বঙ্গে ছাপাখানা...বই
অর্ধশতকের মধ্যে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল যে উনিশ শতকের কলকাতা যন্ত্র বলতে ছাপযন্ত্রকেই বুঝত। কারণ, এর মাহাত্ম্য, গাম্ভীর্য ছাড়িয়ে গিয়েছিল অন্য সব যন্ত্রকেই। ছাপাখানার নামে তার প্রকাশ দেখি যেমন মথুরানাথ মিশ্রের যন্ত্রালয়, মহিন্দিলাল যন্ত্রালয়, পীতাম্বর সেনের যন্ত্রালয় বা ব্যাপ্টিস্ট মিশন যন্ত্র। তখন যন্ত্রিত শব্দ দিয়ে কলে চাপানো চট বা কাপড়কে বোঝাত না, বোঝাত মুদ্রিত, বইয়ের গায়ে যন্ত্রস্থ কথাটি লেখার চল স্বল্পকাল আগেও বর্তমান ছিল, বোধকরি মনে পড়বে অনেকের।
যন্ত্রটি যে বিশিষ্ট তা বোঝা যায় সেকালে সংবাদপত্র সালতামামি লিখতে গিয়ে নতুন ছাপাখানার কথাও উল্লেখ করত। বাংলা ১২২৫ সনকে উদাহরণ ধরলে দেখা যায় নতুন লৌহময় সেতু গড়া, আসাম অবধি মনিপুর পর্যন্ত নতুন পথ তৈরি ইত্যাদি সব বৃহৎকাণ্ডের সঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে লর্ড বিশপ সাহেবের নতুন এক ছাপাখানার কথা।
হুগলিতে প্রথম
ভারতবর্ষে প্রথম ছাপাখানা নিয়ে আসে পর্তুগিজরা। ১৫৫৬ সালে জাহাজ থেকে ছাপাখানাটি নামানো হয় গোয়ায়। এটিতে পরের পাঁচ বছরের মধ্যে পাঁচটি বই ছাপানো হয়, তবে সেগুলো একালের মানুষের দেখার সুযোগ হয়নি। গোয়া থেকে উপকূল ধরে ছাপাখানা বেড়াতে শুরু করে কুইলন, পুডিকাইল, ভিপিকোট্টা, ত্রিবাঙ্কুর। শেষে মাদ্রাজ হয়ে আসে হুগলি। ততদিনে দুই শ বছরের বেশি অতিক্রান্ত। হুগলিতে প্রথম ছাপযন্ত্রটির খবর মেলে ১৭৭৮ সালে। ওই বছরই বই ব্যবসায়ী অ্যান্ড্রুজের যন্ত্রটি থেকে মুদ্রিত হয়েছিল নাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেডের গ্রামার অব দ্য বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ। ইংরেজি এই বইয়ের পাতায় পাতায় কৃত্তিবাসী রামায়ণ, কাশীদাসী মহাভারত আর ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল বিদ্যাসুন্দর থেকে উদ্ধৃতি যেগুলোর সব বাংলা হরফে।
মুদ্রণযন্ত্রের সঙ্গে বাংলা ভাষার প্রথম পরিচয় কিন্তু পর্তুগালের রাজধানী লিসবনে ১৭৪৩ সালে। তিন তিনটি বাংলা বই ছাপা হয় সেবার। তার মধ্যে মানোয়েল দা আসসুম্পাসাঁউ কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদের কথা জানা আছে অনেকের, জানা আছে বাংলা ব্যাকরণ ও পর্তুগিজ-বাংলা শব্দকোষের কথাও। তবে এই বইগুলোয় রোমান হরফে ছাপা হয়েছিল বাংলা।
হুগলির আগেও অবশ্য মুদ্রণযন্ত্র বাংলা হরফের মুখোমুখি হয়েছিল অল্পস্বল্প তবে তা বিদেশে। সজনীকান্ত দাসের বাংলা গদ্য সাহিত্যের ইতিহাস থেকে জানা যাচ্ছে, ভারতের ইতিহাস, ভূগোল, জলবায়ু ইত্যাদি নিয়ে একজন জেসুইট যাজক একটি বই লিখেছিলেন, ১৬৯২ সালে সেটি ছাপা হয়েছিল প্যারিস থেকে। লাতিনে ছাপা ১১৩ পৃষ্ঠার বইটির ৭৪ পৃষ্টায় মুদ্রিত হয়েছে বাংলাদেশের জনসাধারণের লিপির নমুনা।
