বিশ্বকাপে আত্মঘাতী গোল: সাজা মৃত্যুদণ্ড!
দুই এসকোবার: একজন ফুটবল-প্রেমিক ও ড্রাগ মাফিয়া, অন্যজন ২ নম্বর জার্সির ফুটবলার।
দুজন এসকোবার দুটি ভিন্ন কারণে পরিচিত। নিহত দুজনই। দুজনই ল্যাতিন আমেরিকান।
পাওলো এসকোবার কলম্বিয়ার কোকেইন কার্টেলের প্রধান আইনমন্ত্রী ও বিচারক হত্যাকারী প্রেসিডেন্ট ত্রুহিলোর উড়োজাহাজে বিস্ফোরণ ঘটানোর নায়ক, যুক্তরাষ্ট্র ত্রস্ত তার কারণে, তিনি সংসদ সদস্যও হয়েছেন, তার জীবদ্দশায় তার সম্পদের পরিমাণ এখনকার হিসেবে সত্তর বিলিয়ন ডলারের বেশি-আর তিনি যা দান করেছেন, তার পরিমাণ আরও বেশি। এসকোবার বিত্তবান ঘরের সন্তান ছিলেন না। দরিদ্র কৃষকের ছেলে, দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসতে কলম্বিয়ানদের জন্য সহজ কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ কাজটিই তিনি বেছে নিলেন-কোকেইন চালান। আর এই কোকেনের অন্যতম গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র। সরকার এবং যুক্তরাষ্ট্র তাকে যেভাবেই চিহ্নিত করে থাকুক, তিনি কলম্বিয়ার জনগণের কাছে ছিলেন রবিনহুড, জনগণের হৃদয়ের রাজা।
তিনি কলম্বিয়ার দরিদ্র অঞ্চলগুলোতে বহু স্কুল এবং ফুটবল মাঠ প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি যথার্থই মনে করতেন, ফুটবলই পারে তারুণ্য, যুবশক্তিকে ব্যস্ত রাখতে এবং জীবন গড়ার পথ দেখাতে।
২ ডিসেম্বর ১৯৯৩ আমেরিকার প্রযুক্তি সহায়তায় এসকোবারের অবস্থান শনাক্ত করে তাকে ধরতে গেলে উভয় পক্ষে গোলাগুলি হয়। কলম্বিয়া সরকারের ভাষ্য: মাথায় ও বুকে গুলি খেয়ে এসকোবার নিহত হন। সন্দিহানদের ভাষ্য, গুলিটি তার কান বরাবর মাথায় ঢুকেছে, গ্রেপ্তার এড়াতে আসলে তিনি আত্মহত্যা করেছেন।
তার মৃত্যুর পর যে শেষকৃত্যের অনুষ্ঠান হয়েছে, তেমন স্বতঃস্ফূর্ত আবেগময় অনুষ্ঠান কলম্বিয়ান কোনো প্রেসিডেন্টের ভাগ্যে জোটেনি কিংবা অন্য কোনো খ্যাতিমান পুরুষেরও না। তার জন্য বিভিন্ন স্থানে প্রার্থনা করা হয়েছে এবং তাকে মহান সেইন্ট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। দরিদ্র মানুষের কাছে তিনি ছিলেন ঈশ্বর প্রেরিত বিশেষ প্রতিনিধি। আরও স্মরণীয় বাস্তবতা হচ্ছে পাওলা এসকোবারের জন্য কলম্বিয়া তথা ল্যাতিন আমেরিকার ফুটবল কেঁদেছে।
১৯৮০-এর দশক থেকে ম্যাডেলিন ড্রাগ কার্টেল প্রধান পাওলো এসকোবার দেশের ফুটবল দলগুলোর পেছনে অকাতরে অর্থ ব্যয় করতে থাকেন, কলম্বিয়াকে বিশ্বমানের ফুটবল দেশে পরিণত করার স্বপ্ন ছিল তার। এসকোবারের দল অ্যাতলেতিকো ন্যাসিওনাল ১৯৮৯ সালের কোপা লিবার্টেডোর চ্যাম্পিয়নের ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপে রানার্সআপ হয়।
