যে রাজ্য ব্যর্থ হয়েছিল
যে রাজ্য ব্যর্থ হয়েছিল, ঠিক তার পেছনেই একটি সুন্দর, ছোট্ট নদী বইছিল। এটি ছিল একটি চতুর, মিষ্টি জলপ্রবাহ, এবং এই নদীতে ছিল প্রচুর মাছের বসতি। সেখানে অনেক আগাছা বা শ্যাওলাও জন্মাতো এবং মাছেরা সেই সব আগাছা বা শ্যাওলা খেত। মাছেরা অবশ্য রাজ্যটি ব্যর্থ হয়েছে কি হয়নি সেটা নিয়ে নিশ্চিতভাবেই মাথা ঘামাতো না। নদীর পেছনের সেই ভূমি আসলে একটি রাজ্য ছিল না প্রজাতন্ত্র, তাতেও বিশেষ কোন পার্থক্য মাছেদের কাছে আসত যেত না। মাছেরা ত' আর ভোট দিত না বা কর প্রদান করতো না। কাজেই পেছনের ঐ এলাকাটি একটি রাজত্ব না প্রজাতন্ত্র তাতে তাদের কাছে বিশেষ উনিশ-বিশ হতো না।
আমি সেই নদীতে আমার পায়ের পাতা ধুলাম। বরফ শীতল জলে অল্প কিছুটা সময় পা ভিজিয়ে রাখায় পায়ের দুই পাতা লাল হয়ে গেল। নদী থেকে সেই ব্যর্থ রাজ্যের প্রাচীর ও প্রাসাদের মিনার আপনি দেখতে পাবেন। প্রাসাদের মিনার থেকে দু'রঙা পাতাকা তখনো বাতাসে পতপত করে উড়ছিল।
নদীর তীরের পাশ দিয়ে আসা যাওয়া করা প্রত্যেকে এই পতাকা দেখবে এবং বলবে, 'এই, ওটাকে দ্যাখো। এটা সেই ব্যর্থ রাজ্যের পতাকা।'
কিউ এবং আমি হলাম বন্ধু- অথবা বলা উচিত, আমরা কলেজে বন্ধু ছিলাম। গত দশ বছরের বেশি হয় এমন কিছু আমরা দু'জন করিনি যা বন্ধুরা নিজেদের ভেতর করে থাকে। এজন্যই আমি অতীত কাল ব্যবহার করছি। যাহোক, আমরা বন্ধু।
কিউ-এর বিষয়ে আমি যখনি কাউকে কিছু বলার চেষ্টা করি- তাঁকে একজন ব্যক্তি হিসেবে বর্ণনা করার চেষ্টা করি- আমি পুরোপুরি অসহায় বোধ করি। কখনোই আমি কোন কিছু ব্যখ্যা করায় খুব ভাল ছিলাম না, তবে, সেই হিসাব মাথায় নিয়েও কিউকে কারো কাছে ব্যখ্যা করা আমার জন্য একটি বিশেষ চ্যালেঞ্জ। এবং যখনি আমি তার সম্পর্কে কোন বিবরণ দেবার চেষ্টা করি, এক গভীর, গভীরতর হতাশার বোধ আমাকে চেপে ধরে।
বিষয়টা আমাকে যতটা সম্ভব সহজভাবে ব্যখ্যা করা যায় করতে দিন।
কিউ এবং আমি সমবয়সী, তবে সে আমার থেকে ৫৭০ গুণ বেশি সুদর্শন। তাঁর ব্যক্তিত্ব খুব অমায়িক। সে কখনোই দাম্ভিক বা কাউকে ঠেলতে থাকা প্রকৃতির না। এবং এমনকি কেউ দূর্ঘটনাবশত: তার জন্য কোন সমস্যা সৃষ্টি করলেও সে কখনোই রাগ করে না। 'ওহ, বেশ,' সে বলবে, 'এমন কাজ আমি নিজেও ত' করেছি।' তবে, সত্যি বলতে, আমি নিজে তাকে কারো সাথেই কোন খারাপ আচরণ করার কথা শুনিনি।
কিউয়ের বেড়ে ওঠাও ভাল পরিবেশে। তার বাবা ছিল একজন ডাক্তার, যাঁর কিনা শিকোকু দ্বীপে নিজস্ব ক্লিনিক ছিল। সোজা কথায় হাত খরচের জন্য কিউকে কখনো ভাবতে হয়নি। আবার হাত খরচের টাকা বিষয়ে সে কখনো অমিতব্যয়ীও ছিল না। তার পোশাক-আশাক ছিল সুন্দর এবং বরাবরই সে ছিল একজন চিত্তাকর্ষক খেলোয়ার যে কিনা হাই স্কুলে আন্ত:স্কুল টেনিস খেলতো। সে সাঁতার কাটতে ভালবাসত এবং সপ্তাহে অন্তত: দু'বার স্যুইমিং পুলে সাঁতার কাটতে যেত।
