ভারতবর্ষের হারানো সৌরভের ঘ্রাণ ও মাদকতা
পাহাড়ের চূড়ায়, জঙ্গল ঘেরা মালভূমিতে অবস্থিত মধ্য ভারতের মানডু শহরে পৌঁছুতে হলে একটি অপ্রসস্থ রাস্তা ধরে খাড়া উঠে যেতে হয়। পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছুলে দেখা যায় কিছু ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রাসাদ, ফাটল ধরা গম্বুজ এবং জনমানবশূন্য তোরণ। এখানেই এক কালে সৌরভ নিয়ে ঘটেছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা।
গিয়াস শাহ ১৪৬৯ সালে মালওয়ার সুলতান হিসেবে অভিষিক্ত হন। সেসময় মালওয়া রাজ্যের সুলতান মধ্য ভারতের সিংহভাগ অঞ্চল শাসন করতেন। অভিষেকের সময় দেওয়া ভাষণে তিনি রাজ্য আইনে একটি বৃহৎ পরিবর্তনের ঘোষণা দেন। জানান, তিনি প্রায় ৩৪ বছর তরবারীর সাহায্যে তার পিতার সাম্র্যাজ্য বাড়ানোর কাজে সাহায্য করেছেন। এখন তিনি আর রাজ্যের প্রবৃদ্ধি ঘটানোর কাজে উৎসাহী নন। তার পুত্র নাসির শাহ দৈনন্দিন রাজ্য শাসনের কাজ করবেন, আর তিনি একটু আরাম-আয়েশে দিন পার করতে চান। পরজগতের প্রস্তুতির আগে জাগতিক কিছু সুখ আস্বাদন করতে চান।
বিপুল উদ্যমে শাহ তার যুদ্ধ-বিগ্রহহীন সময়ে গা ভাসিয়ে দিলেন। তিনি সামন্ত রাজাদের সুন্দরী কন্যা এবং আরও ১৬ হাজার দাসীকে রাজধানীতে নিয়ে আসেন, এবং তাদের জন্য বিলাসী প্রাসাদ এবং তাতে পদ্ম ফুলের আকৃতির আমোদ-পুকুর বানিয়ে দেন। তাদের প্রতিভা এবং ঝোঁক অনুযায়ী নাচ ও অভিনয় শিল্পে তালিম দেওয়া হয়। বাকিদেরকে সংগীত কিংবা বাঁশি বাজানোর তালিম দেওয়া হয়। অল্প কয়েকজনকে কুস্তিগির হিসেবেও গড়ে তোলা হয়। আর রাজকন্যাদের মধ্যে যারা সবচেয়ে চৌকস ছিলেন, তাদেরকে উচ্চ শিক্ষা প্রদান এবং মাঝে মধ্যে তাদেরকে সুলতানের সঙ্গে খাবারের টেবিলে বসার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হতো।
কাউকে কাউকে প্রশাসনের বিভিন্ন দায়িত্বও দেওয়া হয়, আর কাউকে কাউকে হিসাবরক্ষণ কিংবা রাজ্যের বিভিন্ন কারখানা পরিচালনার কাজও দেওয়া হয়। এক পর্যায়ে সেই প্রাচীরঘেরা, পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত দূর্গটি রক্ষার দায়িত্বও অর্পিত হয়েছিল পাঁচশ বর্মসজ্জিত হাবশী মহিলাদের ওপর।
রাজকার্য থেকে সুলতান অবসর নিয়ে শুরু করেন জাগতিক আনন্দ ও রসনার উৎসসমূহের বিস্তারিত বর্ণনা সমৃদ্ধ পুস্তক রচনা। এ সময়েই তিনি রচনা করেন "নি'মাতনামা" বা "দ্য বুক অব ডিলাইটস"। বিখ্যাত এ বইয়ের মূল পান্ডুলিপিটি এখনো সংরক্ষিত আছে বৃটিশ মিউজিয়ামে। এর আগে বিভিন্ন মোঘল সম্রাট ও টিপু সুলতানের আগ্রহী হাত ঘুরে শেষে এই বই দখলে আসে লুটেরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে আসে, ১৭৯৯ সালে। তারপর কাচের দেয়ালে বন্দী হয়ে নি'মাতনামার স্থান হয় লন্ডন শহরের ধূসর আকাশের নিচে, ব্রিটিশ মিউজিয়ামে।
