আম কেমন করে ফলের রাজা?
উত্তরাধিকার সূত্রে রাজপুত্র থেকে রাজা হয়নি, এমনকি কারচুপি কি বিনা কারচুপির ভোটেও না। আম রাজা হয়েছে নিজ গুণে, গণসন্তোষে, গণতৃপ্তিতে। মুুকুট পরিয়ে আম যে রাজাধিরাজ তা প্রমাণ করতে হয় না, আমের সৌন্দর্য, ঘ্রাণ ও স্বাদ এবং এ জন্য আমভক্তদের ক্রেজ বলে দেয় কে রাজাধিরাজ। অবশ্য এর সাথে যোগ হয়েছে একটি বীরবলীয় গল্প।
গল্পটা সত্যও হতে পারে। বাদশাহ আকবরের রাজসভার অন্যতম প্রাণবন্ত চরিত্র বীরবল পেটপুরে রাজকীয় ভোজ খেয়ে আর উঠে দাঁড়াতে পারছেন না এমন অবস্থা। অবস্থা দেখে বাদশাহ বীরবলকে একটু বেকায়দায় ফেলার জন্য বললেন, অনেক শাহি খানা তো রয়েই গেল। আরও কিছু পাতে তুলে নাও।
বীরবল দুহাত তুলে ক্ষমা চেয়ে বললেন, মাফ করবেন দুনিয়া জাহানের বাদশাহ আমার পেটে তিল ঠাঁই দেবার জায়গা নেই।
দস্তরখানা পেতে খেতে বসা শাহিভোজের নিয়মিত অতিথিরা তার অসহায় চেহারার দিকে তাকালেন।
এমন সময় খানসামা সোনালি রেকাবিতে ফালি ফালি করে কাটা মিষ্টি আমের অনেকগুলোই তার প্লেটে ঢেলে দিল।
এদিক-ওদিক কোনো দিক না তাকিয়ে বীরবল গপাগপ আম খেতে থাকলেন। দেখে বাদশাহ আকবর যুগপৎ বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ। একটু আগে না বলে এখন খাচ্ছে, এ তো রীতিমতো রাজা-বাদশাহদের অপমান। বাদশাহ তাকে একবার না বলে তারপর আম খেতে শুরু করার কারণ দর্শাতে বললেন। বীরবল বললেন, অপরাধ মানি, আপনি ঠিকই ধরেছেন। কথা হলো, মহারাজ আকবর যখন জনতার মধ্য দিয়ে আসেন, সাধারণ মানুষ দুপাশ থেকে সরে গিয়ে তার জন্য রাস্তা করে দেয় যেন তিনি নির্বিঘ্নে এগোতে পারেন। আমের ব্যাপারটাও পুরোপুরি একই রকম। আম যখন সামনে আসে, অন্য সব আহার ও ফল দ্রুত সরে গিয়ে আমের জন্য জায়গা করে দেয়। আপনিই বলুন আমার কী দোষ মহারাজ।
সেই থেকে আম চিহ্নিত হয়ে গেল ফলের রাজা। মর্যাদায় সব ফলের শীর্ষে। আমের পরম ভক্ত ছিলেন সম্রাট আকবর। বিহারের দ্বারভাঙ্গায় তার নির্দেশে এক লক্ষ আমগাছ লাগানো হয়েছে। ১৫৯০ সালে প্রকাশিত আইন-ই-আকবরীতে এ আমের গুণাগুণ বিস্তর বর্ণিত হয়েছে। আমের প্রথম প্রধান প্যাট্রন হিসেবে আলাউদ্দিন খিলজি সমাদৃত। হতভাগ্য মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের দিল্লি রেড ফোর্টের ভেতরের বাগানে যে আম্রকুঞ্জ বানিয়েছিলেন তার নাম হায়াত বকশ।
আম উৎপাদান বাংলাদেশ এগোচ্ছে
গত শতকে আম উৎপাদনকারীর শীর্ষে ২৫ তালিকার কাছেও বাংলাদেশ আসতে পারেনি। তবে গত দুই দশকে বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে; ২০২১ সালে প্রথম দশে চলে এসেছে, ওদিকে ভারত শীর্ষ স্থানে আছে বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই।
অবস্থান দেশ উৎপাদন (টন)
১. ভারত ১৫,১৮৮,০০০
২. চীন ৪,৩৫০,০০০
