নিয়াজি ও অরোরার পেছনের চারজন কে?
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং পরবর্তী অর্ধ শতকে সবচেয়ে বেশি মুদ্রিত, সবচেয়ে বেশি প্রচারিত একক ফটোগ্রাফ কোনটি এই প্রশ্নের জবাব দিতে কাউকেই তেমন মাথা ঘামাতে হবে না। এটি ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১-এর সেই ঐতিহাসিক ছবি- রমনা রেসকোর্সে আত্মসমর্পন দলিল সই করছেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার কথিত টাইগার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ খান নিয়াজি। পাশে বসে তার সই করা দেখছেন ভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ড প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা। এই দু'জনের পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন চারজন সামরিক কর্মকর্তা। পোশাকের দিকে একটু নজর দিলেই বোঝা যায় তাদের দুজন সেনাবাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তা, একজন বিমান বাহিনীর এবং একজন নৌবাহিনীর। তাদের পেছনে ঘাড় উঁচিয়ে আরও কেউ কেউ দেখার চেষ্টা করছেন।
এই নিবন্ধটি সেই চারজনকে নিয়ে। বাম দিক থেকে এই চারজন হচ্ছেন ভাইস এডমিরাল নীলাকান্ত কৃষ্ণান, এয়ার মার্শাল হরিচান্দ দেওয়ান, লেফটেন্যান্ট জেনারেল সগৎ সিং এবং মেজর জেনারেল জে অফ আর জ্যাকব। চারজনের প্রত্যেকেই পাকিস্তানের পরাজয় ও আত্মসমর্পনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন সমর ইতিহাসে তো বটেই, বাংলাদেশ সৃষ্টির ইতিহাসেরও তারা স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
ভাইস এডমিরাল নীলাকান্ত কৃষ্ণান
১৯৭১ সালে ভারতের ইস্টার্ন নেভাল কমান্ডের ফ্ল্যাগ অফিসার কমান্ডিং-ইন চিফ ভাইস এডমিরাল নীলাকান্ত কৃষ্ণান গোয়েন্দা নেটওয়ার্কে যে সংবাদটি পেলেন তা বিচলিত হবার মতো। বিমানবাহী আইএনস ভিক্রান্ত ধ্বংস করার জন্য শক্তিশালী ও দ্রুতগামী পাকিস্তানী সাবমেরিন পিএনএস গাজিকে মোতায়েন করা হয়। ১৯৪৪ সালের ১ ডিসেম্বর কমিশন্ড হওয়া এই ফাস্ট অ্যাটাক টেঞ্চক্লাস ডিজেল-ইলেকট্রিক সাবমেরিনটি আমেরিকার, তখন নাম ছিল ডায়াব্লো, স্প্যানিশে এর মানে শয়তান। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ ভাগ থেকে অনেক সফল অভিযানের পর ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান সিকিউরিটি অ্যাসিস্ট্যান্স প্রোগ্রামের আওতায় এটি লিজ নেয় ১৯৬৪ সালে তা করাচিতে এসে পৌঁছে এবং ১৯৬৫ সালের ভারত পাকিস্তানের যুদ্ধে উপমহাদেশের একমাত্র সাবমেরিন হিসেবে অত্যন্ত সমীহের সাথে এটাকে দেখা হতো। ভারতীয় যুদ্ধ জাহাজ ভ্রিক্রান্ত বিশাখাপত্তম ঘাটিতে নেবার পর পাকিস্তানের নৌসজ্জা পরিবর্তন অনিবার্য হয়ে ওঠে। ১৪ নভেম্বর ১৯৭১ বঙ্গোপসাগর থেকে প্রায় ৩০০০ মাইল দূরে আরব সাগরে অবস্থানকালে গাজি ২টি মিশন গ্রহণ করে: একটি হচ্ছে আইএনএস ভিক্রান্ত সনাক্ত করা এবং ডুবিয়ে দেওয়া এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে বিশাখাপত্তম বন্দরে ঢোকার ও বেরোবার পথে মাইন স্থাপন করা।