নি'মাতনামা হলো রসনাবিলাস ও মানুষের জীবন ও আমোদপ্রমোদের বিস্তারিত বর্ণনা সম্বলিত অনন্য একটি দলিল। এতে রয়েছে নানা বিষয়ের ওপর সুলতানের নানা উপদেশ, মতামত। যেমন, কোথায় কীভাবে এবং কী শিকার করতে হবে (এখানে প্রস্তুতির একটি জরুরি বিষয় হিসেবে সুলতান প্রস্তাব করেছেন, বাসা থেকে বের হবার আগে নিজের প্রেয়সীর একটি ছবি অবশ্যই সঙ্গে নিতে হবে। ভোলা যাবে না, নিজের পায়ে কর্পুর মাখিয়ে নিতে হবে, সঙ্গে নিতে হবে শিকারি চড়ুই ও বাজপাখি, এবং পারলে একটি বা দুইটি চিতাবাঘও! বিস্ময়কর প্রস্তাব!)।
এসবের সঙ্গে রয়েছে পাতার পর পাতা বিভিন্ন রন্ধনপ্রণালী, যেখানে সমুচা বানানোর নির্ভুল পন্থাও বলা হয়েছে, (জাফরান, বড় বেগুন ভাজা এবং আদা দিতেই হবে)। যৌনতার বিষয়েও আছে নানা খোলামেলা বর্ণনা। এক জায়গায় তিনি যৌনতার কথা বলতে গিয়ে বলছেন: দুধ এবং ঘিয়ে ভাজা চড়ুই পাখির মগজ খেতে হবে নিয়মিত। তারপর নারীসঙ্গে যাওয়ার আগে শরীরে ভেষজ নির্যাস থেকে তৈরি সুগন্ধ তৈল, এলাচ, তিব্বতি কস্তুরি মেখে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। এতে সুলতান দাবী করেছেন, এ সব কিছুর সন্নিবেশে আসবে "তীব্র কামনা, এবং হৃদয়ে অর্পিত হবে উল্লাস।"
তবে নি'মাতনামার সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে ঘ্রাণমূলক তৃপ্তি এবং বিভিন্ন সুগন্ধি দ্রব্য নিয়ে ঘোর। গিয়াস শাহ আনন্দবাদী দার্শনিকদের মতো করে সুগন্ধি দ্রব্যকে জীবনে যেমন গুরুত্ব দিয়েছেন, তা এ সময়ে পাশ্চাত্যের মানুষের মদিরা নিয়ে উম্মাদনার সঙ্গে কেবলমাত্র তুলনীয়। বইয়ের অর্ধেক জুড়ে রয়েছে কীভাবে গোলাপজলকে পরিশোধন করা যায়, সে ব্যাপারে উপদেশ, এবং বিভিন্ন ধূপ, দুর্গন্ধনাশক পদার্থ এবং সুগন্ধি মলম বানানোর পদ্ধতির বর্ণনা। বেশ কিছু অধ্যায়ে বর্ণিত হয়েছে বিভিন্ন প্রসাধনী দ্রব্যের বিস্তারিত প্রস্তুত প্রণালী। এ বইয়ে সুগন্ধযুক্ত চূর্ণের আবিরের প্রস্তুত প্রণালীও বলা হয়েছে। আবিরের সুগন্ধকে আরও বাড়িয়ে তোলার জন্য একটি বিস্ময়কর উপাদানের তালিকা দেওয়া হয়েছে সঙ্গে; যাতে রয়েছে আম, অম্বর, জাফরান, কস্তুরি, সাদা চন্দন, তিলের তেলের নির্যাস, মিষ্টি পুদিনা, হলুদ, এলাচ ও চন্দনের নির্যাসসহ আরও বেশ কয়েকটি উপাদান।