৩. থাইল্যান্ড ২,৬০০,০০০
৪. ইন্দোনেশিয়া ২,১৩১,১৩৯
৫. পাকিস্তান ১,৮৮৮,৪৪৯
৬. মেক্সিকো ১,৮২৭,৩১৪
৭. ব্রাজিল ১,২৪৯,৫২
৮. বাংলাদেশ ৮৮৯১৭৪
৯. নাইজেরিয়া ৮৫০০০০
১০. ফিলিপাইন ৮০০,৫৫১
বাংলাদেশের আরও এগিয়ে যাবার ক্ষেত্রে বড় সীমাবদ্ধতা জমির স্বল্পতা। অন্যদিকে ভারতে আম চাষের জন্য নির্ধারিত জমি ২৩ লক্ষ একরেরও বেশি। ভারতের আম উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করা রাজ্যগুলো হচ্ছে উত্তর প্রদেশ, অন্ধ্র প্রদেশ, বিহার, গুজরাট, কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র এবং ওড়িশা। শীর্ষ স্থানে অবস্থান করলেও আম প্রক্রিয়াকরণে অনেক এগিয়ে চীন এবং তৃতীয় স্থানে থাইল্যান্ড। পাকিস্তানও আমের অন্যতম রপ্তানিকারক, রপ্তানির ৬০ ভাগই মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর জন্য বরাদ্দ। আমের বৈচিত্রের প্রশ্নে ভারতকে পরাস্ত করা দুরূহ ব্যাপার। ১৫০০ ধরনের আম রয়েছে, এর মধ্যে ১০০০ ভ্যারাইটিজ বাণিজ্যিকভাবে পরিচিত হয়ে উঠেছে।
ভারত পৃথিবীর মোট উৎপাদনের প্রায় অর্ধেকের কাছাকাছি আম উৎপন্ন করে। আর উত্তর প্রদেশ রাজ্য একাই ভারতের ২৩ শতাংশ আম উৎপন্ন করে থাকে। পশ্চিমবঙ্গের শেয়ার সাড়ে চার ভাগ। সব মিলিয়ে এশিয়ার দেশগুলোতে আমের লক্ষণীয় উৎপাদন বৃদ্ধি ঘটছে। যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা, কালিফোর্নিয়া, হাওয়াই অঙ্গরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় অঞ্চল পুয়ের্টো রিকোতে আমের চাষ হয়ে থাকে। পুয়ের্টো রিকোর আম ইউরোপে রপ্তানি হয়। ব্রাজিলেরও।
২০২০ সালের হিসেবে ভারত, চীন, থাইল্যান্ডের পরের স্থানটি ছিল মেক্সিকোর, কিন্তু মেক্সিকো দুধাপ নেমে গেছে, উঠে এসেছে চতুর্থ স্থানে ইন্দোনেশিয়া, পঞ্চম স্থানে পাকিস্তান। এ বছর ১১তম থেকে ২৫তম স্থান অধিকারী দেশগুলো হচ্ছে ফিলিপাইন, সুদান, কেনিয়া, ভিয়েতনাম, হাইতি, তানজানিয়া, কিউবা, ইয়েমেন, পেরু, কলম্বিয়া, নেপাল, মাদাগাস্কার, কঙ্গো, নাইজার, গিনি।
ক্রমেই বাংলাদেশ আম রপ্তানিকারক দেশের তালিকায় লক্ষণীয় সাফল্যের আভাস দিচ্ছে। বেশ কবছর ধরেই বাংলাদেশের এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে।
আমের আঁটির মতো ছুড়ে ফেলা
এই অভিযোগ তো হামেশাই শোনা যায়। কিন্তু আমের আঁটি যে মূল্যবান, কিছুকাল পর মাইলের পর মাইল হেঁটে একটি আমের আঁটি খুঁজে পাওয়া যাবে না, এটা হয়তো অনেকেরই অজানা।
বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের 'আম আঁটির ভেঁপু' যথেষ্ট পরিচিত গ্রন্থ। ভেঁপু তো বানানো যায়ই। তা ছাড়া কচিটা খাওয়াও যায়, পুষ্ট আঁটি বেটে তেল ও মাখন তৈরি করা হয়। আম আঁটির পাউডার অত্যন্ত মূল্যবান। আম আঁটির পেস্ট মাথায় খুশকি দূর করতে, ত্বক জীবন্ত রাখতে ব্যবহার করা হয়। হৃদ্রোগের মহৌষধ; মধুমেহ রোগেরও প্রতিকার করে বলে চিকিৎসকদের ধারণা, এখন গবেষণা চলছে। আমের চাষ বাড়লে আঁটিও বাড়বে, কিন্তু কেউ আর রসটা চুষে ছুড়ে ফেলবে না।