ভাইস এডমিরাল কৃষ্ণান যে গোয়েন্দা তথ্য পেয়েছেন তা সঠিক কিন্তু উদ্বেগের কারণ হচ্ছে ভারতীয় জাহাজটির বয়লারে ফাটল ধরেছে এবং তখনকার অবস্থায় ঘন্টায় ষোলো নটিক্যাল মাইলের বেশি চালানো সম্ভব নয়। আর ভিক্রান্ত তখন বিশাখাপত্তমেও নেই, আছে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের কাছে। সে সময় আইএনএস রাজপুত্র নামের জাহাজটির জীবনচক্র শেষ হয়ে যাওয়ায় ডিকমিশন করার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। কৃষ্ণান রাজপুত্রের কমান্ডার ইন্দর সিংহ-কে আদেশ দিলেন জাহাজ থেকে প্রচুর ওয়ারলেস বার্তা পাঠাতে থাকুন যাতে পাকিস্তানি গাজি বিভ্রান্ত হয়ে মনে করে ভিক্রান্ত কাছাকাছি দূরত্বের মধ্যেই আছে। কৃষ্ণান ভিক্রান্তকে প্যারাবনের আড়ালে পাঠিয়ে দিলেন এবং তার নির্দেশে রাজপুত্র থেকে ডেপথচার্জ ডেস্ট্রয়ার পাঠিয়ে গাজিতে প্রবল বিস্ফোরণ ঘটানো হয় এবং ৪ ডিসেম্বর গভীর রাতে ১১ জন অফিসারসহ ৯৩ জনকে নিয়ে গাজির সলীন সমাধি ঘটে। (গাজির ডুবে যাওয়া নিয়ে বিতর্ক আছে, পাকিস্তান মনে করে ভারতীয় দাবি অসত্য, অভ্যন্তরীণ যান্ত্রিক কারণে ডেস্ট্রয়ার রাখা অংশে বিস্ফোরণ ঘটে, তাতে ক্রমাগত কয়েকটি বিস্ফোরণ ঘটে তাতে ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায়। ভারত তার দাবি থেকে সরে না এলেও নৌ সদর দফতর ২০১০ সালে গাজি সংক্রান্ত সকল কাগজপত্র পুড়িয়ে ফেলে, এতে সন্দেহ আরো ঘনীভূত হয়।)
বাস্তবতা হচ্ছে পূর্ব রণাঙ্গনের কাছাকাছি এসে পিএনএস গাজির সলিল সমাধিতে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল পাকিস্তানের হাতে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা লুপ্ত হয়ে যায়।
যুদ্ধের বাকী কদিন ভাইস এডমিরাল কৃষ্ণানের তত্ত্বাবধানে বঙ্গোসাগর আশঙ্কামুক্ত থাকে আর আমেরিকার সপ্তম নৌবহর যে আক্রমনের জন্য নয় দূর থেকে উপস্থিতি জানানোর জন্য সেটাও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
ভাইস এডমিরাল নীলাকান্ত কৃষ্ণান ৮ ডিসেম্বর ১৯১৯ তামিল পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তার বাবা মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ছিলেন। তিনি মার্কেন্টাইল মেরিন শিপে চাকরি করার জন্য প্রশিক্ষণ নেন এবং কিছুকাল চাকরি করেন। পরে রয়াল নেভিতে যোগ দিয়ে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ব্রিটেনের পক্ষে যুদ্ধে অংশ নেন। ভারতীয় নৌবাহিনীতে যোগ দিয়ে তিনি প্রথম ভারতীয় চিফ অব নেভাল স্টাফ নিযুক্ত হন।