নারী দেহকে সুরভিত করার জন্য উনি যে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন তা সবচেয়ে উঁচুমানের সুগন্ধি দ্রব্য তৈরির প্রস্তুত প্রণালীর চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। তার ভাষায়—"প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে সুগন্ধি মাখুন", এবং "গুড়া করা প্রসাধনীর পেস্ট নিন, গোলাপজলে হাত ধুয়ে নিন। তারপর আম গাছ, জংলি ডুমুর গাছ এবং বোধি গাছের গুঁড়ি থেকে আহরণ করা নির্যাস দিয়ে সারা শরীর ধুয়ে ফেলুন। সারা শরীরে সুগন্ধি পেস্ট, প্রসাধনী এবং চন্দন মাখিয়ে ফেলুন। মুখে কস্তুরির নির্যাস, গলায় চন্দন, কপালে গোলাপজল মাখিয়ে জুঁই ফুলের সুগন্ধ যুক্ত আবির তৈরি করুন। রুমালে এই সুগন্ধি মাখুন এবং পুরো শরীরকে গোলাপজল দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। সাদা চাদর ব্যবহার করুন, এবং তাতেও সুগন্ধি যুক্ত করুন।'
"বুক অব ডিলাইটস" সুগন্ধির ইতিহাস জানার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ, কারণ এই বইয়ের মাধ্যমেই প্রথমবারের মতো ভারতসহ প্রাচীন বিশ্বের সবচেয়ে বিচিত্র সুগন্ধির ঐতিহ্য সম্পর্কে জানা যায়। উদাহরণ হিসেবে কয়েকটি সভ্যতার সুগন্ধির কথা বলা যায়: একটি সুগন্ধির বর্ণনা আছে যার ব্যুৎপত্তি তৎকালীন পার্শিয়া (ইরান) এবং আরব থেকে, আরেকটি সৌরভের কথা বলা হয়েছে, যার জন্মস্থান ভারতবর্ষ, যে সুগন্ধি ব্যবহারের কথা বেদেও উল্লেখ আছে। নি'মাতনামার বদৌলতেই এই বিষয় উন্মোচিত হয় যে, ভারতে সুগন্ধি সংক্রান্ত বিজ্ঞানের চর্চা এক সময় জীবনের অত্যাবশ্যকীয় বিষয় ছিল। নি'মাতনামার কথা পুরো আমলে নিলে এ রকম ধারণা হয় যে: ভারতেই শুধুমাত্র সুগন্ধি ব্যবহার সংক্রান্ত জ্ঞানকে উন্নত জীবনের আবশ্যিক চিহ্ন বলে বিবেচনা করা হতো, এবং সুগন্ধি সভ্যতার একটি অন্যতম প্রধান উপাদানও ছিল।
নি'মাতনামার বাইরে ইতিহাসও সাক্ষী দেয়, ভারতে এটি এমন একটি শিল্প ছিল, যার জন্য ভারতবর্ষ একসময় সবার ঈর্ষার পাত্র ছিল। কিন্তু কালের বিবর্তনে এখন তা অনেকাংশেই ক্ষয়ে গেছে। আজ, যখন বিদেশ থেকে আসা কোনো ব্যক্তি ভারতের কোনো একটি বিমান বন্দরে অবতরণ করবে, সে শুল্কমুক্ত এলাকা দিয়ে যাওয়ার সময় ওই পরিচিত ব্র্যান্ডের অ্যালকোহলযুক্ত সুগন্ধিগুলোই দেখবে; এসব সুগন্ধি বিশ্বের যেকোনো বড় শহরেই দেখা যায়। আরেকটু নজর করে দেখলে স্পষ্টত বোঝা যাবে, এ পণ্যগুলোর বেশিরভাগই চারটি প্যারিসভিত্তিক সুগন্ধি ব্র্যান্ডের নির্মিত, যাদের সবার শিকড় খুঁজে পাওয়া যাবে গ্রাসে শহরের সুগন্ধি প্রস্তুতকারকদের মাঝে। ১৬শ শতাব্দীতে তারা বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলেন সুগন্ধি দ্রব্য নিয়ে, যা থেকেই প্যারিসের সুগন্ধি শিল্পের বিস্তৃতি। দিল্লি বিমানবন্দরের ডিউটি ফ্রি দোকানে একটিও ভারতে তৈরি সুগন্ধি খুঁজে পাওয়া যায় না এখন।