১৯৯১ সালে লাভ করে কলম্বিয়ান জাতীয় লিগ চ্যাম্পিয়নশিপ টাইটেল। শুধু নিজের দল নয়, প্রতিপক্ষ এবং অন্যান্য দলও ফুটবলের মানোন্নয়নে এসকোবারের উদার সাহায্য নিয়েছে। তার প্যাট্রোনাইজেশনে বেড়ে ওঠা ও খ্যাতিলাভ করা ফুটবলারদের মধ্যে রয়েছেন রেনে হিগুইতো, আদ্রেস এসকোবার লুই ফার্নান্দেজ, লিয়োনেল আলভারেজ, রিকার্দো পেরেজ, অ্যালেক্সিস গার্সিয়া, জন ত্রেলেজ, নাইভার ডিয়াজ। কলম্বিয়া দলের বিশ্বকাপ ফুটবল পর্যন্ত পৌঁছাতে তার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অবদান সবাই স্বীকার করেন। এসকোবারের মোকাবিলা করতে অপর প্রতিপক্ষ ড্রাগ কার্টেলও ফুটবলে বিনিয়োগ করতে শুরু করে। অবশ্যই স্মরণ রাখতে হবে, এসকোবারের সব কীর্তিই আবার ফুটবল সহায়ক নয়।
আলভারো ওর্তেগা হত্যাকাণ্ড
১৯৮৯ সালে কলম্বিয়ার অভ্যন্তরীণ লিগে আমেরিকা ডি ক্যালি বনাম এসকোবারের ইনডিপেনডেন্ট ম্যাডেলিনের ম্যাচে তার দল ৩-২ গোলে হেরে যায়। খেলায় রেফারি ছিলেন আলভারো ওর্তেগা। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ- খেলা শেষ হবার দুই মিনিট আগে কার্লোস কার্লোসের দেওয়া একটি গোল নাকচ করে দেবার কারণে এসকোবারের দল হেরে যায়।
রিটার্ন লিগে দুই দলের খেলা ০-০ ড্র হয়। ওর্তেগা এ খেলাতে লাইনসম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন। রিটার্ন লিগ নিয়ে তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই কিন্তু প্রথম লিগই তার পরিণতি নির্ধারণ করে দেয়। রিটার্ন লিগের খেলা শেষ হবার পর সেদিন সন্ধ্যায় এসকোবারের নির্দেশে তার জঙ্গি বাহিনী রেফারি ওর্তেগাকে গুলি করে হত্যা করে। তারপর আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
১৯৯০-এর বিশ্বকাপের হোস্ট দেশ ইতালি থেকে দাবি ওঠে, বিশ্বকাপ থেকে কলম্বিয়াকে বহিষ্কার করা হোক। শেষ পর্যন্ত কলম্বিয়া বিশ্বকাপে থাকলেও সে বছর কলম্বিয়াতে আর কোনো রেফারি খেলা পরিচালনা করতে সম্মত হননি, ফলে অবশিষ্ট লিগ ও অন্যান্য টুর্নামেন্ট পরিত্যক্ত হয়।
১৯৯০-এর বিশ্বকাপে কলম্বিয়া সংযুক্ত আরব আমিরাতকে হারিয়ে এবং পশ্চিম জার্মানির সাথে ড্র করে ১৬ দলের রাউন্ডে পৌঁছে।
১৯৯৩-এর ২ ডিসেম্বর পাওলো এসকোবারের মৃত্যুও হঠাৎ কলম্বিয়ার ফুটবলকে থমকে দিয়েছিল, কিন্তু ফুটবলের জন্য তার অবদান ওর্তেগা হত্যাকাণ্ডের পরও তাকে রক্ষা করেছে। ড্রাগ লর্ড পাওলো এসকোবার মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ফুটবলের পেছনে খরচ করার একটি লিগ্যাসি স্থাপন করে গেছেন।
আন্দ্রেস এসকোবারের মৃত্যুদণ্ড!