একসময় বিমানবাহী আইএনএস ভিক্রান্তের তিনিই ছিলেন দ্বিতীয় কমান্ডিং অফিসার। ১৯৭১-এর মার্চে তিনি ভাইস অ্যাডমিরাল পদে পদোন্নতি পান এবং ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডিং ইনচিফ নিয়োগ লাভ করেন।
পাকিস্তান ইস্টার্ন কমান্ডের ফ্ল্যাগ অফিসার রিয়াল এডমিরাল মোহাম্মদ শরিফ ১৬ ডিসেম্বর ৪টা ৩৯ মিনিটে তার টিটি পিস্তল কৃষ্ণানের হাতে তুলে দিয়ে বলেন, এডমিরাল কৃষ্ণান, স্যার, আমি এখনি নিরস্ত্র হচ্ছি। আপনার নৌবাহিনী অত্যন্ত দক্ষতার সাথে লড়াই করেছে, সব জায়গাতেই আমাদের কোনঠাসা করে রেখেছে। আমি ভারতীয় ইস্টার্ন ফ্লিটের কমান্ডার ইন চিফ ছাড়া অন্য কারো কাছে আত্মসমর্পণ করতে পারি না।
ভারত সরকার নীলাকান্ত কৃষ্ণানকে পদ্মভূষণ খেতাব দেয়। দু'বছর বর্ধিত চাকরি করে ১৯৭৩ সালে অবসর নেন। ৩০ জানুয়ারি ১৯৮২ ঘুমের মধ্যে তার মৃত্যু হয়। তিনি দুটো বই লিখেছেন। ১৯৭১-এর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ নিয়ে 'নো ওয়ে বাট টু সারেন্ডার-অ্যান অ্যাকাউন্ট অব ইন্দো-পাক ওয়ার ইন দ্য বে অব বেঙ্গল, এবং তার আত্মজীবনী 'অ্যা সেইলর্স স্টোরি'।
এয়ার মার্শাল হরি চাঁদ দেওয়ান
নিয়াজি যখন আত্মসমর্পণ করছিলেন উপস্থিত ছিলেন ভারতীয় বিমান বাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান এয়ার মার্শাল হরি চান্দ দেওয়ান। ১৯৭১-এর যুদ্ধে এয়ার মার্শাল হরি চাঁদ দেওয়ান তার বিমান বাহিনীর দক্ষতা দেখাবার তেমন সুযোগ পাননি। একাত্তরের যুদ্ধ ছিল মাত্র ১৩ দিনের পক্ষান্তরে ১৯৬২-র ভারত চীন যুদ্ধে লড়াইটা চলেছে ৩১ দিন।
যুদ্ধের শুরুতেই ভারতীয় বিমান বাহিনীর বোমা বর্ষণে তেজগাঁও এয়ারপোর্টের রানওয়ে বিধ্বস্ত হয়ে যাওয়ায় পাকিস্তান বিমানবাহিনীর পক্ষে হেলিকপ্টার উড়ানো ছাড়া আর কোনো সুযোগ ছিল না।
হরি চান্দ দেওয়ানের জন্ম ২০ সেপ্টেম্বর ১৯২১। ১৯ বছর বয়সে ১৯৪১ সালে এয়ারফোর্সে কমিশন লাভ করেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় তিনি বার্মাতে দায়িত্ব পালন করেন। বিভিন্ন কমান্ড ও স্টাফ পজিশনে কৃতিত্বের সাথে সেবা প্রদান করে পুরস্কৃত হন। ১৯৪২ সালে ব্রিটেনে ফ্লাইং ইনস্ট্রাক্টর প্রশিক্ষণ নেন, ১৯৪৮-৪৯ সালে রয়াল এয়ারফোর্স স্টাফ কলেজে উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ১৯৬২ সালে চীনের ভারত আক্রমণের সময় তিনি ইস্টার্ন কমান্ডের এয়ার ফোর্স প্রধান এবং ভারপ্রাপ্ত এয়ার মার্শাল এবং ১৯৭২ সালে এয়ার মার্শাল হন। ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৬ ডেপুটি চিফ অব এয়ার স্টাফ এবং অতঃপর ভাইস চিফ অব এয়ার স্টাফ পদ থেকে অবসরে যান। ২২ আগস্ট ২০১৭ তিনি মৃত্যুবরণ করেন। একাত্তরের কৃতিত্বের জন্য ভারত সরকার তাকে পদ্মভূষণ খেতাব দিয়েছে।
লেফটেন্যান্ট জেনারেল সগৎ সিং