১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পরে ব্রিটিশরা শাসক রাজপুত্রদের উৎখাত করে দিল্লি ও লখনৌ দখল করে নেয়। এই দুটি রাজ্যেই ছিল উত্তর ভারতের সর্বশেষ ইসলামিক রাজসভা, এবং এই পদচ্যূতির কারণে আতরের ব্যবসার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। সুগন্ধি প্রস্তুতকারকেরা মূলত ধনী মুসলমান শাসক শ্রেণির সদস্যদের সেবায় নিয়োজিত ছিলেন, যারা বড় বড় শহরে, বিলাসবহুল জীবনযাপন করতেন। হিন্দু মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যরা এই ব্যবসায় কোনোভাবেই অংশগ্রহণ করতেন না; ক্রেতা কিংবা বিক্রেতা, কোনোদিক দিয়েই নয়। হিন্দুদের গান এবং ধ্রুপদী নাচ নব্য বড়লোকদের কাছে বেশ কদর পেয়েছে, এবং খুব সহজেই বিভিন্ন সমাবেশ থেকে কনসার্ট হলে এবং স্টেজে স্টেজে তা ঘুরেও বেড়াত। কিন্তু মোঘল রাজপুত্রদের কাছে জনপ্রিয় শিল্পগুলো, যেমন মিনিয়েচার পেইন্টিংস ও সুগন্ধি প্রস্তুত করা ও পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া ছিল শিল্পজ্ঞানে। তারা রাজ্যহারা হওয়ার পর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখে পড়ে এই শিল্প, হারায় ভারতবর্ষর সুপ্রাচীন সুগন্ধি তৈরির ঐতিহ্য।
কন্নোউজ ছিল প্রাচীন ভারতের আতর বানানোর কেন্দ্রস্থল। এককালে ভারতের সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ শহর হিসেবে পরিচিত কন্নোউজ বহুবার লুণ্ঠনের শিকার হয়েছে, যার নিদর্শন রয়েছে শহরজুড়ে: ভাঙ্গাচুড়া মসজিদ, মন্দির এবং প্রাচীন গম্বুজ। এর বাইরে, এখন প্রত্নতাত্বিক জাদুঘরে রাখা সপ্তম শতকের কিছু ভাস্কর্য ছাড়া এই শহরের সাবেক সাফল্যের চিহ্ন বলতে পাওয়া যাবে শুধুমাত্র একশোটিরও বেশি আতর চোলাইকারী প্রতিষ্ঠান। সব ধরনের রাজকীয় ব্যাপারস্যাপার তিরোহিত হয়ে গেলেও আতর তৈরির ডিস্টিলারিগুলো এখনো টিকে আছে; কারণ শত শত বছর ধরে গঙ্গা নদীর বয়ে আনা পলি মাটি দিয়ে উর্বর হওয়া এই পাললিক ভূমি গোলাপ এবং জুঁই চাষের জন্য বিশেষ উপযোগী। একজন আতরপ্রিয় বন্ধুর ভাষায়: "সবচেয়ে সুগন্ধি গোলাপগুলো এই রক্তে ভেজা মাটিতেই উৎপাদিত হয়।"
চোখে দেখার আগেই আমি আবদুল গফুরের আতর ডিস্টিলারির গন্ধ পেয়েছিলাম। অপ্রশস্ত একটি গলি দিয়ে যেতে যেতে কাঠের ধোঁয়া মিশ্রিত বিবিধ ফুল, চন্দন এবং মসলার তীব্র গন্ধের একটি চমকপ্রদ সন্নিবেশ আমার নাকে আঘাত করে। খোলা জায়গায় দুটি কপাট সমৃদ্ধ দরজাটি খুলে দেওয়ার পর একটি বড় উঠান দেখতে পেলাম, যেখানে বেশ কিছু ছাগল ও মুরগী ঘুরে বেড়াচ্ছিল। অর্ধেক জায়গাজুড়ে খামার, আর বাকিটা কারখানা। বড় উঠানটির একেবারে মাঝখানে রাখা ছিল দুই সারি বড় বড় তামার ডেকচি, যেগুলো বেশ কিছু পানি ঠাণ্ডা করার ট্যাঙ্কের সামনে রাখা ছিল। প্রতিটি ট্যাঙ্ক ভাপকা নামের লম্বা গলাযুক্ত তামার পাত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিল। ভাপকাগুলো