জার্মানির লিপজিগে ১৭২৫ সালে ছাপা হওয়া আউরঙ্গজেব বইতেও বাংলা হরফের দেখা পাওয়া যায়। সম্রাট আওরঙ্গজেবকে নিয়ে লেখা ৮৪ পৃষ্ঠার বইটিতে ১ থেকে ১১ পর্যন্ত বাংলা সংখ্যা ছাড়াও বাংলা ব্যঞ্জনবর্ণ এবং বাংলা হরফে একটি জার্মান নাম ছাপা হয়েছে। বাংলা হরফ লন্ডনেও ছাপা হয়েছে ১৭৭৬ সালে। নাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেডেরই লেখা 'আ কোড অব জেন্টু লজ' গ্রন্থে। উপরোক্ত বইগুলোতে বাংলা লিপির এক একটির নমুনা একেকরকম আর এখানেই হুগলি আলাদা ও বিশেষ। কারণ, হুগলিতে তৈরি হওয়া হরফগুলো ছিল স্ট্যান্ডার্ডাইজড, ছাঁচে ঢালা এবং মুভেবল (বিচল বা চলনক্ষম)।
বিচল হরফের কুশীলবেরা
হুগলিতে অ্যান্ড্রুজের ছাপাখানার কুশীলব তিনজন। তাঁরা হলেন চার্লস উইলকিন্স, জোসেফ শেফার্ড এবং পঞ্চানন কর্মকার। ছাপাতে হবে হ্যালহেডের পাণ্ডুলিপি। হস্তলিপির জায়গায় চাই হরফ। কাঠ বা ধাতু খোদাইয়ের বদলে ছাঁচে ঢালা বর্ণমালা তৈরি করতে হবে। রাজকার্যের সুবিধার জন্য হ্যালহেড লিখেছেন বইটি। ওয়ারেন হেস্টিংস তখন বাংলার গভর্নর। তিনিই বইটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক। হেস্টিংস এমনকি হ্যালহেডের সাহায্যকারী এক পণ্ডিত ও লিপিকরকে দীর্ঘদিন ধরে মাইনে দিয়ে গেছেন। কোম্পানির কাছে হেস্টিংস অনুরোধ করেছিলেন বইটির এক হাজার কপি লেখক ও মুদ্রাকরের কাছ থেকে সরকারের তরফ থেকে ত্রিশ টাকা দরে কিনে নেওয়া হোক। তারপর একই দরে তা কোম্পানির কর্মচারীদের কাছে বিক্রি করা হোক। তাঁরা হেস্টিংসের প্রস্তাব মেনে নিয়েছিলেন, তবে ১০০০ কপি নয় ৫০০ কপি বই কিনতে সম্মত হয়েছিলেন। হেস্টিংসের অনুরোধেই বই ছাপাবার দায়িত্ব নিয়েছেন সংস্কৃতের পণ্ডিত চার্লস উইলকিন্স।
বইয়ের ভূমিকায় হ্যালহেড লিখেছেন, ছেনি কাটা থেকে শুরু করে হরফ ঢালাই, ছাপার কাজ সবই উইলকিন্স নিজের হাতে করেছেন। সম্ভবত নেটিভ বলেই পঞ্চানন কর্মকারের নাম উল্লেখ করেননি হ্যালহেড। তবে পারিপার্শ্বিক সকল সাক্ষ্য-প্রমাণ বিচার-বিশ্লেষণ করে গবেষকদের বুঝে নিতে অসুবিধে হয়নি যে বাংলা হরফ নিয়ে প্রকাশিত বইটি ছাপার কাজে পঞ্চননের বিশেষ ভূমিকা ছিল। তবে জোসেফ শেফার্ড অবহেলার শিকার হয়েছিলেন সত্যি সত্যি। অথচ তিনি ভুঁইফোড় ছিলেন না।এই ইংরেজ খোদাই শিল্পী কলকাতায় গিলখ্রিষ্টের ইংরেজি এবং হিন্দুস্তানি অভিধানের সঙ্গে পার্শিয়ান টাইপ ডিজাইন ও ঢালাই করে দিয়েছিলেন। সে বইটি ১৭৮৭ সালে প্রকাশিত হয়। বইয়ের ভূমিকায় গিলখ্রিষ্ট লিখেছেন, মৃত্যুশয্যায় শেফার্ড বলে গেছেন যে হ্যালহেডের ব্যাকরণ ছাপার সময় বাংলা এবং পার্শিয়ান হরফ তৈরির কাজে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত তিনি উইলকিন্সকে সাহায্য করেছেন। কিন্তু তিনি কোনো স্বীকৃতি পাননি। বার্মিংহামে জন্ম নেওয়া এই ইংরেজ মাত্র ৩৪ বছর বয়সে ১৭৮৭ সালে কলকাতায় মারা যান।