আম্র-কূটনীতি, আম্রবৃক্ষের চীনযাত্রা
বাংলাদেশ পাকিস্তানের ইমরানোত্তর প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফকে পুরো এক মেট্রিক টন আম্র শুভেচ্ছা কেবল সৌরভ নয়, ফল পাঠিয়েছে। ভারত ও পশ্চিমবঙ্গকেও পাঠিয়েছে। কূটনীতির চালের বাইরেও যারা চাল মেরে থাকেন, তারা হিসাব করতে বসেছেন ওজনে কোন দেশ বেশি পেল, ভারত না পাকিস্তান? ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ উত্তম আম উৎপাদনে তিন দেশেরই সুখ্যাতি রয়েছে। তিন দেশই পরস্পরের মধ্যে আম্র শুভেচ্ছা বিনিময় করে থাকে। সম্পর্ক মসৃন ও প্রগাঢ় করতেই শুভেচ্ছাম-িত আমের ঝুরি আদান-প্রদানের প্রচলন।
প্রথম গুরুত্বপূর্ণ আম্র কূটনীতির প্রকাশ ঘটে সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময়। তিনি আমকে মুদ্রা হিসেবে ও সম্পর্ক উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন। পারস্যের শাহ আব্বাস নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করলে আওরঙ্গজেব কিছুটা বিচলিত হয়ে থাকতে পারেন। তিনি দ্রুত তার কাছে কয়েক ঝুড়ি আম পাঠিয়ে দেন। আওরঙ্গজেবও আম পেয়েছেন শান্তিচুক্তির প্রস্তাব হিসেবে; বলকান রাজা ভারত সম্রাটের সাথে শান্তি স্থাপনের অভিপ্রায়ে ২০০ উট, শুকনো ফল ও আম পাঠিয়েছিলেন।
আমকে আন্তর্জাতিক মানের উপহারে পরিণত করতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী প-িত জওহরলাল নেহেরুর অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে। পঞ্চাশের দশকে ভারতে যখনই কোনো দেশের প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রী সফরে আসতেন, নেহেরু তাদের ঝুড়িভর্তি আম উপহার দিতেন; আবার তিনি যখন বিদেশে যেতেন, তিনি উপহার দেবার জন্য সাথে নিতেন আম। নেহেরু বিশিষ্টজনদের জন্য আমের চারাও পাঠিয়ে দিতেন। ১৯৬৮ সালের আগস্টে পাকিস্তান চেয়ারম্যান মাও সে তুংকে আম পাঠিয়ে সম্পর্কের দরজা উন্মোচন করে। ষাটের দশকের আগেও আমের সাথে চীনের তেমন পরিচয় ছিল না।
শীতল ও বৈরী সম্পর্ক মেরামত করার উদ্দেশ্যে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়া-উল হক ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে আনোয়ার ও রাতাউল আম পাঠালেন। আনোয়ার ও রাতাউল উভয়ই উত্তর প্রদেশের আমপ্রধান এলাকা। এই আম পাকিস্তানেও উৎপন্ন হচ্ছে। দুই আমের মূল স্বত্ব নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিবাদও চলছে। মনোমোহন সিং যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ এসে বললেন ভারতীয় আমের স্বাদ নেবার অপেক্ষায় আছেন সম্পর্কের নাটকীয় উন্নয়নেরই একটি বার্তা।