চন্দন কাঠের তেল দিয়ে ভরা। ডেকচি ও ভাপকাগুলোকে দুটি চিকন বাঁশ দিয়ে যুক্ত করা, যার ভেতর দিয়ে বাষ্প, বা রুহ, চলাচল করতে পারে। সম্পূর্ণ আয়োজনটিকে বেশ সাধাসিধা মনে হলেও, আবদুর রহমান জানালেন, এই সরল উৎপাদন প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই হাজার বছর ধরে বিভিন্ন ফর্মুলার সাহায্যে সুগন্ধি দ্রব্যের স্ফটিকায়ন করা হয়েছে।
শামামা নামের বিশেষ আতর বানানোর জন্য প্রত্যেক সুগন্ধি কারিগরের রয়েছে নিজস্ব ও গোপন ফর্মুলা। সাধারণত এ আতরের প্রস্তুতপ্রণালীতে ব্যবহার হয় শৈবাল, ওক কাঠের শ্যাওলা, জুনিপার বেরি, জায়ফল, জৈয়ত্রী, হলুদ, স্পাইকনার্ড, দারুচিনি, লবঙ্গ লতা, লরেল বেরি, ভ্যালেরিয়ান গুল্ম এবং লাল চন্দন কাঠ। উদ্ভিদগুলোকে চূর্ণ করার পর তামার পাত্রটিকে পানি দিয়ে ভরে ফেলতে হয়, এবং চুল্লির আগুন জ্বালাতে হয়। পানি যথেষ্ট পরিমাণে গরম হলে প্রথমে তাতে শৈবাল যুক্ত করে চার ঘণ্টা ধরে ভাপকার মাধ্যমে পরিশোধন করতে হয়। এরপর একে একে বাকি উপাদানগুলো যুক্ত করে বারবার পরিশোধিত করতে হয় এবং প্রতিবার পরিশোধন করার পর নতুন ও জটিল এক ধরনের মিশ্রণ তৈরি হয়। প্রতিটি সুগন্ধি কারিগর তাদের বংশ পরম্পরায় প্রাপ্ত ফর্মুলা খুব ভালো করে রক্ষা করে; কারণ প্রত্যেকেই ভাবে, নিজের ফর্মুলা তার প্রতিবেশীদের চেয়ে বেশি উৎকৃষ্ট।
গফুরের ভাষ্যমতে, বিভিন্ন ধরনের আতর দিনের ভিন্ন ভিন্ন সময়ে বানাতে হয়। যেহেতু জুঁই ফুল রাতে তার সুবাস সবচেয়ে কড়াভাবে ছড়িয়ে দেয়, তাই একে সূর্যোদয়ের আগে ক্ষেত থেকে তুলে আনতে হয়, এবং ভোর ৪টা বাজার আগেই পরিশোধনাগারে নিয়ে আসতে হয়। সূর্যের প্রথম আলো দৃশ্যমান হবার আগেই পরিশোধনের কাজ শেষ হতে হবে; কারণ এরপর আস্তে আস্তে জুঁই ফুলের ঘ্রাণ হারিয়ে যেতে থাকে। অপরদিকে, গোলাপের আতর বানাতে হয় সূর্যোদয়ের পরে; সকাল ৭টায় গোলাপগুলো কারখানায় নিয়ে আসতে হয়, এবং আরও এক ঘণ্টা পরে আগুন জ্বালাতে হয় চুল্লিতে।
কয়েক সপ্তাহ ধরে পরিশোধন করার পর যে তেল পাওয়া যায়, তা খুব যত্ন করে সাবধানে সংরক্ষণ করা হয়, যাতে ভালো মদের মতো পরিপক্ক হয়। সব কিছু ঠিক থাকলে, মান অটুট থাকলে, এই তেল ন্যূনতম ১,৫০০ ডলার প্রতি কেজি দামে বিক্রি হয়। গফুরের ভাষ্যমতে, বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, আগের মতো সব উপাদান এখন আর সহজলভ্য নয়। যেমন কস্তুরি বেচা-কেনা ১৯৭০ সালে নিষিদ্ধ করা হয়, এবং চন্দন কাঠের বিতরণ এখন কঠোরভাবে সরকারি নিয়ন্ত্রণের আওতায়। এছাড়াও, ব্যবহারকারীরা আগের মতো বড়লোক কিংবা সমঝদার তরুণ নন; সুগন্ধির পেছনে খুব বেশি অর্থ ব্যয় করার সামর্থ্যও রাখেন না এরা। এসব কারণে, প্রায় আশি ভাগ সুগন্ধি প্রস্তুতকারী আতরে দামি, ভেষজ উপাদানের পরিবর্তে বিভিন্ন রাসায়নিক ও কৃত্রিম উপাদান ব্যবহার করে, আর নতুন প্রজন্মের মানুষ আতর ভালো করে না চেনায় আসল-নকল পার্থক্যও করতে পারে না।