যার বই দিয়ে বাংলা হরফের চলাচল বৃদ্ধি পেল, সেই হ্যালহেড প্রসঙ্গে বলা দরকার এবার। ১৭৫১ সালে তাঁর জন্ম অক্সফোর্ডশায়ারের এক বনেদি পরিবারে। প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে তিনি ভারতে চলে এসেছিলেন। পরে বিয়ে করেছিলেন চুঁচুড়ার ডাচ গভর্নরের কন্যা হেলেনা রিবাউটকে। হ্যালহেড ভারতীয় ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি সত্যিকারের অনুরাগ বোধ করতেন। বাংলা ছাড়াও আরও কিছু ভারতীয় ভাষা তিনি আয়ত্ত করেছিলেন। তিনি ইংল্যান্ড ফিরে যান ১৭৮৫ সালে। ফেরার পর লন্ডনে তিনি একজন স্বাধীন, সম্পন্ন সজ্জন গৃহস্থ হিসেবে দিন কাটাচ্ছিলেন। কিন্তু মুশকিল হলো ভারতে অর্জিত অর্থ তিনি বিনিয়োগ করেছিলেন ফ্রান্সে। অথচ ইংল্যান্ড আর ফ্রান্সের মধ্যে যুদ্ধ বেধে গেল। তাই বিনিয়োগকৃত অর্থের সবটাই নষ্ট হয়ে যায়। তখন হ্যালহেড ভাবলেন, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্তাদের কাছে পুনর্নিয়োগের আবেদন জানাবেন। কিন্তু কোম্পানির তরফ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। হ্যালহেড নিপতিত হলেন চরম দারিদ্র্যের দিকে। ১৭৯৩ সালে তিনি তাঁর হার্লে স্ট্রিটের বাড়ি বিক্রি করে দিলেন। আরও পরের দিকে হ্যালহেড তাঁর সংগ্রহের ভারতীয় পুঁথি, দুষ্প্রাপ্য মুদ্রিত বই আর কিছু পাণ্ডুলিপি বিক্রি করে দিতে চাইলেন। তিনশ পাউন্ডে তা ব্রিটিশ মিউজিয়াম কিনে নেয়। এর মধ্য দিয়েই প্রাচ্যবিদ্যার সঙ্গে হ্যালহেডের যোগসূত্র ছিন্ন হয়ে যায়। ১৮৩০ সালে তিনি মারা যান।
ছাপা কাজের প্রধান কুশীলব চার্লস উইলকিন্সের জন্ম ১৭৫০ সালে। তিনি ভারতে আসেন কুড়ি বছর বয়সে ১৭৭০ সালে। হ্যালহেডের মতো তিনিও ভারতীয় ভাষা শিক্ষায় উৎসাহী হন। সংস্কৃত আর ফারসি ভাষা শেখেন। তিনি বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন, তার মধ্যে ভগবদ্গীতার ইংরেজি অনুবাদ এবং একটি সংস্কৃত ব্যাকরণ উল্লেখযোগ্য। কলকাতায় এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠারও তিনি অন্যতম উদ্যোক্তা। হ্যালহেডের বই ছাপার সময়ই উইলকিন্স এন্ড্রুজের ছাপাখানাটি কোম্পানিকে দিয়ে কিনিয়ে নেন। কোম্পানির প্রথম ছাপাখানার সুপারিনটেন্ডেড হন উইলকিন্স। হুগলিতে ছাপাকাণ্ড সম্পন্ন হওয়ার পরপরই শুরু হয়েছিল