পাওলো এসকোবারের সাথে তার কোনো আত্মীয়তার সম্পর্ক নেই। ১৩ মার্চ ১৯৬৭ কলম্বিয়ার মেডেলিন শহরের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে আন্দ্রেস এসকোবারের জন্ম। ল্যাতিন আমেরিকার এই শহরটিকে বলা হয় অনন্ত বসন্তের শহর- সিটি অব এটার্নাল স্প্রিং। সারা বছর উপভোগ্য আবহাওয়া আর শহরজুড়ে ফুলের সমারোহ। তার বাবা দারিও এসকোবার একজন ব্যাংকার। তারই অন্যতম উদ্যোগ- রাস্তার ছেলেদের ধরে এনে ফুটবল সংগঠনে ঢুকিয়ে দেওয়া, তাহলে মাদক ও অন্যান্য নেশা থেকে তারা মুক্ত থাকবে। তার বড় ভাই সান্টিয়াগো এসকোবারও উঁচু দরের ফুটবলার।
আন্দ্রেস এসকোবারও স্কুল ফুটবল টিমের খেলোয়াড় হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার পর অল্প সময়েই পেশাদার ফুটবলে নাম লেখাতে সক্ষম হন। ৩০ মার্চ ১৯৮৮ প্রথম কলম্বিয়া জাতীয় দলের পক্ষে খেলেন, সে খেলায় কানাডা তাদের কাছে ৩-০ গোলে পরাজিত হয়। ১৯৮৮-তে খেলেন কোপা আমেরিকা টুর্নামেন্টে, ১৯৯০-এর ফিফা ওয়ার্ল্ড কাপে।
ফুটবলে বিশ্বজুড়েই কে কটা গোল দিলেন, সে পরিসংখ্যানই চোখে বেশি পড়ে-আক্রমণভাগের খেলোয়াড়েরা বেশি আলোচিত হয়ে থাকেন, প্রতিরক্ষায় যারা থাকেন, তাদের নিয়ে আলোচনা কম। আন্দ্রেস এসকোবার নিজের জন্য পছন্দ করে নিয়েছেন প্রতিরক্ষা অঞ্চল। তিনি দুর্ভেদ্য, তার এ সুনামও চারদিকে ছড়িয়েছে। তার জার্সি নম্বর ২। তারস্প্যানিশ ভক্তরা নাম দিয়েছেন:এল ক্যাবালেরো দেল ফুটবল=দ্য জেন্টলম্যান অব ফুটবল। কেউ কেউ বলেছেন অমর ২ নম্বর- দ্য ইমমর্টাল নাম্বার টু।
১৯৯৪-এর বিশ্বকাপে কলম্বিয়ার হয়ে খেলতে গেলেন তাদের শক্তিশালী ডিফেন্ডার আন্দ্রেস এসকোবার। ২৪টি ভাগ্যবান দলের একটি কলম্বিয়া। বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে। গ্রুপ 'এ'-তে চারটি দল: যুক্তরাষ্ট্র, সুইজারল্যান্ড, রোমানিয়া এবং কলম্বিয়া।
১৮ জুন প্রথম খেলায় ছন্দপতন ঘটল। কলম্বিয়া ১-৩ গোলে রোমানিয়ার কাছে হেরে গেল। দৌড়ে টিকে থাকতে হলে ২২ জুন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যে ম্যাচ, তাতে জিততে হবে। খেলা শুরু হলো। ৩৪ মিনিট পর্যন্ত ০-০ ড্র অবস্থাতেই ছিল। এ সময় যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যমাঠের ফিল্ডার জন হার্কেস নিজের বাঁ দিক থেকে কলম্বিয়ার গোলপোস্ট বরাবর কিক করলেন। ডিফেন্ডার এসকোবার পায়ে লাগিয়ে বলটা ঘুরিয়ে দেবেন, এটাই প্রত্যাশিত, তিনি তাই করলেন, কিন্তু বলের নিশানা গোলপোস্টমুখী। বলটা জালে ঢুকে পড়ল। স্তব্ধ হয়ে গেল কলম্বিয়ার সকল সমর্থক। এ এক ভয়ংকর আত্মঘাতী গোল।
১-০ গোলে এগিয়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রথমার্ধ শেষ করল। শেষ পর্যন্ত ২-১ গোলে যুক্তরাষ্ট্র জিতে গেল। তৃতীয় খেলায় কলম্বিয়া ২-০ গোলে সুইজারল্যান্ডকে হারাল। এদিকে রোমানিয়া আবার যুক্তরাষ্ট্রকে হারিয়ে দেওয়ায় কলম্বিয়া বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে পড়ল। আত্মঘাতী গোল ফুটবলে হয়েই থাকে। কিন্তু
এর পরিণতি কতটা খারাপ হতে পারে?