পবিত্র শহর বেনারসের বাজারের একজন প্রাচীন আতর বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলেছিলাম; তিনিও স্বীকার বলেছিলেন, এই উপদানের পরিবর্তন প্রায় সকল ধরনের আতরের মাঝেই ছড়িয়ে গেছে। "পরিশোধনকারীরা দিনে দিনে আরও চালাক হয়ে যাচ্ছে; তারা মূল উপাদানের পরিবর্তে সস্তা কেমিক্যাল ব্যবহার করছে", বললেন আরেক আতর প্রস্তুতকারী আনন্দ মালহোত্রা, তার অফিসের কাছেই চূল্লীগুলো জ্বলছে। তিনি খেদের সঙ্গে প্রশ্ন রাখলেন, "কীভাবে আমরা উপাদানের বিশুদ্ধতা রক্ষা করব? সব কিছু মিলেমিশে গিয়েছে। এটাই এখন এই ব্যবসার প্রকৃত রূপ।'
তিনি হতাশা ও উষ্মার সঙ্গে মাথা এপাশ ওপাশ করলেন। তিনি বললেন, "এমনিতেও আজকাল তরুণ-তরুণীরা শুধু অ্যালকোহলভিত্তিক সুগন্ধিই চায়।' তিনি হাত নেড়ে জানালেন, এ যুগের সবচেয়ে জনপ্রিয় দুটি বস্তু হচ্ছে কালো টাকা ও ফেসবুক।
ভারতের এই ঐতিহ্যবাহী সুগন্ধি উৎপাদনের প্রক্রিয়া, বিভিন্ন উপাদানের পরিমাপ এবং গোপন ফর্মুলাসমূহকে হারিয়ে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে হলে বেশ বড় কিছু বাধা জয় করত হবে। উপাদানের বিশুদ্ধতা রক্ষা করার জন্য যথাযথ আইন প্রণয়নের পাশাপাশি মানুষের ফ্যাশন চিন্তারও পরিবর্তন ঘটাতে হবে। অনেক নব্য ভারতীয়দের কাছে আতর মানেই হলো প্রাচীন আমলের দাদী-নানীদের তুলার টুকরো দিয়ে কানের পেছনে ডলে ডলে লাগানোর বস্তু, এবং পুরনো শহরের বাজারে ঘুরে বেড়ানো, ফ্রক কোট পরিহিত, শুশ্রুমণ্ডিত ভদ্রলোকদের ব্যবহার্য বস্তু।
কিন্তু ভারতের কিছু শীর্ষস্থানীয় সুগন্ধি প্রস্তুতকারীগণ মনে করেন, তারা এই পরিস্থিতির পরিবর্তন আনতে সক্ষম। পাশ্চাত্যের শিক্ষায় দীক্ষিত হলেও, তাদের বদ্ধমূল ধারণা, ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় সুগন্ধি শিল্প থেকে শেখার আছে অনেক কিছুই। বর্তমানে তারা কাজ করছেন পশ্চিমা অ্যালকোহলভিত্তিক সুগন্ধি প্রস্তুতের ক্ষেত্রে ভারতীয় ফর্মুলা ব্যবহার করার উপযোগিতা নিয়ে। ইতিমধ্যেই আতরকে নতুনভাবে উপস্থাপন করে দামি বুটিক দোকানে বিক্রি করার কয়েকটি প্রয়াস সফল হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়, মোহরানগড় দূর্গে অবস্থিত যোধপূরের মহারাজার দোকানটির কথা।
এমন সাফল্য পাওয়া গেছে কিছু আরব দেশেও, তাদের ঐতিহ্যবাহী আতরের ক্ষেত্রেই। দুবাইয়ে আধুনিক শপিংমলগুলোতে আরবীয় আতর বিক্রি হয় উচ্চবিত্ত পরিবারগুলোর কাছে বিলাসিতার উপকরণ হিসেবে। সেখানকার সমঝদার সুগন্ধি ব্যবহারকারীরা অনেক বেশি সৌখিন; অনেকেই নানাবিধ উপাদানে ভরপুর মধ্যপ্রাচ্যের আতরের সঙ্গে পাশ্চাত্যের হালকা ঘ্রাণসমৃদ্ধ সুগন্ধি মিলিয়ে ব্যবহার করতে ভালবাসেন।