১৯৫৪ সালের ১৪ নভেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর ৬৫তম জন্মদিনে চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই ১০০ গোল্ড ফিশ, এক জোড়া লাল ঝুটি সারস ও এক জোড়া চিত্রল হরিণ উপহার পাঠিয়েছিলেন। চৌ এন লাইকে আমের চাড়া পাঠানোর প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন পিকিংয়ে (এখন বেইজিং) নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত। উদ্দেশ্য ক্যান্টনের পিপলস পার্কে চারাগুলো রোপণ করা। আমলাতান্ত্রিক বিলম্বের কারণে শীত এসে গেলে প্রস্তাবটি চাপা পড়ে যায়। কিন্তু পরের গ্রীষ্ম আসতেই দূতাবাসের আর গোবর্ধনের পীড়াপীড়িতে বিদেশ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব টিএন কাউল উদ্যোগী হন।
তারপরও ভারত সরকারের উপহার আমের চারা (চৌকা ২টি, ডাশেরি ৩টি, নেহড়া ১টি, আলফসো ২টি) ১৯৫৫-এর ৩১ মের মধ্যে হংকং হয়ে পিকিং পাঠানোর প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়। যে দুই বাক্সে চারাগুলো পাঠানো হয়, সেগুলোতে চারাসহ ওজন দাঁড়ায় ৭০, ৭৪ কিলোগ্রাম। উড়োজাহাজে কার্গো হিসেবে হংকং পাঠাতে খরচ পড়ে ৪৮০ টাকা। সেখানে সফররত একটি ভারতীয় ডেলিগেশন আমের চারাগুলো গ্রহণ করে পিকিং নিয়ে আসেন। এর আগে ভারত থেকে আমের চারা পাঠাতে আনুমানিক ৬০০ রুপি লাগতে পারে এই মর্মে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন গ্রহণ করা হয়। ওদিকে চারার সংখ্যা এত কম হওয়ায় দূতাবাসের কর্মকর্তা সংখ্যা বাড়াতে আগেই সরকারকে চিঠি লিখেন। এক দিন পরই মিনিস্ট্রি অব এক্সটার্নাল অ্যাফেয়ার্স বার্তা পাঠিয়ে দেয়: চারাগুলো পরীক্ষামূলক, সফলতা এলে আরও বেশি সংখ্যায় পাঠানো হবে।
৫ জুন ১৯৫৫, আমের চারার কাল্টিভেশন ম্যানুয়ালও পাঠানো হয়। রাষ্ট্রীয়ভাবে ভারত থেকে চীনে পাঠানো আমের চারার মাধ্যমে চীন-ভারত সংহতি জোরদার না হলেও চীনে আম চাষের শুভ সূচনা হয়। সংহতি যে জোরদার হয়নি তার প্রমাণ মাও সে তুং, চৌ এন লাই এবং জওহরলাল নেহেরু ক্ষমতাসীন থাকতেই ১৯৬২ সালে চীন সীমান্তে ভারতের অরুণাচল প্রদেশে আক্রমণ চালিয়ে একটি বড় ভূখ- নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়। সে সময় ভারতীয় সেনাপ্রধান ছিলেন জেনারেল প্রাণ নাথ থাপার।
আম্র তথ্য: ৩০০ বছর বয়সী গাছেও আম ধরে
কিছু আম্র তথ্য জেনে রাখা ভালো। আমও ম্যাংগো উভয় শব্দই ভারতবর্ষে উদ্ভূত।