ফিল্ড মার্শাল মানেকশ একবার বলেছেন, আমরা জানতাম কেউ যদি বলে মৃত্যুকে ভয় পান না তা হলে তিনি হয় মিথ্যে বলছে নয় তিনি গুর্খা, আমি এর সাথে যোগ করতে চাই অথবা তিনি সগৎ সিং।
সাধারণ সেপাই হিসেবে সেনাবাহিনীতে নাম লিখিয়ে লেফটেন্যান্ট জেনারেল হিসেবে বিদায় নেবার নজিরও দুর্লভ, এই কৃতিত্ব সগৎ সিং-এরই। একাত্তরের ৩ ডিসেম্বর যে যুদ্ধ শুরু হলো সে যুদ্ধের ষষ্ঠ দিন অর্থাৎ ৯ ডিসেম্বর ১৯৭১ ভারতীয় চতুর্থ কোরের (আসামের তেজপুরে যার প্রধান ঘাটি) কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল সগৎ সিং মেঘনার পূর্ব পাড়ে দাঁড়িয়ে আগামী দিনের দৃশ্যগুলো কল্পনা করে নিজের পরিকল্পনা ঠিক করে নিচ্ছেন। তিনি জানেন ঢাকা দখল করতে পারলেই যুদ্ধ শেষ। কিন্তু হেডকোয়ার্টাসের চাওয়াটা ভিন্ন। তদের চাওয়া প্রান্ত থেকে দখল করতে করতে কেন্দ্রে আসতে হবে। কমান্ড না মানার অভিযোগ তার বিরুদ্ধে আগেও ছিল, এ জন্য তাকে সতর্কও করা হয়েছে। কিন্তু তিনি লড়াই করেন নিজের কমান্ডে। যখন ব্রিগেডিয়ার ছিলেন গোয়া দখল করে ভারতভুক্ত করার সময়ও তিনি কমান্ড মানেননি। সে সময় পর্তুগাল সরকার তার মাথার জন্য ১০০০০ ডলার পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। তার কাছে যে হেলিকপ্টার তাতে ১৭ জন করে পারাপর করা যেতে পারে। ৪০০০ ফুট প্রশস্ত মেঘনা তাকে পেরেতেই হবে। প্রশস্ত এই নদী পার হবার মতো একমাত্র সেতু আশুগঞ্জ ব্রিজ শত্রু ঠেকাবার কৌশলগত কারণে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি ইউনিট আগেই উড়িয়ে দিয়েছে।
একটি হেলিকপ্টারে তিনি একটি রিকনাইস্যান্স মিশনে, গোপন অনুসন্ধানী অভিযানে বের হলেন। হেলিকপ্টার যখন নিচু উচ্চতায় ভৈরবের আকাশে, পাকিস্তানি মেশিনগান হেলিকপ্টারটিকে টার্গেট করে এবং অরিরাম গুলিবর্ষণ করতে থাকে। অল্পের জন্য তিনি বেঁচে যান, একটি গুলি একেবারে মাথার পাশ দিয়ে গেছে। হেলিকপ্টারের উইন্ডশিল্ড চুরমার হয়ে যায়। পাইলট গুলিবিদ্ধ হন। স্ল্পিন্টারের আঘাতে সগৎ সিং এর কপাল ও হাত রক্তাক্ত হয়ে ওঠে। তাকে পরবর্তী অপারেশনের আগে অন্তত ২৪ ঘন্টার বিশ্রাম নেবার পরামর্শ দেওয়া হয়। কিন্তু এর আগেও তিনি একাধিকবার মৃত্যুর কাছ থেকে ফিরে এসেছেন, জখমকে তিনি পাত্তাই দিলেন না। হাত ও কপালের ড্রেসিং নিয়ে পরের হেলিকপ্টারে তার দলকে নেতৃত্ব দেবার জন্য 'হেলিবোর্ন অপারেশনে' সবার আগে রণক্ষেত্রে এসে হাজির হলেন।
ক্যাপ্টেন চন্দন সিং-এর নেতৃত্বে এমআই ৪ হেলিকপ্টারে প্রতি খেপে ঝুঁকি নিয়ে ২৩ জন করে পুরো ৩১১ ব্রিগেডকে মোট ১০৪টি ফ্লাইটে মেঘনা পার করা হয়।