কলকাতায় সরকারি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার তোড়জোড়। সেটি গড়ে তোলার দায়িত্বও দেওয়া হয় উইলকিন্সকে। শারীরিক কারণে উইলকিন্স ভারত ত্যাগ করেন ১৭৮৬ সালে। কিন্তু ভারতীয় ভাষাচর্চা এবং হরফ তৈরির প্রয়াস অব্যাহত রেখেছিলেন এর পরও। বাংলা গদ্যসাহিত্যের ইতিহাসে সজনীকান্ত দাস লিখেছেন, তিনি (উইলকিন্স) সংস্কৃত গ্রন্থ মুদ্রণের জন্য নাগরি হরফও প্রস্তুত করেছিলেন।
যুদ্ধ পঞ্চাননকে নিয়ে
এবার পঞ্চাননের কথা বলা যাক। শ্রীরামপুরের মিশনারিরাই প্রথম পঞ্চানন কর্মকারের নাম সর্বসমক্ষে আনেন। মিশনারি উইলিয়াম কেরির সহযোগী যশুয়া মার্শম্যান লিখেছেন, বাংলা হরফ তৈরিতে উইলকিন্স আর পঞ্চানন সমান সমান ভূমিকা রেখেছেন। প্রতিটি হরফ তৈরির জন্য পঞ্চানন ১ টাকা ৪ আনা পেতেন। তাই উইলকিন্স এবং শেফার্ডকে ছেনিকাটা ও ঢালাইয়ের কাজে যে পঞ্চানন সহযোগিতা করেছেন, তা গবেষকেরা নিশ্চিত। হুগলি জেলার ত্রিবেণিতে তাঁর জন্ম। কর্মকার ছিল তাঁর পূর্বপুরুষেরা। তাম্রপটে, অস্ত্রশস্ত্রে অলঙ্করণ বা নামাঙ্কনে তাঁরা ছিলেন দক্ষ। উত্তরাধিকারসূত্রে পঞ্চাননও সেই দক্ষতার অধিকারী ছিলেন।
হ্যালহেডের বইয়ের জন্য যে চলনশীল বা বিচল বা মুভেবল ধাতব হরফ ব্যবহার করা হয়েছিল, তাতে পঞ্চাননের অবদান উইলকিন্সের চেয়ে কম নয়। হ্যালহেডের বইয়ের কাজ শেষ হলে উইলকিন্স পরিচালিত কোম্পানির কলকাতা ছাপাখানায় কাজ শুরু করেন পঞ্চানন। ১৭৮৫ পর্যন্ত ছাপাখানাটি চালু ছিল, পঞ্চানন শেষাবধি সেখানে কাজ করেছেন। হরফ নির্মাণের কলাকৌশল তিনি এত ভালো আয়ত্ত করেছিলেন যে তাঁকে নিয়ে ইংরেজ আর ডাচদের মধ্যে কাড়াকাড়ি পড়ে গিয়েছিল। শোনা যায়, শ্রীরামপুরের যাজকেরা কলকাতার সাহেবদের ফাঁকি দিয়ে সুকৌশলে হাত করেছিলেন পঞ্চাননকে। উইলকিন্স দেশে ফিরে যাওয়ার পর থেকে পঞ্চানন ছিলেন কোলব্রুকের সহচর।
শ্রীরামপুরের (তখন ডাচ উপনিবেশ, কলকাতা থেকে ১৫ মাইল উত্তরে) মিশনারিরা কোলব্রুকের কাছে আবেদন করলেন, পঞ্চাননকে চাই। কিন্তু কোলব্রুক ছাড়বেন না পঞ্চাননকে। তখন মিশনারিরা সরাসরি চিঠি লিখলেন পঞ্চাননের কাছে। এবারও কোনো জবাব মিলল না। তখন কেরি আবার কোলব্রুকের শরণাপন্ন হলেন। কাতর মিনতি জানালেন পঞ্চাননকে ধার চেয়ে। বললেন, অন্তত দিন কয়েকের জন্য ওকে ছাড়ুন। কোলব্রুক আর প্রত্যাখ্যান করতে পারলেন না। তিনি পঞ্চাননকে কয়েকদিনের জন্য ছুটি দিয়ে বললেন, যাও, শ্রীরামপুর ঘুরে এসো। তবে এই যাওয়াই কিন্তু সেই যাওয়া, মানে আর কোলব্রুকের কাছে ফেরেননি পঞ্চানন। অনেক চেষ্টা করেছেন কোলব্রুক তাঁকে ছাড়িয়ে আনার। ভারত সরকারের কাছে আরজিও পেশ করলেন। কিন্তু কেরিও ওদিকে ডাচ সরকারকে নামিয়েছেন আসরে। আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক লড়াই শুরু এক বাঙালি কারিগরকে নিয়ে। কেরি তখন সওয়াল করেছিলেন, একজন কারিগরের ওপর একচ্ছত্র অধিকার বহাল রাখার কোনো অধিকার নেই কলকাতার ইংরেজদের।