প্রাচীন ভারতবর্ষর সুগন্ধি শিল্পকে ফিরিয়ে আনতে অনেকেই উদ্যোগী হয়েছেন। এদের মধ্যে
আতরকে পুনরুজ্জীবিত করার পেছনে যার অবদান সবচেয়ে বেশি, তিনি স্বভাবতই লখনৌর সুগন্ধি কারিগরদের বংশধর। জাহ্নবি দামেরন নন্দন ফ্রান্সের ভার্সেই শহরে প্রশিক্ষন নিয়েছেন, এবং সম্প্রতি তিনি তার নিজস্ব, ভারতীয় সুগন্ধি ব্র্যান্ড "দ্য পারফিউম লাইব্রেরি"র গোড়াপত্তন করেছেন, যা ভারতীয় সুগন্ধি ও উপাদানে অনুপ্রাণিত।
অ্যালকোহল সুগন্ধি তৈরির উৎকৃষ্ট উপাদান, কিন্তু তেল আমাদের চামড়ায় আরও বেশি অন্তরঙ্গ একটি অনুভূতি এনে দেয়। দুটো উপকরণই একত্রে কাজ করতে পারে, যা মধ্যপ্রাচ্যের বোদ্ধারা অনুধাবন করছেন ধীরে ধীরে। আতর ভূমি থেকে এসেছে, আর আতর তৈরির পদ্ধতিকে ভূমি-শিল্প হিসেবে অভিহিত করা যায়। এই শিল্পকে সেসব জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সংযুক্ত করা যায়, যারা ভূমির কাছাকাছি বসবাস করেছে সর্বদা।
জাহ্নবীর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল দক্ষিণ ভারতের একটি জাপানি রেস্তোরায়, লাঞ্চের সময়, যেখানে তিনি আমাকে অবাক করে দিয়েছিলেন সাবলীল জাপানি ভাষায় শুশির অর্ডার দিয়ে। জানতে পারলাম, তিনি তার তারুণ্যের সময়টি কাটিয়েছেন জাপানে; আর বর্তমানে প্যারিস, দিল্লি ও মরিশাস—এই তিন জায়গায় ঘুরে-ফিরে বাস করেন। তিনি জানালেন, শিগগিরই তার প্রথম তেলনির্ভর সুগন্ধিটি বাজারে ছাড়তে যাচ্ছেন, যার নাম "আফতুরি", যা ঐতিহ্যবাহী জুঁই ফুলের আতরের অনুপ্রেরণায় তৈরি।
তিনি বলেন: "আমি খুবই আশাবাদী এই অসাধারণ সুগন্ধিগুলোর ব্যাপারে, যা তৈরি হবে প্রাকৃতিক ও ভেষজ (সিন্থেটিকের পরিবর্তে) উপাদান দিয়ে। আমরা ভারতের আয়ুর্বেদিক ও আতর প্রস্তুত শিল্পের ঐতিহ্য থেকে শিক্ষা নিয়ে তুলসী, হলুদ, সিপ্রিয়ল, লজ্জ্বাবতী লতা, আম এবং দারুচিনি দিয়ে তৈরি তেলভিত্তিক সুগন্ধির বিশ্বায়ন করে ফেলতে চাই। অ্যালকোহল আপনার চামড়ার ক্ষতি করতে পারে, কিন্তু তেল দিয়ে তৈরি করা সুগন্ধি আমাদের শরীরের জন্য যেমন উপকারি, তেমনি এটি আপনার আত্মাকেও পরিশোধিত করতে পারে।'
তিনি আরও উল্লেখ করেন, ভারতীয় ঐতিহ্যবাহী উপকরণগুলো সারা বিশ্বের মাঝে সবচেয়ে দুর্লভ। গিয়েরলেইন ফ্র্যাগর্যান্সে ভারতীয় ভেটিভার ব্যবহার করা হয়, ডিওর এবং মাগলের সুগন্ধিতে মহিশূরের সাম্বাক জুঁই ব্যবহার করা হয়, যার গুণগত মান অসাধারণ। ভারতীয় রজনীগন্ধাও বিশ্বসেরা হিসেবে পরিচিত।