৭৩ ব্রিগেড মেঘনা পার হলো নৌ ও স্পিড বোটে। পরদিনই মার্কিন রণতরী এন্টারপ্রাইজ ও সপ্তম নৌবহর বঙ্গোসাগরমুখী হয়েছে বলে খবর এসেছে। এ সময় ৩০০০ সৈন্য আর ৪০ টন রসদ ও ভারী মারনাস্ত্র নিয়ে লেফটেন্যান্ট জেনারেল সগৎ সিং তখনকার প্রশস্ত মেঘনার পশ্চিম পাড়ে অবস্থান নেন। তাদের সামনে ঢাকা দুর্গ এবং বিজয়ের সরনি। মেঘনা পেরিয়ে ঢাকায় অবস্থান নেবার খবর ইন্দিরা গান্ধীর কাছে পৌঁছলে তিনি তখনই সেনাবাহিনীকে অভিনন্দন জানালেন। একাত্তরের যুদ্ধে ভারতীয় বিমান ও সেনাবাহিনীর মেঘনা অতিক্রমই ঢাকার দ্রুত পতন এবং যুদ্ধের ফলাফল ঘোষণা করে। নিয়াজির দুর্ভেদ্য ঢাকা দুর্গে ভারতীয় গোলা এসে বিস্ফোরিত হবার পরও নিয়াজি শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে লড়াই করার ঘোষণা দেবার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই ভেঙ্গে পড়লেন। ১৬ ডিসেম্বর যখন জেনারেল নিয়াজির সাথে তাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় বিষ্মিত নিয়াজি বলেন, 'ওহ মাই গড! আপনি একটি অবিশ্বাস্য কাজকে সম্ভব করেছেন।'
সগৎ সিংকে নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মুল্যায়নটি ছিল যথার্থ। তারা তাদের বাহিনীকে এই বলে সতর্ক করেছিল যে এই সৈনিকটি জীবনে কোনোদিন পরাজিত হয়নি।
বাংলাদেশ ও মেঘনা নদী তার জীবনকে এতোটাই আলোড়িত করেছে যে, চাকরিজীবন শেষ করে যখন জয়পুরে বসতি স্থাপন করলেন বাড়ির নাম রাখলেন 'মেঘনা'। যখন নাতনি জন্মগ্রহণ করল তার নামও রাখলেন মেঘনা। ভারতীয় হাই কমান্ডের অনুমোদনহীন এই মেঘনা পারাপার যুদ্ধে গতি পাল্টে দিল, তরান্বিত হল আত্মসমর্পণ।
লেফটেন্যান্ট জেনারেল সগৎ সিংকে ভারত সরকার পদ্মভূষণ খেতাব দিয়েছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে ভারতেই আওয়াজ উঠেছে সগৎ সিংকে ভারতরত্ন খেতাব দেওয়া উচিত। বাংলাদেশ সগৎ সিং এর পুত্র রণ বিজয় সিংকে আমন্ত্রণ জানিয়ে তার বাবার জন্য স্বীকৃতি ও সম্মানের পদক অর্পন করেছে।
সগৎ সিং তার জীবদ্দশায়ই লিজেন্ড হয়ে উঠেছিলেন। ভারতে জ্যেষ্ঠ জেনারেলরা বলেছেন, ভারত আর কখনো সগত সিং এর মতো কোনো সৈনিকের দেখা পাবে না।
সগৎ সিং-এর জন্ম ১৪ জুলাই ১৯১৮ রাজস্থানের একটি নিম্নবিত্ত রাজপুত পরিবারে। তার বাবা ব্রিজ লাল সিং প্রথম মহাযুদ্ধের সৈনিক, তিনি মেসোপটোমিয়া, প্যালেস্টাইন এবং ফ্রান্সের রনাঙ্গণে যুদ্ধ করেছেন। তিনি সেপাই থেকে অনারারি ক্যাপ্টেন হয়ে অবসর গ্রহণ করেন।
১৯৩৮ সালে কলেজ ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েই সগৎ ১৯৩৮ সালে বিকানার গঙ্গা রিসালাতে নায়েক হিসেবে যোগ দিয়ে (জমাদার পদোন্নতি পেয়ে এখন পদটি নায়েব সুবাদার) একটি প্ল্যাটুন কমান্ড করার দায়িত্ব পেলেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় কজন জেসিও-র (জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার) সাথে তিনি কমিশন পেয়ে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হলেন। তাকে ব্রিটিশ ফোর্সের একজন হিসেবে পাঠিয়ে দেওয়া