রাজনৈতিকভাবে, সে ছিল মধ্যপন্থী উদারনীতিক। পরীক্ষায় তার গ্রেড অসাধারণ না হলেও অন্তত:পক্ষে ভালই থাকতো। পরীক্ষার জন্য তেমন পড়া সে কখনোই পড়ত না, তবে কখনোই কোন কোর্সে ফেল করেনি। ক্লাসে শিক্ষকদের লেকচার সে সত্যিই মন দিয়ে শুনত।
পিয়ানোতে সে ছিল বিষ্ময়করভাবে মেধাবী এবং তার কাছে ছিল বিল ইভান্স এবং মোজার্টের প্রচুর রেকর্ড। তার প্রিয় লেখকেরা ছিল ফরাসী- বালজাক এবং মোপ্যাঁসা। কখনো কখনো সে হয়তো পড়বে কেনজাবুরো ওয়ে বা অন্য কোন লেখকের লেখা কোন উপন্যাস। বইয়ের সমালোচনাও সে করতো একদম যথাযথভাবে।
খুব স্বাভাবিক ভাবেই সে ছিল মেয়েদের ভেতর যথেষ্ট জনপ্রিয়। তবে সে 'হাতে যাকে পাওয়া যায় তাকেই নেব' চরিত্রের পুরুষ ছিল না। তার ছিল এক নির্দিষ্ট বান্ধবী, একটি শৌখিন মহিলা কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের এক ছাত্রী। প্রতি রোববার ওরা বেড়াতে যেত।
যাহোক, এই কিউকেই আমি কলেজে চিনতাম। সংক্ষেপে বললে, তার চরিত্রে কোন ত্রুটি ছিল না।
তার আগে, আমার এ্যাপার্টমেন্টের ঠিক দরজার সামনেই ছিল কিউয়ের এ্যাপার্টমেন্ট। এ ওর কাছ থেকে কখনো লবণ ধার দেয়া বা সালাদের ভিনেগার নিতে গিয়ে, আমরা বন্ধু হয়েছিলাম এবং দ্রুতই আমরা এ ওর ওখানে সারাটা সময় কাটাতে থাকলাম, রেকর্ড শোনা আর বিয়ার পান করা এই সব। একবার আমি আর আমার বান্ধবী কামাকুরা সমুদ্র সৈকতে কিউ ও তার বান্ধবীর সাথে গাড়িতে চেপে ঘুরতে গেলাম। একসাথে আমরা সবাই খুব ভাল সময় কাটালাম। এরপর আরো উঁচু ক্লাসে উঠে, গরমের ছুটিতে আমি ঐ এ্যাপার্টমেন্ট থেকে অন্যত্র সরে গেলাম। এরপর কিউ-এর সাথে আমার আর কোন যোগাযোগ থাকেনি।
তারপর আর যেবার আমি কিউকে দেখলাম, তার ভেতর প্রায় একটি যুগ পার হয়ে গেছে। আকাসাকা জেলার বেশ এক ছিমছাম হোটেলের পুলের পাশে বসে আমি একটি বই পড়ছিলাম। কিউ ঠিক আমার পাশের ডেক চেয়ারেই বসে ছিল, এবং তার পাশে ছিল এক সুন্দরী ও দীর্ঘ পায়ের বিকিনি পরিহিতা নারী।
আমি সাথে সাথেই চিনতে পারলাম যে এই ব্যক্তিটি হচ্ছে কিউ। সে আগের মতই সুদর্শন, এবং এখন, ত্রিশের উপর বয়স হয়ে সে এমন এক ধরণের সুস্পষ্ট মর্যাদা তার চেহারায় অর্জন করেছে যা তার আগে ছিল না। তার পাশ থেকে হেঁটে যাওয়া তরুণীরা তার দিকে চকিত দৃষ্টিপাত করে যাচ্ছিল।
কিউয়ের পাশে বসার সময় ও আমাকে লক্ষ্য করেনি। আমি খুবই সাধারণ দেখতে একজন পুরুষ, আর আমার চোখে ছিল সানগ্লাস। আমি নিশ্চিত হতে পারছিলাম না যে ওর সাথে আমার কথা বলা উচিত কিনা, কিন্তু শেষমেশ সিদ্ধান্ত নিলাম যে কথা বলব না। কিউ আর ঐ নারীটি গভীর আলোচনায় ব্যপৃত ছিল, আর ওদের বিরক্ত করতে আমার সঙ্কোচ লাগছিল। এছাড়া, ওর আর আমার কথা বলার অনেক বিষয় ছিলও না। 'আমি তোমাকে লবণ ধার দিয়েছিলাম, মনে পড়ছে?' 'হ্যাঁ, সেটা ঠিক, এবং আমি খানিকটা সালাদের জন্য এক বোতল ভিনেগার নিয়েছিলাম।' দ্রুতই আমরা কথা বলার বিষয় হারিয়ে ফেলব। কাজেই আমি আমার মুখ বন্ধ রাখলাম এবং আবার আমার বইয়ে সেঁটে গেলাম।
