নিদ্রাহীনতায় গোটা দক্ষিণ কোরিয়া! ২০টি ওষুধ খেয়েও আসছে না ঘুম
অফিসের সময়, অন্যান্য কাজ সবকিছু গুছিয়ে দিনশেষে ঘুমোনোর সময়ই পাচ্ছিলেন না জি-ইউন।
সকাল ৭টায় শুরু হয়ে সাধারণত রাত ১০টা পর্যন্ত তাকে কর্মব্যস্ত থাকতে হতো। কাজের চাপ বেশি হলে কখনো কখনো রাত ৩টা অবধি অফিসে থাকার নজিরও ছিল জি-ইউনের।
কাজের জন্য মাঝরাতে অফিসের বসের কাছ থেকে ফোন আসা তো ছিল নৈমিত্তিক ব্যাপার।
২৯ বছর বয়সী এই জনসংযোগ কর্মকর্তা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, "আমি তো ভুলেই গেছিলাম আরাম-আয়েশ কাকে বলে!"
হ্যাঁ পৃথিবীর যেসব দেশের নাগরিকেরা নিদ্রাহীনতায় ভোগে, তার মধ্যে অন্যতম হলো দক্ষিণ কোরিয়া।
সিউলের ঝা-চকচকে গ্যাংনাম জেলার ড্রিম স্লিপ ক্লিনিকের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. জি-হিয়্যুন লি জানিয়েছেন, তার কাছে প্রায়ই এমন সব ক্লায়েন্ট আসেন যাদের কেউ কেউ রাতে ২০টি পর্যন্ত ঘুমের ওষুধ খান।
"আসলে বিছানায় গেলেই তো সাথে সাথে ঘুম আসে না, একটু সময় লাগে। কিন্তু কোরিয়ানরা সে সময়টুকুও ছাড় দিতে নারাজ। চায় সাথেসাথেই ঘুমিয়ে পড়তে, আর তাই তারা স্লিপিং পিলস নেয়।"
ঘুমের ওষুধের প্রতি আসক্তি দক্ষিণ কোরিয়ায় মহামারির পর্যায়ে চলে গেছে। কোন সরকারি পরিসংখ্যান নেই তবে অনুমান করা হচ্ছে যে, প্রায় এক লাখ কোরিয়ান ঘুমের ওষুধে আসক্ত।
তবু যখন কারো চোখে ঘুম নেমে আসে না, তখন তারা ওষুধের সাথে অ্যালকোহলও পান করে যা আরও বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে।
ডা. জি-হিয়্যুন লি বলেন, "লোকজন স্লিপওয়াক শুরু করে। তারা ফ্রিজের দিকে হেঁটে যায় এবং অবচেতন মনেই খাওয়া শুরু করে। কখনো কখনো কাঁচা খাবারও খেয়ে ফেলে।"
"এমনকি সিউলের কেন্দ্রে গাড়ি দুর্ঘটনার ঘটনাও ঘটেছে একজন স্লিপওয়াকিং রোগীর কারণে।"
ডা. লি দীর্ঘস্থায়ী অনিদ্রা রোগীদেরও চিকিৎসা দিয়ে আসছেন; এদের কয়েকজন তাকে জানিয়েছে, তারা শেষ যখন রাতে টানা কয়েক ঘণ্টার ঘুম দিয়েছিল, এরপর ইতোমধ্যে কয়েক বছর পেরিয়ে গেছে।
"মাঝে মাঝে তাদের গলা ধরে আসে, কাঁদতে থাকে। তবু এখানে এসে (চিকিৎসা নিতে) তারা আবার আশায় বুক বাঁধে। মানুষগুলোর অবস্থা সত্যিই দুঃখজনক", বলেন ডা. লি।
অত্যধিক পরিশ্রম, অবসাদগ্রস্ত এবং নিদ্রাহীনতা
উন্নত দেশগুলোর মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ায় আত্মহত্যার হারও সবচেয়ে বেশি; দেশটির নাগরিকরা লিকার সেবন এবং অ্যান্টি-ডিপ্রেসেন্টস পিল বা বিষণ্নতারোধী ওষুধ সেবনেও শীর্ষে রয়েছে।
মাত্র কয়েক দশকে দেশটি পৃথিবীর অন্যতম দরিদ্র দেশ থেকে বিশ্বের অন্যতম প্রযুক্তিগত উন্নত দেশে পরিণত হয়েছে। পপসঙ্গীতে কোরিয়া বিশ্বব্যাপী প্রভাব বিস্তার করছে।
একই পথে হাঁটছে সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশগুলো, কিন্তু দেশ দুটি তাদের প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু কোরিয়ার এমন কোনো লুকানো সম্পদ নেই। বরং কোরিয়ান নাগরিকদের সম্মিলিত জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ও কঠোর এবং দ্রুত পরিশ্রমের মাধ্যমে দেশটিতে আমূল পরিবর্তন এসেছে।
এরফলেই দেশটির মানুষেরা অমানুষিক পরিশ্রম করে অবসাদে পড়ছে এবং পর্যাপ্ত ঘুম হচ্ছে না তাদের।
অবাক করা বিষয় হলো, এই নিদ্রাহীনদের ঘিরেও দক্ষিণ কোরিয়ায় সম্পূর্ণ আলাদা একটি শিল্প গড়ে উঠেছে- ২০১৯ সালে এই ঘুম শিল্পের বাণিজ্য ধরা হয়েছিল ২৫০ কোটি ডলারের সমমূল্য।
ক্রমশ বড় হচ্ছে 'স্লিপ-এইড ইন্ডাস্ট্রি'
সিউলে শুধু ঘুমের সামগ্রী নিয়ে একেকটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোর গড়ে উঠেছে। ঘুম আনতে সহায়ক বিছানার চাদর থেকে শুরু করে উচ্চমানের বালিশ, ভেষজ ঔষধ, টনিক- কী নেই সেখানে!