হলে ইরাকে, তিনি হলেন মিলিটারি ট্রান্সপোর্ট অফিসার, তারপর ইরানে ইন্ডিয়ান ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডে। ১৯৪৯ সালে তিনি চলে এলেন ভারতীয় সেনা বাহিনীর গুর্খা রাইফেলস-এর। ১৯৫৫ সালে লেফটেন্যান্ট কর্নেল হয়ে থার্ড গুর্খা রাইফেলস এর সেকেন্ড ব্যাটালিয়নের কমান্ডার হলেন। ১৯৬১ সালে পর্তুগিজ দখল থেকে গোয়া মুক্ত করে ভারতভুক্ত করার লড়াইয়ের অন্যতম প্রধান পরিকল্পনাকারী তিনি। ১৯৬৫ সালে তিনি মেজর জেনারেল হন ১৭ মাউন্টেন ডিভিশনের দায়িত্ব নেন, ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে লেফটেন্যান্ট জেনারেল হয়ে ফোর্থ কোরের কমান্ড গ্রহণ করেন। তার জীবনের সেরা অর্জন ১৯৭১-এর বিজয়। দুর্ভাগ্য তার, একাত্তরের যুদ্ধের পর তারই অধঃস্তন লেফটেন্যান্ট জেনারেল কে কে সিংকে তার বস বানিয়ে দেওয়া হয়।
তার স্ত্রী কমলা কুমারী জম্মু ও কাশ্মীরের প্রধান বিচারপতি রচপাল সিং-এর কন্যা। ২৬ সেপ্টেম্বর ২০০১ তিনি দিল্লির সেনা হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।
হিন্দি চলচ্চিত্র 'পল্টন'-এ জ্যাকি স্রফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল সগৎ সিং-এর ভূমিকায় অভিনয় করেন।
লেফটেন্যান্ট জেনারেল জে এফ আর জ্যাকব
জন্ম ১৯২৩ সালে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির কলকাতায়, ইরাক থেকে আগত এক বাগদাদি ইহুদি পরিবারে। আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময়ে পরিবারটি কলকাতায় এসে বসতি স্থাপন করে। তার বাবা এলিয়াস ইমানুয়েল ধনাঢ্য ব্যবসায়ী। জ্যাকব পড়াশোনা করেছেন দার্জিলিংয়ের বোর্ডিং স্কুলে। ১৯৪২-এ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ-ইন্ডিয়ান আর্মিতে যোগ দেন। তার বাবা চাননি তিনি সৈনিক হিসেবে জীবন কাটান, পরে ছেলের গোয়ার্তুমি ও প্র্রতিষ্ঠিত হরার সম্ভাবনার কথা ভেবে জ্যাকবের সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত মেনে নেন। ১৯৪৩-এ তাকে আর্টিলারিতে নিয়োজিত করা হয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে আফ্রিকান ক্যাম্পেইন, সুমাত্রা ও বার্মায় তিনি সক্রিয় থাকেন। জ্যাকব যখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে যান সাথে নিয়েছিলেন অক্সফোর্ড অব মর্ডান ভার্স। আধুনিক কবিদের রচনা তার পছন্দের, তিনি ডব্লিউ বি ইয়েটস, জি ডব্লিউ হপকিন্স, ডব্লিউ ই হেনলে, প্যাড্রিক কলামের কবিতা পড়তেন। তার বিশেষ পছন্দ ওয়ার পোয়েমস-যুদ্ধের কবিতা।
ইংল্যান্ড ও আমেরিকার আর্টিলারি স্কুলের গ্র্যাজুয়েট জ্যাকব ১৯৬৫-র ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে রাজস্থানে একটি ইনফেন্ট্রি ডিভিশনের নেতৃত্ব দেন। ১৯৬৭ সালে মেজর জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি পান।