তবু, আমি কিউ এবং তার সুন্দরী সহচরী পরষ্পরকে কি কথা বলছিল তা' কান খাড়া করে না শুনে পারছিলাম না। বেশ জটিল একটি বিষয়। আমি পড়া ছেড়ে দিয়ে ওদের কথা শুনতে থাকলাম।
'কোন উপায় নেই,' নারীটি বললো, 'তুমি ধাপ্পা দিচ্ছ।'
'আমি জানি, আমি জানি,' কিউ বললো, 'আমি ঠিক জানি তুমি কি বলছো। তবে তোমাকে আমার মত করেও দেখতে হবে। এমন না যে আমি নিজে থেকে চাইছি বলে এটা করছি। উপরতলার কর্তারা যা বলছিলেন সেই মাফিক বলছি। তাঁরা যা ঠিক করেছেন, আমি তোমাকে ঠিক সেটাই বলছি। কাজেই আমার দিকে ঐভাবে তাকিও না।'
'হ্যাঁ, ঠিক,' সে বললো।
কিউ দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
ওদের দীর্ঘ কথোপকথন আমি বরং সংক্ষেপে বলি- যার অনেকটা অবশ্যই কল্পনা দিয়েও পূরণ করছি। কিউ মনে হলো কোন টিভি স্টেশন বা কোথাও এখন এক পরিচালকের পদে কাজ করছে আর ভদ্রমহিলা মাঝারি গোছের পরিচিতা কোন গায়িকা বা অভিনেত্রী। তাঁকে সম্ভবত: টিভির কোন প্রকল্প থেকে বাদ দেয়া হচ্ছে হয়তো তিনি কোন ঝামেলায় বা স্ক্যান্ডালে জড়িয়ে পড়েছেন বলে, অথবা হতে পারে তার জনপ্রিয়তা পড়ে গেছে। ভদ্রমহিলাকে এই বিষয়টি বলার দায়িত্ব কিউ-এর ঘাড়ে পড়েছে যে কিনা এই টিভি স্টেশনের দৈনন্দিনের নানা খুঁটিনাটি ব্যবস্থাপনার দিক দেখায় সবচেয়ে সরাসরি বা প্রত্যক্ষভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত। বিনোদন ভুবন সম্পর্কে আমি বেশি জানি না, কাজেই এর সূক্ষাতিসূক্ষ কিছু বিষয় সম্বন্ধে নিশ্চিত নই। তবে মনে হয় না আমি গোটা ঘটনা থেকে খুব বেশি দূরেও আছি।
দু'জনের কথা-বার্তা শুনে আমি যা বুঝলাম যে কিউ আন্তরিকভাবেই তার দায়িত্ব পালন করছিল।
'আমরা ত' স্পন্সর ছাড়া চলতে পারিনা,' সে বললো, 'তোমাকে এটা ত' আমার বলার দরকার নেই- ব্যবসার বিষয় ত' তুমি বোঝ।'
'তাহলে তুমি বলতে চাইছ যে এই বিষয়ে তোমার কোন দায়িত্ব বা কিছু বলার নেই?'
'না, আমি তোমাকে সেটা বলছি না। তবে আমার কিছু করার ক্ষমতা আসলেই খুব কম।'
তাদের আলোচনা এরপর এক ভয়াবহ দিকে মোড় নিল। মেয়েটি জানতে চাইলো যে কিউ তার পক্ষ হয়ে কতটা কি করেছে। কিউ জোর দিয়ে বললো যে তার পক্ষে যা যা করা সম্ভব ছিল সে করেছে, তবে এটা প্রমাণ করার কোন উপায় তার জানা নেই, এবং মেয়েটি তার কথা বিশ্বাস করলো না। আমিও কিউকে বিশ্বাস করলাম না অবশ্য। যত বেশি আন্তরিকতার সাথে কিউ বিষয়টি ব্যখ্যা করতে থাকলো, ততই গোটা বিষয়টির উপর এক প্রতারণার কুয়াশা যেন ঝুলতে থাকলো। কিন্তু এটা কিউয়ের দোষ ছিল না। এটা কারোরই দোষ ছিল না। আর এজন্যই এই কথোপকথন থেকে কোন বের হবার রাস্তা ছিল না।
বোঝা গেল যে ভদ্রমহিলা কিউকে বরাবরই পছন্দ করেছেন। আমি অনুমান করলাম যে এই ব্যবসাজনিত বিষয়াদি আসার আগে দু'জনের বেশ ভাল সম্পর্কই ছিল। যা কিনা শুধুমাত্র মহিলার ক্রোধকে আরো বাড়াচ্ছিল। সবশেষে, অবশ্য, সে গোটা বিষয়টি ছেড়ে দিলো।
'ঠিক আছে,' মেয়েটি বললো, 'বুঝেছি। আমাকে একটি কোক কিনে দাও, দেবে?'
