবেলা করা সম্ভব নয়।
অবশ্য জাহিদ হোসেন মনে করেন, সংকোচনমূলক হলেও দেখতে হবে, ঘাটতি কতটা বাড়ানোর সুযোগ আছে।
পলিসি এক্সচেঞ্জ অব বাংলাদেশ- এর ড. এম মাসরুর রিয়াজ বলেন, আমদানির ক্ষেত্রে আমাদের বিকল্প উৎস চিন্তা করতে হবে। ভারত, ইতালি, ইন্দোনেশিয়ার মত দেশ তা-ই করছে।
এ সময় ড. আহসান এইচ মনসুর লোকসানি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানকে আধুনিকায়ন এবং প্রতিযোগিতা সক্ষম করে না তুলে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করাকে 'ড্রেনিং দ্য বাজেট' বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, "আমরা রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান রাখছি, আবার তাদের আধুনিকায়নে বরাদ্দ রাখি না। কিন্তু বছর বছর বাজেট থেকে বরাদ্দ দেওয়া হয়। রেলের মতো প্রতিষ্ঠানের পেছনে গেছে ১ লাখ কোটি টাকার বেশি। একইভাবে টেলিটকসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের পেছনেও হাজার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, বাজেট কেবল আয়-ব্যয় বা অংকের হিসাব নয়। এর সঙ্গে সামাজিক ইস্যু, বিনিয়োগসহ অনেক বিষয় জড়িত। বর্তমান অস্থিরতা আর্থিক ও রাজস্ব নীতির মাধ্যমে কাটিয়ে উঠতে হবে।
বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ডেভলপমেন্ট স্টাডিস-এর মহাপরিচালক বিনায়ক সেন বলেন, "পাবলিক এন্টারপ্রাইজ যেগুলো থাকার নয়, সেগুলো থাকারই দরকার নেই। পাট শিল্পের দুর্দশার কারণই হলো কোন আধুনিকায়ন না হওয়া।"
এদিকে অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান আগামী বাজেটে প্রবৃদ্ধি হিসাবের চাইতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা, জীবনযাত্রার মান, বন্টন -ইত্যাদিতে জোর দেওয়ার তাগিদ দেন।
এনবিআরের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারাই কী ২০১২ সালের ভ্যাট আইনে বাধা ছিলেন?
আলোচনায় রাজস্ব প্রশাসনের বিভিন্ন সংস্কার না হওয়া এবং ২০১২ সালের বহুল আলোচিত ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন না হওয়ার প্রসঙ্গটি আসে। এসময় তৎকালীন এনবিআর সদস্য ব্যারিস্টার জাহাঙ্গির হোসেন বলেন, এখনকার ভ্যাট আইনের চেয়ে ১৯৯১ সালের ভ্যাট অনেক ভালো। ২০১৯ সালে এসে যেনতেনভাবে এটি বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
তখন ড. আহসান এইচ মনসুর তার কাছে জানতে চান, মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারাই কী আইনটি বাস্তবায়ন করতে (২০১২ সালের আইন) দেননি? জবাবে তিনি বলেন, "অবশ্যই। বাইরে থেকে কেউ করেনি।"
তিনি আরো বলেন, বর্তমানে বাস্তবায়ন হওয়া আইনটি নিয়ে স্টাডি হওয়া দরকার। এনবিআরের চ্যালেঞ্জ অনেক বেড়েছে কিন্তু সক্ষমতা কমেছে।
প্রসঙ্গত, ২০১২ সালের আইনটি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হওয়ার পর ২০১৯ সালে এতে বিস্তর কাটাছেঁড়া করা হয় এবং তা একই নামে বর্তমানে বাস্তবায়ন হচ্ছে। কিন্তু অনেকেই মনে করছেন, আইনটি তার স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য হারিয়েছে।
এসময় অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন, ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান, এনবিআর- এর সাবেক সদস্য ফরিদ উদ্দিন, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান, দ্য ফাইন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস-এর সম্পাদক শামসুল হক জাহিদ।