একটি ঝংকারের সঙ্গে জাহ্নবী তার ব্যাগ থেকে ছোট স্প্রে বোতল বের করে বললেন, "আফতুরির সঙ্গে পরিচিত হোন", আর আমার বাহুতে এক ফোঁটা আতর স্প্রে করে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে পুরো রেস্তোরাঁ ভরে গেল একটি সুক্ষ এবং আকর্ষণীয় জুই-গন্ধে, যার সঙ্গে মিশে রয়েছে পুদিনা এবং কিছু পরিমাণে কাগজীলেবু ও রজনীগন্ধার সুবাস।
এটি অবশ্যই একটি আতর ছিল; কিন্তু খুব আশ্চর্যজনকভাবে হালকা, এবং কটন বাডের পরিবর্তে জাহ্নবী খুঁজে পেয়েছিলেন বিকল্প একটু ব্যবস্থা; একটি স্প্রে। নিঃসন্দেহে হাতের তালুতে স্প্রে করা হচ্ছে সুগন্ধি ব্যবহারের সবচেয়ে আধুনিক পন্থা। আমার মতে মধ্যবিত্তের কাছে আতরকে পুনরায় জনপ্রিয় করতে চাইলে আধুনিক সব পন্থারই প্রচলন করতে হবে।
"আফতুরি এখনো স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়", জাহ্নবী বলেন, "এখনো আমরা এটিকে সঠিকভাবে প্রস্তুত করতে পারিনি।" তারপর আমাকে আবারও অবাক করে দিয়ে তিনি বললেন, "আমি বর্তমানে নি'মাতনামার রেসিপিগুলো ব্যবহার করছি এটিকে পরিপূর্ণ করার জন্য। আমি সেই মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করছি, যখন গিয়াস শাহ আমাকে অনুপ্রেরণা দেবেন এটিকে সঠিকভাবে প্রস্তুত করার জন্য।"
পঞ্চদশ শতকের সুলতানী শাসনামলের বিভিন্ন রচনা থেকে অণুপ্রেরণা নিয়ে আধুনিক সুগন্ধির বাজারে তোলপাড় ঘটানো যাবে কি না, তার বিপরীতে জাহ্নবী পরিষ্কার জানেন, 'এটা পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে। লখনৌর পূর্বপুরুষদের কল্যাণে আমার মাঝে ঘ্রাণ সংক্রান্ত বিশেষ অনুভূতি এমনিতেই কাজ করে। আমার শুধু সঠিক উপাদান থেকে উপযুক্ত ঘ্রাণটি বের করে এনে, সেটাকে সুষ্ঠু রূপ প্রদান করার কাজটি করতে হয়, এবং তারপর সহজেই কাঙ্ক্ষিত সুগন্ধিটি প্রস্তুত করতে পারি।'
'লখনৌর কোনো আতর কারিগর কখনো তাদের গোপন ফর্মুলাগুলো লিখে রাখে না—এগুলো পারিবারিক গোপন দলিল এবং, কাগজে লিখে তা হারিয়ে ফেলার বা অন্য কারেও হাতে তুলে দেবার মতো ভুল কেউ করবে না। বংশপরস্পরায়, মুখে মুখে এই ফর্মুলাগুলো এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের কাছে চলে এসেছে। কিন্তু নি'মাতনামার মতো অল্প কিছু প্রাচীন পুঁথি রয়েছে, যা আমাদের সেই হারানো দিনের সুগন্ধিগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করার ব্যাপারে সহায়তা প্রদান করতে পারে।'
তিনি তার বাহুতে আফতুরি স্প্রে করে হালকা ঘ্রাণ নিলেন। "আমার নিজেকে মাঝে মধ্যে শিশুর মতো লাগে, যে সমুদ্রতটে খেলছে", তিনি বলেন, "এবং আমার সামনে রয়েছে প্রাচীন ভারতের সুবিশাল জ্ঞানের সমুদ্র, যা আমরা, সুগন্ধি প্রস্তুতকারীগণ মাত্র অনুসন্ধান করা শুরু করেছি।'
- অনুবাদ: ইশতিয়াক খান