১৯৬৯ থেকে ইস্টার্ন কমান্ডের চিফ অব স্টাফ। এ সময়ই তিনি পান পেশাগত জীবনের সবচেয়ে বড় সাফল্য। ১৯৭১-এ ঢাকার রেসকোর্সে পাকিস্তানি লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজির আত্মসমর্পণের প্রধান কারিগর জেনারেল জ্যাকব। ৩৭ বছর ব্রিটিশ ভারতীয় এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীতে চাকরি শেষে তিনি ১৯৭৮ সালে অবসর গ্রহণ করেন। পরে ভারতীয় জনতা পার্টিতে (বিজেপি) যোগ দিয়ে দলের নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন।
'মুক্তিবাহিনীকে সহায়তা করতে সরকারের আদেশ পাই। সীমান্ত এলাকায় ক্যাম্প স্থাপন করা হয়, আমাদের বিভিন্ন এজেন্সি তাদের প্রশিক্ষণ দেয় এবং অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সহায়তা করে।'
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে এ মুক্তিবাহিনী পরে ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তারা এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করে, যেখানে পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী সম্পূর্ণভাবে মনোবল হারিয়ে ফেলে; আক্রান্ত না হয়ে তাদের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার কোনো উপায় ছিল না। তাদের অবদান অপরিসীম। তারা পাকিস্তানিদের যোগাযোগ পথ ও মাধ্যমে আক্রমণ চালায়, তাদের মনোবল ভেঙে দিয়ে আমাদের অগ্রগতি অনেক সহজ করে দেয়।
১৫ ডিসেম্বর অস্ত্রবিরতির আদেশ হয়। সোভিয়েত ব্লকের দেশ পোল্যান্ড নিউইয়র্কে ১৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় জাতিসংঘ অধিবেশনে পোলিশ রেজল্যুশন উত্থাপন করে। তখন এ প্রান্তে ১৬ ডিসেম্বর ভোরবেলা। এ প্রস্তাবে ভারতকে আগ্রাসনের জন্য দায়ী করে নিন্দা না জানানোর কারণে ক্ষিপ্ত হয়ে ভুট্টো তা ছিঁড়ে ফেলেন।
'১৬ ডিসেম্বর সকালে মানেকশ আমাকে ফোন করে বললেন, 'যাও, ওদের আত্মসমর্পণ করাও।' আমি জিজ্ঞেস করি, কোন শর্তে? আমি এর মধ্যে একটা খসড়া আত্মসমর্পণপত্র পাঠিয়েছি। আমি কি এটা নিয়ে দরকষাকষি করব। তিনি বললেন, 'কী করতে হবে তা তুমি জানো, যাও।'
'শেষ পর্যন্ত আমি বললাম, জেনারেল আপনি আত্মসমর্পণ করুন আমি আপনার, আপনার পরিবারের, সংখ্যালঘিষ্ঠদের এবং সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করব। আপনাদের সঙ্গে সম্মানজনক আচরণ করা হবে। যদি তা না করেন আপনার বা আপনার পরিবারের ভাগ্যে কী ঘটবে, আমি তার কোনো দায়িত্ব নিতে পারব না। আরো বলতে হচ্ছে, তাহলে এখনি যুদ্ধ পুনরায় শুরু করা ছাড়া আমাদের আর কোনো পথ খোলা থাকবে না। আমি আপনাকে ৩০ মিনিট সময় দিচ্ছি।
আমি কাগজটা হাতে নিয়ে উপরে তুলে বললাম, তাহলে আপনি এটা গ্রহণ করেছেন বলে আমি ধরে নিতে পারি।