পিছিয়ে নেই প্রযুক্তিও। অনিদ্রা দূর করতে নেওয়া হয়েছে প্রযুক্তির সহায়তা। বছর দুয়েক আগে ড্যানিয়েল টিউডর নামক একজন কোক্কিরি নামের একটি মেডিটেশন অ্যাপ চালু করেন- দাবি করা হয়, কোরিয়ান তরুণদের মানসিক চাপ দূর করতে সহায়ক সেই অ্যাপ।
কোরিয়ার অধিবাসীদের একটি বড় অংশ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। অথচ দেশটির তরুণেরা মেডিটেশন করাকে বয়স্কদের বিনোদন হিসেবে গণ্য করে! তাদের মতে, সিউলের অফিস কর্মীদের জন্য এসব ধ্যান-ট্যান কোনো কাজের কিছু নয়।
ড্যানিয়েল জানান, তরুণ কোরিয়ানদের কাছে অ্যাপটিকে আকর্ষণীয় হিসেবে প্রচার করতে তাকে মেডিটেশনকে একটি পশ্চিমা ধারণা হিসাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হয়েছিল।
অনেক ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানও এ কাজে যুক্ত হয়েছে এখন।
হিয়েরাং সুনিম একজন বুদ্ধ সন্ন্যাসী। তিনি সিউলের কাছাকাছি একটি বৌদ্ধমন্দিরে অনিদ্রার রোগীদের সহায়তা প্রদান করে থাকেন। তার তত্ত্বাবধানে নিদ্রাহীনতায় ভোগা লোকজন মন্দিরে এসে সময় কাটাতে পারে, মেডিটেশন চর্চা করতে পারে এবং বৌদ্ধ ধর্ম দর্শনের সাথে পরিচিত হতে পারেন।
অতীতে এ ধরনের প্রবণতা অবসর নেওয়া লোকেদের মধ্যে দেখা যেত। অবসরের পর তারা ধর্মচর্চা এবং প্রার্থনায় সময় অতিবাহিত করতে চাইতেন। কিন্তু এখন যাদের দেখা যায় তারা বেশিরভাগই বয়সে তরুণ এবং কর্মী।
হিয়েরাং সুনিম বলেন, "ঐতিহ্যগতভাবে অল্পবয়সীদের বৌদ্ধধর্ম শিক্ষা গ্রহণ করতে দেখাটা বিরল। কিন্তু মন্দিরে অবস্থানের সময়টাতে তারা অনেক কিছুর সংস্পর্শে আসতে পারে।"
প্রয়োজন মৌলিক পরিবর্তন
অত্যধিক কাজের চাপে পিষ্ট হয়ে কোরিয়ান নাগরিক লি হিয়ে-রি এমনই একটি 'বুদ্ধিস্ট রিট্রিটে' যোগ দিয়েছিলেন। সেখান থেকে ফিরে তার মত হলো, তিনি তার চাপের জন্য দায়িত্ব নিতে শিখেছেন।
হিয়ে-রির ভাষ্যে, "সবকিছু আসলে আমার থেকেই উৎপত্তি লাভ করেছে। সকল সমস্যার শুরুটা আমার মাধ্যমেই। এটাই সেখানে শিখেছি আমি।"
কিন্তু এভাবে মানসিক চাপ এবং অনিদ্রাজনিত সমস্যাকে কারো ব্যক্তিগত সমস্যা হিসেবে রূপ দেয়াটা কারো কারো কাছে আপত্তিকর ঠেকেছে।
যেসব কোরিয়ান বিশ্বাস করেন যে ঘুমের এই সমস্যাটি অযৌক্তিক কাজের সংস্কৃতি এবং সামাজিক চাপ থেকে সৃষ্ট- তারা এই ব্যক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা করেছেন। তাদের মতে, এটি আসলে 'ভিকটিম-ব্লেমিং' এর সমতুল্য।
এই সমালোচকরা বলেছেন, ধ্যান বা মেডিটেশন নয়, প্রকৃত সমাধান শুধুমাত্র সমাজে মৌলিক পরিবর্তনের মাধ্যমেই আসতে পারে।
লেখার শুরুতে জি-হিউনের কথা উল্লেখ করেছিলাম। জি-ইউন আর থাকতে না পেরে শেষ পর্যন্ত চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। ইদানিং তিনি একজন ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করছেন, মহামারির জন্য পাচ্ছেন হোম অফিসের সুবিধাও।
তার কথায়, "অনেক তো হলো দেশ গড়ার কাজ। এখনো কেন এত পরিশ্রম করে যেতে হবে! আমাদের একটু রিল্যাক্স করতে শেখা উচিত।"
সূত্র: বিবিসি