একাই লড়েছেন হিকি
ব্যাপ্টিস্ট মিশনারি কেরি মানে উইলিয়াম কেরি শ্রীরামপুরে অবতরণ করেন ১৮০০ সালের জানুয়ারি মাসে। তবে এ গল্পে যাওয়ার আগে আমাদের ফিরতে হবে কলকাতায়। অগাস্টাস হিকির কাছে। কোম্পানির ছাপাখানাই কলকাতার প্রথম ছাপাখানা নয়। সাংবাদিক জেমস অগাস্টাস হিকির প্রাপ্য কলকাতায় প্রথম ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার সম্মান। জাহাজে চিকিৎসকের সহকারী হয়ে তিনি কলকাতায় পৌঁছান ১৭৭২ সালে।
ভাগ্যান্বেষী হিকি ব্যবসা-বাণিজ্য করে প্রতিষ্ঠা লাভের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ব্যবসায় তিনি সাফল্যের মুখ দেখতে পাননি। হাতে ছিল হাজার দুয়েক টাকা, তা দিয়ে কিছু টাইপ সংগ্রহ করেন এবং একটি কাঠের ছাপাখানা তৈরি করে ছাপার কাজ শুরু করেন। এটা ১৭৭৭ সাল। পরের তিন বছরে কলকাতার একচেটিয়া মুদ্রাকর ছিলেন তিনি। তাঁকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মিলিটারি বিল ও ভাতার ফর্ম ছাপতে দিত। ১৭৮০ সালে তিনি প্রকাশ করেন সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম সংবাদপত্র সাপ্তাহিক হিকিস বেঙ্গল গেজেট বা ক্যালকাটা জেনারেল অ্যাডভার্টাইজার।
হিকির পত্রিকা প্রকাশের কয়েকমাস পরেই থিয়েটারওয়ালা বি মেসিসক এবং লবণের গোলাদার পিটার রিড প্রকাশ করেন ইন্ডিয়া গেজেট। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ক্যালকাটা গেজেট বের হয় এর চার বছর পরে। তবে হিকির গেজেটের সঙ্গে এগুলোর তুলনা কমই চলে। ভারতে প্রথম অসি বনাম মসির লড়াই শুরু করেন হিকি। শাসনের তলোয়ার ঝিলিক দিয়ে ওঠে হেস্টিংসের হাতে। সরকারি কর্তাব্যক্তি থেকে গণ্যমান্য সাহেবসুবোদের নিয়ে রঙ্গ-ব্যঙ্গ ছাপা হতে থাকে হিকির কাগজে। জনপ্রিয়ও হয়ে ওঠে কাগজটি।
ফলশ্রুতিতে একের পর এক মামলায় জড়িয়ে পড়েন হিকি। হেস্টিংস নিজেও মানহানির মামলা দায়ের করেন। সরকারের তরফ থেকে তাঁর কাগজ বন্ধ করে দেওয়ার দাবি উঠতে থাকে। ১৭৮১ সালের জুন মাসে হিকি আদালতের নির্দেশে অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হন। মোটা অঙ্কের জরিমানা ধার্য করা হয় আর তা হিকির পক্ষে মিটিয়ে দেওয়া সম্ভব ছিল না। তাই নিক্ষিপ্ত হন কারাগারে। কিন্তু তিনি ছিলেন অদম্য। কারাগারে বসেই পরের ৯ মাস কাগজ চালিয়ে যান। শেষে ১৭৮২ সালে তাঁর ছাপাখানা ও টাইপ সরকার বাজেয়াপ্ত করে।
হরফ আর কাগজ ছিল মহার্ঘ্য
