রাশিয়ার ওপর অবরোধ: পশ্চিমাদের জন্য কি 'নিজের পায়ে কুড়াল মারা'র ঘটনা হতে যাচ্ছে!
ইউক্রেনে রাশিয়া আক্রমণ চালানোর মাসখানেক পরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এক টুইট করেন। সেখানে নিজেদের দেওয়া নিষেধাজ্ঞাকে নজিরবিহীন উল্লেখ করে তিনি লিখেন, এর ফলে রুবল 'প্রায় সঙ্গে সঙ্গে রাবল (ইট-পাথরের ছোট টুকরা)-এ পরিণত হয়েছে'।
মার্চের ৭ তারিখে রাশিয়ান রুবলের মান প্রায় অর্ধেক কমে যায়। প্রতি মার্কিন ডলারের বিপরীতে রাশিয়ান মুদ্রার মান ১৪৩ রুবলে পৌঁছায়।
ফেব্রুয়ারির ২৪ তারিখে রাশিয়ার আক্রমণ চালানোর পর থেকেই পশ্চিমা দেশগুলো মস্কোর ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতে শুরু করে। প্রথম কয়েক সপ্তাহে রাশিয়ানদের মধ্যে আতঙ্ক শুরু হয়। তারা ব্যাংক থেকে যতটা সম্ভব নগদ টাকা তুলতে ও দোকান থেকে জিনিসপত্র আগাম কিনে রাখতে শুরু করেন। এপ্রিলে রাশিয়ায় জিনিসপত্রের দাম ১৭.৫ শতাংশ বেড়ে যায়।
কিন্তু পরের মাসে ভোল বদলে যায় রুবলের। ডলারের বিপরীতে রুবলের দাম জানুয়ারির তুলনায় ৪০ শতাংশ বেড়ে যায়, যা গত সাত বছরের তুলনায় সর্বোচ্চ। একইসাথে ২০২২ সালের সর্বোচ্চ কার্যকর মুদ্রায় পরিণত হয় রুবল।
রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন জানিয়ে দিয়েছিলেন ইউরোপের ক্রেতাদের রুবলের বিনিময়ে রাশিয়া থেকে গ্যাস কিনতে হবে, অন্যথায় তিনি গ্যাসের সরবরাহ বন্ধ করে দেবেন। এরকম আরও কিছু পদক্ষেপের কারণে ফের ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয় রুবল।
আইটিআই ক্যাপিটাল-এর প্রধান বিনিয়োগ স্ট্র্যাটেজিস্ট ইসকান্দার লুটস্কো রুবলের পক্ষে তিনটি ফ্যাক্টরের কথা জানান। এগুলো হচ্ছে, নিষেধাজ্ঞার কারণে তেলের দাম বৃদ্ধি, পুঁজির নিয়ন্ত্রণ, এবং ডলারের চাহিদার কিছু কমতি ও তেল-গ্যাস রপ্তানির কারণে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ফলে রিজার্ভের মাত্রাতিরিক্ত তারল্য সৃষ্টি।
লুটস্কোর মতে, নিষেধাজ্ঞা ও পুঁজির নিয়ন্ত্রণের কারণে রুবলের জন্য 'একটি কৃত্রিম ও উচ্চ-সহায়ক পরিবেশ তৈরি হয়েছে'। গত সপ্তাহে রুবলের অতিমূল্যায়ন ঠেকাতে রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত এক মাসে তৃতীয়বারের মতো সুদহার কমিয়েছে।
এসবের ফলে রাশিয়ার ব্যাংক ব্যবস্থায় বৈদেশিক মুদ্রার অতিরিক্ত তারল্য তৈরি হয়েছে, যার দরুন ডলারের দামের পতন ঘটেছে। এরকম ঘটনা ইতিহাসে বেশ বিরল।
জ্বালানিবাজার বিশেষজ্ঞ ভায়াশেস্লাভ মিশশেঙ্কো বলেন, যুদ্ধের প্রাক্কালে জনগণের আবেগীয় প্রতিক্রিয়া ও ব্যবসায়িক দিকগুলো; উভয়ই সফলভাবে সামলাতে পেরেছে রাশিয়ার অর্থনৈতিক কর্তৃপক্ষ।
'মানুষের ভয় পেয়ে জিনিসপত্র কেনা শুরু করার কারণে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গিয়েছিল। কারণ তারা চাচ্ছিলেন সবকিছু কিনে মজুত করে রাখতে,' বলেন মিশশেঙ্কো।