ক্রোধ জমেছে প্রিয় খেলোয়াড়ের ওপর। সকল ব্যর্থতার দায় এসকোবারেরই। বোগোটার ইল টিয়েম্পোকে যে সাক্ষাৎকার তিনি দিয়েছেন, ইংল্যান্ডের গার্ডিয়ান তা উদ্ধৃত করেছে:
'জীবনের শেষ এখানেই নয়। আমাদের চলতে হবে। জীবন এখানে থামতে পারে না। যত কঠিনই হোক আমাদের আবার দাঁড়াতে হবে। আমাদের সামনে কেবল দুটি পথ খোলা: ক্রোধ আমাদের পক্ষাঘাতগ্রস্ত করতে পারে-তাতে সহিংসতা অব্যাহত থাকবে অথবা পরস্পরকে সহযোগিতা করে আবার নিজেদের তুলে আনব-পছন্দটা আমাদের, চলুন আমরা পারস্পরিক শ্রদ্ধা বজায় রাখি। সবার জন্য আমার উষ্ণ শ্রদ্ধা।'
কথা ছিল এসকোবার লাস ভেগাসে এক আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে যাবেন। কিন্তু আত্মঘাতী গোলের পর মন খারাপ হয়ে যাওয়ায় তিনি কলম্বিয়া ফিরে এলেন। ৩ জুলাই ১৯৯৪ সন্ধ্যায় মেডেলিন শহরের এল পোবলাদো এলাকায় বন্ধুদের নিয়ে তিনি একটি বারে বসলেন। তারপর এলেন এল ইন্ডিয়ো নাইট ক্লাবে। তার বন্ধুরা একে একে চলে গেল। ভোর তিনটায় (মানে ২ জুলাই খুব সকালে) পার্কিং লটে এসে নিজের গাড়িতে উঠলেন, বাড়ি ফিরবেন। এ সময় তিনজন ক্ষুব্ধ যুবক তার গাড়ি ঘিরে ধরল, তার সাথে কথা-কাটাকাটি শুরু করল। আত্মঘাতী গোলের জন্য দায়ী করল। দুজন হ্যান্ডগান বের করে আত্মঘাতী গোলের শাস্তি হিসেবে তাকে গুলি করতে শুরু করল। প্রতিটি গুলির সাথে 'গোল' বলে চিৎকার করল।
রক্তাক্ত অবস্থায় এসকোবারকে ফেলে রেখে তিনজন একটি টয়োটা পিকআপ ট্রাক চালিয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করল। এসকোবারকে হাসপাতালে নেবার ৪৫ মিনিট পর তার মৃত্যু হলো।
এটাই গোলের শাস্তি। সেদিন রাতেই গ্রেপ্তার হলো ঘাতক হামবার্তো ক্যাস্ত্রো মুনোজ। সে ড্রাগ লর্ড সান্টিয়াগো গ্যালন ভ্রাতৃদ্বয়ের কর্মচারী-ড্রাইভার। কলম্বিয়া যুক্তরাষ্ট্র খেলায় কলম্বিয়ার পক্ষে বাজি ধরে অনেক টাকা সে হারিয়েছে। সুতরাং তার ক্রোধ জমেছে এসকোবারের ওপর। তার ৪৩ বছরের কারাদ- হলেও অপর দুই আসামিরা খালাস হয়ে যায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ১১ বছর জেল খেটে হামাবার্তো মুনোজ কারামুক্ত হয়। এই হত্যাকা- কলম্বিয়ার ড্রাগ কার্টেলেরই কাজ বলে আন্তর্জাতিকভাবে আলোচিত হয়। কলম্বিয়ার ভাবমূর্তি বিশেষভাবে ক্ষুণ্ণ হয়। এসকোবারের শেষকৃত্যের অনুষ্ঠান কলম্বিয়ার ইতিহাসে স্মরণীয় এক শোকের অনুষ্ঠান।
আন্দ্রেস এসকোবারকে কেউ হত্যার হুমকি দেয়নি, হত্যাই করেছে। দুজন এসকোবারই কলম্বিয়াকে কাঁদিয়েছেন-দুজন দুভাবে।