তার চোখ তখন অশ্রুসিক্ত। অন্যান্য পাকিস্তানি জেনারেল ও অ্যাডমিরালদের ক্ষুব্ধ চাহনি। 'আত্মসমর্পণ গ্রহণ করা ছাড়া আমার জন্য কোনো আদেশ নেই, কোনো পরামর্শ নেই। কী সই হতে যাচ্ছে তাও আমি জানি না।'
সই হওয়ার জন্য যা এল দুই সপ্তাহ পর তা কলকাতায় আবার সই করতে হলো। স্বাক্ষরিত আত্মসমর্পণ দলিলটি ভুল ছিল।
নিয়াজি বললেন, আমি আমার অফিসে আত্মসমর্পণ করব। আমি বললাম, ঢাকার মানুষের সামনে রেসকোর্সে আত্মসমর্পণ হবে, আমি সেভাবেই নির্দেশনা পাঠিয়েছি।
তিনি লিখেছেন, আমরা ৯৩ হাজার যুদ্ধবন্দি নিয়ে যাই।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তার স্মরণীয় অবদান রয়েছে। কিন্তু মুক্তিবাহিনী বিজয়ের যে ক্ষেত্রটি তৈরি করে দিয়েছে, সে গৌরবটুকু প্রদান করতে তিনি কিছুটা কার্পণ্য করেছেন। জ্যাকবের স্মৃতিকথা 'সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা: বার্থ অব এ নেশন' সুখপাঠ্য। কিন্তু এতে তিনি নিজেকে যতটা কীর্তিমান হিসেবে দেখাতে চেয়েছেন, বাস্তবে তা সত্য ছিল কিনা এ নিয়ে তখনকার ভারতীয় সৈনিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা প্রশ্ন রেখেছেন।
১৯৭১-এ তিনি ছিলেন মেজর জেনারেল এবং ভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ডের চিফ অব স্টাফ। তার সরাসরি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা। সবার উপরে সেনাপ্রধান জেনারেল স্যাম মানেকশ।
জ্যাকব লিখেছেন, মানেকশ ঢাকাকে গুরুত্বই দেননি, অন্য সব শহর দখল করতে বলেছেন। জেনারেল ইন্দরজিৎ গিল বলেন, যখন প্র্রাথমিক পরিকল্পনা করা হয় তখন ঢাকা অন্তর্ভুক্ত না করার কারণ ভিন্ন। তখন যথার্থই ধরে নেওয়া হয়েছিল অস্ত্রবিরতি বলবৎ করার আগে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান দখন করার সামর্থ ইস্টার্ন কমান্ডের ছিল না। অগাস্টেই ঢাকাকে মূল লক্ষ সাব্যস্ত করা হয়। তবে নভেম্বরে সেনাসদর তাতে অনুমোদন দেয়। নভেম্বরের শেষ দিকে পরিকল্পনা সংশোধন করে ঠিক করা হয় যে ফোর্থ কোর মেঘনা নদী অতিক্রম করে পূর্ব দিক থেকে ঢাকার দিকে যাবে; ৯৫ মাউন্টেইন ব্রিগেডকে নিয়ে ১০১ কমিউনিকেশন উত্তর দিক থেকে ঢাকায় দিকে আসবে।
পাদটীকা:
১৯৯৫-এর শেষদিকে বিলেতে লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের উল্টো দিকের একটি কফিশপে ক'জন পাকিস্তনি তরুণের অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় বেশ কৌতুক বোধ করি। তাদের কথার সারাংশ হচ্ছে: ১৯৭১-এর যুদ্ধে পাকিস্তান হেরেছে এটা সত্য, বাংলাদেশ হয়েছে এটা সত্য। কিন্তু আর একটি সত্য হচ্ছে, পাকিস্তানের মুসলমানদের ভারতের কোনো হিন্দুর কাছে আত্মসমর্পণ করতে হয়নি। কারণ ১৯৭১-এর যুদ্ধে তিন গুরুত্বপূর্ণ জেনারেল- মানেকশ হচ্ছেন পারসিক, জগজিৎ সিং অরোরা শিখ এবং জ্যাকব হচ্ছেন ইহুদি, হিন্দু কেউ নন।
পরাজিত মানুষও সুখ পেতে জানে।