একথা শুনে কিউ স্বস্তির শ্বাস ছাড়লো এবং পানীয় কেনার স্ট্যান্ডের দিকে গেল। মেয়েটি তার সানগ্লাস আবার পরলো এবং সোজা সামনের দিকে তাকালো। এই সময়ের ভেতরেই, আমি আমার বইয়ে একই পংক্তি বেশ কয়েকশো বার পড়লাম। দ্রুতই কিউ দু'টো বড় কাগজের কাপ হাতে ফিরে এলো। একটি কাপ নারীটির দিকে দিয়ে সে ডেকচেয়ারে নিচু হয়ে বসতে গেলো, 'এই বিষয়টা নিয়ে এত বেশি মন খারাপ করোনা,' সে বললো। 'যে কোনদিন এখন তুমি হবে-"
কিন্তু, কথা শেষ করার আগেই, মহিলা ওর দিকে তার পুরো কোক ভর্তি কাপটি ছুঁড়ে মারলো। এটা তার মুখে বর্গক্ষেত্রের মত সেঁটে গেল আর কোকাকোলার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ আমার গায়ে এসে পড়লো। আর একটিও শব্দ না করে, নারীটি এবার উঠে দাঁড়ালো এবং চেয়ার থেকে একটানে তার বিকিনি সুদ্ধ উঠে পড়ে একবারও পিছু না তাকিয়ে, গা ঝাড়া দিয়ে সামনে হেঁটে চলে গেল। কিউ এবং আমি সেখানে প্রায় সেকেন্ড পনেরো স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। চারপাশের মানুষ যাকে বলে বিমূঢ় হয়ে আমাদের দিকে তাকাচ্ছিল।
কিউ প্রথম তার স্থৈর্য ফিরে পেল।
'দু:খিত,' সে বললো আর আমার দিকে একটি তোয়ালে এগিয়ে দিল।
'ঠিক আছে," আমি উত্তর করলাম, 'আমি স্নান করে ফেলব।'
খানিকটা বিচলিত চেহারায় কিউ তোয়ালেটি এবার সরিয়ে নিয়ে নিজের গা মুছতে থাকলো।
'আমাকে অন্তত: আপনার বইয়ের দামটি শোধ দিতে দিন,' ও বললো। এটা সত্যি যে আমার বইটি ভিজে গেছিল। তবে এটা ছিল একটি সস্তা পেপারব্যাক আর বইয়ের বিষয় খুব আগ্রহোদ্দীপক কিছুও নয়। যে কেউ এই বইটিতে কোক ছুঁড়ে মেরে আমাকে এটি পড়া থেকে বিরত রেখেছে সে বরং আমার একটি উপকারই করেছে। আমি এ কথা বলায় ওর চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। যথারীতি আগের সেই অসাধারণ হাসিটি ওর এখনো আছে।
এবার কিউ চলে গেলো, যাবার জন্য উঠে দাঁড়ানোর সময় সে আবার আমার কাছে ক্ষমা চাইলো। একবারের জন্যও ও বোঝেনি যে আমি কে।
এই গল্পটির শিরোনাম আমি 'যে রাজ্য ব্যর্থ হয়েছে' দেব বলে সিদ্ধান্ত নিলাম যেহেতু আমি সান্ধ্যকালীন সংবাদপত্রে এক আফ্রিকীয় রাজ্য সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ পড়েছিলাম যেটা ব্যর্থ হয়েছে। 'একটি জমকালো রাজ্যেকে বিলুপ্ত হতে দেখা,' প্রবন্ধটিতে বলা হয়েছে, 'একটি দ্বিতীয় স্তরের প্রজাতন্ত্র ধ্বংস হতে দেখার চেয়ে অনেক বেশি দু:খজনক।'
- অনুবাদ: অদিতি ফাল্গুনী