তবে ইতিহাস হিকিকে ভোলেনি। কলকাতায় ছাপাখানা প্রসারেও হিকির অবদান স্বীকার করে নিতে দ্বিধা করেন না গবেষকেরা। ১৮০০ সালের মধ্যে কলকাতায় ছাপাখানা গড়ে উঠেছিল ১৭টি। তবে একসঙ্গে ১০টির বেশি কখনো চালু ছিল না। ওইসব ছাপাখানার পরিচালকদের কয়েকজনের ছাপার কাজে হাতেখড়ি হিকির ছাপাখানায়। তাঁরা এবং আরও নতুন সব উদ্যোক্তারা দিনে দিনে কলকাতাকে পরিণত করে ছাপা হরফের এক জমজমাট হাটে। ১৮০০ সালের মধ্যে কলকাতায় মুদ্রাকর ছিলেন ৪০ জন। তাদের মধ্যে ত্রিশজনের বেশি কোনো না কোনো কাগজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৭৯০ সালের মধ্যে কলকাতায় প্রকাশিত হয়েছে ১৯টি সাপ্তাহিক, ৬টি মাসিক পত্রিকা। সবগুলোই অবশ্য ইংরেজিতে।
ছাপাখানা চালু হওয়ার পর ১৮০১ সালের আগপর্যন্ত ২২ বছরে বই ছাপা হয়েছে ৬৫০টি। তার মধ্যে বাংলা হরফের দেখা মেলে ৮৪টিতে। আদ্যোপান্ত বাংলা বইয়ের সংখ্যা অবশ্য অনেক কম। তখন হরফ এবং কাগজ সংগ্রহের সমস্যা ছিল প্রকট। কোম্পানির ছাপাখানায় হরফ তৈরি হতো, অন্যরা হরফের অভাব পূরণ করতেন বিলেত থেকে আমদানি করে। তবে কেউ কেউ ফাউন্ড্রি খুলেছিলেন, তাদের মধ্যে ড্যানিয়েল স্টুয়ার্ট এবং জোসেফ কুপারের উদ্যোগ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ১৭৮৬ সালে তাঁরা নিজেদের ছাপাখানায় ক্রনিকেল প্রেসের জন্য হরফ তৈরির কাজ করতে থাকেন আর পরের বছরই সাফল্যের সঙ্গে বাংলা হরফ তৈরি করেন।
গ্রাহাম শ আঠারো শতকের কলকাতার ছাপাখানার যে ইতিহাস লিখেছেন, তাতে দেখা যায়, আর্মেনিয়ান, হিব্রু, গ্রিক ভাষার বইও ছাপা হয়েছে কলকাতায়। ইউরোপীয় এবং ভারতীয় সংগীতের বই নোটেশনসহ ছাপা হয়েছে। আরও ছাপা হয়েছে মানচিত্র, ছবির বই ইত্যাদি। বাংলা ভাষায় পূর্ণাঙ্গ প্রথম বইটি হলো জোনাথন ডানকান অনূদিত একটি আইনের বই। ১৭৮৪ সালে প্রকাশিত এই বইটির নামপত্র: মপসল দেওয়ানি আদালত সকলের ও সদর দেওয়ানি আদালতের বিচার ও ইনসাফ চলা হইবার কারণ ধারা ও নিয়ম। এছাড়া জিসি মেয়ার অনুবাদ করেছেন পাঁচটি আইনের বই। নীল বেঞ্জামিন এবং এডমন্ড স্টোন ১৭৯১ এবং '৯২ সালে অনুবাদ করেছেন দুটি বই। গ্রাহাম শর হিসাবমতে আঠারো শতকের মধ্যে আইনের বই বাংলায় অনূদিত হয়েছে মোট ১৯টি।
কাগজও হরফের মতো মুদ্রাকরদের কাছে ছিল এক সমস্যা। কাগজের সরবরাহসূত্র ছিল মূলত দুটিÑব্রিটেন থেকে আমদানি করা এবং এ দেশে হাতে তৈরি করা কাগজ। দেশি কাগজ সাধারণত আসত পাটনা থেকে। বিলেতি কাগজের মতো ভালো মানের না হলেও এটি ছিল বেশ সস্তা। ১৭৯২ সালে বিলেতি কাগজে ছাপা হওয়া যে বইয়ের দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল ১২ সিক্কা টাকা, একই বই পাটনাই কাগজে ছাপা হলে দাম ধরা হলো ৮ সিক্কা টাকা। অষ্টাদশ শতকের কলকাতায় ২টি কাগজের কল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগের কথা জানা যায়। পরে অবশ্য শ্রীরামপুরেও কাগজ তৈরি শুরু হয়।