৫০০০ বছর আগেও ভারতবর্ষে আম ছিল, যৌক্তিকভাবে তা প্রমাণ করা সম্ভব। খ্রিষ্টজন্মের তিন থেকে চার শ বছরের মধ্যে বিভিন্ন দেশি পর্যটকদের মাধ্যমে আম মধ্যপ্রাচ্য, পূর্ব আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকায় পৌঁছে এবং আমের বিচি রোপিত হয়। আমগাছ ১০০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হতে পারে এবং এর চওড়া ৩৫ ফুট ছাড়িয়ে থাকতে পারে। আমগাছ বেঁচে থাকলে ৩০০ বছর পেরিয়ে গেলেও তাতে আম ধরার নজির রয়েছে।
আমের মুকুলে পরাগায়ন ঘটায় কীটপতঙ্গ। মুকুলের এক শতাংশেরও কম ফলে পরিণত হয়। ৪ থেকে ৬ বছরের মধ্যে আমগাছে ফল ধরে। আমের পরিপূর্ণ ফল হওয়া পর্যন্ত ৪ মাস সময় লাগে। আম পেকেছে কি না, রং দেখে বুঝতে চাইলে বিভ্রান্তির শিকার হতে হবে। মেক্সিকো, পেরু, ইকুয়েডর, ব্রাজিল, গুয়েতেমালা ও হাইতি মূলত উত্তর আমেরিকায় আম রপ্তানি করে থাকে। উৎপাদনের পরিমাণ ও বৈচিত্র ভারতকে বিশ্বের আম্র-রাজধানী করে তুলেছে।
আমের পাতা ভেষজ ঔষধি গুণসম্পন্ন। ভারত, পাকিস্তান ও ফিলিপাইনের জাতীয় ফল আম। এশীয় অঞ্চলে আম উপহার, বন্ধুত্ব, সৌভ্রাতৃত্বের প্রতীক। বৌদ্ধদের পবিত্র বৃক্ষ; গৌতম বুদ্ধ শিষ্যদের নিয়ে সবুজ আমগাছের নিচেই ধ্যান করেছিলেন, দাবি করা হয়।
আম্র বিস্ফোরণ: আ কেইস অব এক্সপ্লোডেড ম্যাঙ্গো
১৭ আগস্ট ১৯৮৮ পাকিস্তানের বাহওয়ালপুর এয়ারপোর্ট থেকে বেলা ঠিক ৩টা ৪০ মিনিটে লকহিড কোম্পানির সেসনা ১৩০ বি হারকিউলিস (পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে পাক ওয়াল নামে নিবন্ধিত) আকাশে উড়াল প্রস্তুতি সম্পন্ন করল। আড়াই মিনিট পরই কন্ট্রোল টাওয়ার ভিআইপি উড়োজাহাজের সাথে সংযোগ হারিয়ে ফেলে। জাহাজের ভিআইপি যাত্রী টানা ১১ বছরের পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউল হক। তিনি একই সাথে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান।
তার সাথে উড়োজাহাজে আছেন জয়েন্ট চিফ অব স্টাফ জেনারেল আকতার আবদুর রহমান, চিফ অব জেনারেল স্টাফ জেনাারেল মোহাম্মদ আফজাল, পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত আরনল্ড র্যাফায়েল, যুক্তরাষ্ট্রে মিলিটারি অ্যাটাশে ব্রিগেডিয়ার হার্বার্ট ওয়াসম এবং বাংলাদেশে বিশেষ পরিচিত ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিক মালিক উইটনেস টু সারেন্ডার গ্রন্থের লেখক।
অল্পক্ষণের মধ্যেই বিস্ফোরিত ভিআইপি উড়োজাহাজ ছিন্নভিন্ন হয়ে সাটলেজ নদীর ধারে আছড়ে পড়ল। ৩১ জন যাত্রীও ক্রু সকলেরই মৃত্যু হলো। তাদের মৃতদেহ শনাক্তকরণ দুরূহ হয়ে উঠল। জানা গেল উড়োজাহাজে আমের ঝুড়িতে বোমা পাতা ছিল। এটি যথার্থ না হলেও বিধ্বস্ত জাহাজে বিস্ফোরক লাগানো আমের বিচি পাওয়ার কথা বলা হয়েছে। মোহাম্মদ হানিফ এই কাহিনি নিয়েই লিখেছেন 'আ কেইস অব এক্সপ্লোডেড ম্যাঙ্গো'।
ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে
হোক কাঁঠাল জাতীয় ফল, সাহিত্যে কাঁঠালের অবস্থান আম থেকে যোজন যোজন মাইল দূরে। তুম ভি কাঁঠাল খায়া হাম ভি কাঁঠাল খায়া গল্পে কাঁঠাল ফলের স্বাদের প্রশংসার চেয়ে বেশি করা হয়েছে কাঁঠালের আঠার বিড়ম্বনার কাহিনি। পীরিতি কাঁঠালের আঠা, সে আঠা লাগলে পড়ে উঠে না বলে যত গানই গাওয়া হোক না কেন; পীরিতি যে ঝুঁকিপূর্ণ, বাস্তবে ভঙ্গুর প্রেমের সম্পর্কের কথা এই গানে উঠে আসেনি।
প্রাণহরা আম ভারত ও পাকিস্তানে জাতীয় ফলের মর্যাদা পেয়ে আসছে, কিছুটা হলে ফল রাজনীতিতে ভারসাম্য আনতে বাংলাদেশে আমগাছকে জাতীয় বৃক্ষের মর্যাদা দিয়েছে।
আমভক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যে সোনার বাংলা গীত বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হয়েছে, আমের মহিমা প্রচারিত সেই পানে, কাঁঠাল, কমলা, কলা, জাম এই গানে ঠাই পায়নি:
ওমা, ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে,
মরি হায়, হায় রে
ওমা, অঘ্রাণে তোর ভরা ক্ষেতে আমি কী দেখেছি মধুর হাসিৃ
আমাদের হরফ জ্ঞান হবার আগেই কবি জসীমউদ্দীনের 'মামার বাড়ি' মুখস্থ হয়ে যায়। আম কুড়ানোর সুখটা আসলে কেমন বুঝতে পারলেও সাধারণ সুখের চেয়ে ভিন্ন এক সুখের সাথে পরিচিতি ঘটে:
আয় ছেলেরা আয় মেয়েরা
ফুল তুলিতে যাই
ফুলের মালা গলায় দিয়ে
মামার বাড়ি যাই।
ঝড়ের দিনে মামার দেশে
আম কুড়াতে সুখ
পাকা আমের মধুর রসে
রঙিন করি মুখ।
ফজলি আম যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে মোহিত করে রেখেছে, কাঁচা আমকেও তিনি ছাড় দেননি:
তিনটি কাঁচা আম পড়েছিল গাছতলায়
চৈত্রমাসের সকালে মৃদু রোদ্দুরে
যখন দেখলুম অস্থির ব্যগ্রতায়
হাত গেল না কুড়িয়ে নিতে।
তখন চা খেতে খেতে মনে ভাবলুম
বদল হয়েছে পালের হাওয়া
পুব দিকের খেয়ার ঘাট ঝাপসা হয়ে এলো।
কাজী নজরুল ইসলামের গানে ও কবিতা আমের মতো ফল বেশ জায়গা করে নিয়েছে:
বন্ধু আজও মনে যে পড়ে আম কুড়ানো খেলা
আম কুড়াইবার যাইতাম দুইজন নিশি ভোরের বেলা।
জোষ্ঠিমাসের গুমোট রে বন্ধু নামত নাকো নিদ,
রাত্রে আমও নাকো নিদ
আম-তলার এক চোর আইস্যা কাটত প্রাণের সিদ।
নজরুলের আরও একটি গান:
আমের মতো আমের ডালে বোল ধরেছে বউ
তুমিই শুধু বদলে গেছ আগের মানুষ নও
তেমনি আজো তোমার নামে উথলে মধু গোলাপ জামে
উঠল পুরে জামরুলে রস মহুল ফুলে মউ
তুমিই শুধু বদলে গেছ আগের মানুষ নও।
কুড়ি বছর পরে কবিতায় জীবনানন্দ আমকে ভোলেননি:
হয়তো এসেছে চাঁদ মাঝরাতে একরাশ পাতার পিছনে
সরু-সরু কালো-কালো ডালপালা মুখে নিয়ে তার,
শিরীষের অথবা জামের,
ঝাউয়ের আমের
কুড়ি বছরের পরে তখন তোমারে পাই মনে
জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি-কুড়ি বছরের পার
তখন আবার যদি দেখা হয় তোমার আমার।
আমি আলোড়িত করেছে মাইকেল মধুসূদনকে; তার কবিতা রসাল ও স্বর্ণলতিকায়