'তবে এপ্রিলের শুরুতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসতে শুরু করে। জিনিসপত্রের যোগান ঠিক থাকে, যদিও এটা সত্যি আমদানি করা জিনিসপত্র নিয়ে এখনো কিছুটা সংকট রয়েছে, তবে ওসব আমদানিপণ্যের পরিমাণ বেশি নয়। দ্রব্যমূল্যের দামবৃদ্ধির ক্ষেত্রে অর্থনৈতিকের চেয়ে মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব বেশি ছিল,' বলেন তিনি।
গত মাসে ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়ার জ্বালানির ব্যবহার ধীরে ধীরে বন্ধ করে দেওয়ার ব্যাপারে আলাপ অব্যাহত রাখলেও, পুতিন মনে করেন 'অর্থনৈতিক আত্মহত্যার দিকে যাচ্ছে' মহাদেশটি।
'মধুচন্দ্রিমার সময়'
বিশ্লেষকেরা বলছেন, নিষেধাজ্ঞার ধাক্কা সামলাতে এখন পর্যন্ত সঠিক পদ্ধতিগুলো গ্রহণ করেছে রাশিয়া। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, পশ্চিমারা কি নিজেদের এ নিষেধাজ্ঞার জের সামলাতে পারবে।
লুটস্কো বলেন, নিষেধাজ্ঞার প্রথম পাঁচ মাস রাশিয়ার অর্থনীতির জন্য 'মধুচন্দ্রিমার সময়ের মতোই' প্রতীয়মান হয়েছে। কিন্তু তেল ও গ্যাসের ওপর ইউরোপ যদি আরও কঠিন নিষেধাজ্ঞা দেয়, তাহলে 'রাশিয়ান সরকারের আর কিছুই করার থাকবে না'।
বিশ্বের মোট তেল ও পেট্রোলিয়ামজাত পণ্যের ২০ শতাংশই রাশিয়ার মালিকানাধীন। আর গ্যাসের ক্ষেত্রে এর পরিমাণ ১৭.৫ শতাংশ। ফলে রাশিয়া তেল-গ্যাসের সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারক। তাই এর একটি প্রভাব তৈরি হবে বলেই মনে করেন লুটস্কো।
রাশিয়ার সরকার বর্তমানে তাদের আয়ের ক্ষেত্রে তেল ও গ্যাস রপ্তানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে। রাশিয়ার বাজেটের ৬৫ শতাংশই এখন তেল-গ্যাসের অর্থ, ইউক্রেনে আক্রমণের আগে এ হার ছিল ৩০ শতাংশ।
দীর্ঘদিনের জল্পনাকল্পনার পর গত সোমবার ইইউ ঘোষণা দিয়েছে তারা এ বছরের শেষ নাগাদ রাশিয়া থেকে তেল আমদানি ৯০ শতাংশ কমিয়ে দেবে। বৃহস্পতিবার ষষ্ঠ এ নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি চূড়ান্ত করেছে ব্লকটি।
'রাশিয়ার বড় ছাড়'
লুটস্কোর মতে নিষেধাজ্ঞা রাশিয়ার জন্য এখন পর্যন্ত শাপে বর হিসেবেই কাজে দিয়েছে। মার্চের ২ তারিখের মধ্যে তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ১১০ মার্কিন ডলার হয়ে যায়, যেখানে আগে দাম ছিল ৬০ ডলার।
এছাড়া বছরের প্রথম তিন মাসে রাশিয়ার বাণিজ্য উদ্বৃত্ত রেকর্ড ৫৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছায়। 'রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ নিজের পায়ে কুড়াল মারছে,' বলেন লুটস্কো।
'বিশ্বের বড় বড় তেল আমদানিকারক দেশগুলোর জন্য এ নিষেধাজ্ঞা মন্দভাগ্য হিসেবে দেখা দিয়েছে। তবে চীনের মতো কিছু দেশ এ থেকে লাভ করেছে; তারা বিশাল ছাড়ে রাশিয়া থেকে তেল কিনছে। এটি আবার ইউরোপের ওইসিডিভুক্ত দেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্য সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে,' বলেন লুটস্কো।
'আমার মনে হয় এসব নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পেছনে মূল কারণ হচ্ছে একধরনের মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি করা, দেখানো যে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, পশ্চিমারা স্রেফ বসে বসে দেখছে না। কিন্তু এটা স্পষ্টত এ নিষেধাজ্ঞার ফলে বাস্তব পরিস্থিতি কী হবে, বিশেষত বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলো কী সমস্যায় পড়বে, তা বিবেচনায় আনা হয়নি।'
'বিপর্যস্ত বৈশ্বিক যোগান'
মিশশেঙ্কো মনে করেন, নিষেধাজ্ঞা থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার প্রসঙ্গে বর্তমান পরিস্থিতিতে ইইউ থেকে অধিকতর 'সুবিধা পাচ্ছে রাশিয়া'।
'বিশ্ববাজারে রাশিয়াকে প্রতিস্থাপন করা সম্ভব নয়, বিশেষত জ্বালানিপণ্যের ক্ষেত্রে তো প্রায় অসম্ভব। রাশিয়া ও পশ্চিমাদের মধ্যে উত্তেজনা যত বাড়বে, গ্যাসের মতো কিছু পণ্যের দাম ততই বাড়বে,' বলেন মিশশেঙ্কো।
ইইউ'র তেল আমদানির ৩৬ শতাংশ ও গ্যাস আমদানির ৪০ শতাংশের বেশি আসে রাশিয়া থেকে। মিশশেঙ্কো বলেন, গত কয়েক দশক ধরে রাশিয়া এর বাজার বহুমুখী করছে। ভারত, চীন, দক্ষিণপূর্ব এশিয়াসহ পূর্বের বিভিন্ন বাজার ও অন্যান্য অঞ্চলে রাশিয়ার পণ্যের চাহিদা রয়েছে।
চীন এখন রাশিয়ার বড় বাণিজ্য-অংশীদার। এর আগে ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখল করে নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়ার পর রাশিয়ার বড় বাণিজ্য-অংশীদার ছিল জার্মানি।
২০১৪ সালের আগে বিশ্বের অন্যতম বড় খাদ্য আমদানিকারক ছিল রাশিয়া। বর্তমানে এটি একটি রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে।
ভারত গত তিনমাস সময়ে আগের যেকোনো তিন মাসের চেয়ে রাশিয়া থেকে চারগুণ বেশি পরিমাণ অপরিশোধিত তেল ক্রয় করেছে। এর মাধ্যমে রাশিয়ার অপরিশোধিত তেলের সবচেয়ে বড় ক্রেতা হয়ে উঠলো ভারত।
তেল রপ্তানি থেকে মস্কো এখন প্রতি মাসে ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করে। ২০২২ সালের পর এটি তাদের তেল বাণিজ্যে ৫০ শতাংশ বেশি প্রবৃদ্ধি।
'ইউরোপের ক্রেতাদের রাশিয়ান পণ্যের বিকল্প খুঁজতে হবে, কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন সময়ের,' বলেন মিশশেঙ্কো।
'কিন্তু সমস্যা হচ্ছে কয়েক দশক ধরে ইউরোপের বাজারে পণ্যের বৃহৎ ও টেকসই যোগানদাতা ছিল রাশিয়া। তাই এখন রাশিয়ার ফাঁক পূর্ণ করতে কাঠখড় পোহাতে হবে ইউরোপীয় বাজারগুলোকে, আর এর ফলে অনেকবছর ধরে সাপ্লাই চেইনে অস্থিতিশীলতা থেকেই যাবে। নিজের প্রতিবেশীকে বাদ দিয়ে দূর থেকে খুচরা খুচরা পণ্য ক্রয় করাটা খুব একটা সহজ হবে না... আমার মনে হয় নিষেধাজ্ঞার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দু'পক্ষই,' বলেন মিশশেঙ্কো।
- সূত্র: আল জাজিরা