শ্রীরামপুরের আগে কলকাতায় খ্রিষ্টীয় বই অনুবাদের কথা কেউ ভাবেনি। প্রশাসকের কাছে তার চেয়ে বেশি জরুরি ছিল আইনের বই, দেশীয় ভাষা বোঝার জন্য ব্যকরণ বই, অভিধান বা শব্দকোষ। ১৮০০ সালের মধ্যেই যেমন কলকাতা থেকে বাংলা-ইংরেজি অভিধান বের হয় তিনটি। এসব বই ছাপা হওয়ার আগে কাগজে কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া হতো। বইগুলো ছাপাখানা বা সার্কুলেটিং লাইব্রেরি মারফত বিক্রি হতো। বই ব্যবসায়ী জন অ্যান্ড্রুজ, যার ছাপাখানা থেকে হ্যালহেডের ব্যাকরণ প্রকাশিত হয়েছিলÑতিনিই আদি সার্কুলেটিং লাইব্রেরির প্রতিষ্ঠাতা।
শ্রীরামপুর বিপ্লব
শ্রীরামপুরে কেরির অবতরণের বছর মানে ১৮০০ সালের ১৮ মার্চ রাম রাম বসু ও টমাস অনূদিত সেন্ট ম্যাথুজ গসপেল প্রকাশিত হয়। ১২৫ পৃষ্ঠার বই এই 'মঙ্গল সমাচার মতিয়ের রচিত'। এই বইটি নবযুগ আনল কারণ বাঙালি পণ্ডিত বিদেশি ধর্মপ্রচারকের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ছাপাখানার জন্য বই তৈরি করছেন। শ্রীরামপুরে ব্যাপ্টিস্ট মিশনের প্রতিষ্ঠা ১৮০০ সালে। সে বছরই কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ। দুইয়ে মিলে বাংলা গদ্য সাহিত্যে ঝরনাধারা প্রবাহিত করেছে। কেরি কাঠের যে ছাপাখানাটি নিয়ে বাংলার হৃৎপিণ্ডে স্পন্দন বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, তা নীলকর উডনির দান। খিদিরপুর থেকে নিলামে মাত্র ৪০ বা ৪৬ পাউন্ডে কেনা।
'মঙ্গল সমাচার'-এর পর শ্রীরামপুরের ছাপাখানা বিরামহীনভাবে বই ছাপিয়ে চলেছিল। ১৮০১ থেকে ১৮৩২ সালের মধ্যে চল্লিশটি ভাষায় বই প্রকাশ করেছে শ্রীরামপুর মিশন। ১৮৩৪ সালে প্রকাশিত মিশনের দশম কার্যবিবরণে বলা হয়েছে, মোটমাট সাতচল্লিশটি ভাষায় ধর্মপুস্তক ছেপেছে মিশন, তার মধ্যে চল্লিশটির জন্য হরফ তৈরি করেছে নিজেরাই। গবেষকেরা বলছেন, ভারতবর্ষীয় মুদ্রণ ও প্রকাশন শিল্পের ইতিহাসে শ্রীরামপুর লাইট হাউসের মতো। শুধু খ্রিষ্টীয় ধর্মবিষয়ক বই নয়, বাংলা রামায়ণ আর মহাভারতও প্রকাশ করেছে শ্রীরামপুর।
পঞ্চাননকে না পেলে শ্রীরামপুরের ছাপাখানা এমন ভুবনমোহন হয়ে উঠত কি না সন্দেহ। বাংলায় বাইবেল ছাপানোর ইচ্ছা ছিল কেরির সেই ১৭৯৫ সাল থেকে। খবর নিয়ে জানতে পারলেন, একটি হরফ ঢালাই করতে খরচ পড়বে ১৮ শিলিং। অন্তত ছয়শ ছেনি দরকার। কমপক্ষে ৫৪০ পাউন্ড বেড়িয়ে যাবে। ১০ হাজার বইয়ের জন্য লাগবে ৪৩,৭৫০ টাকা। আর তখনই পঞ্চানন এসে দাঁড়ালেন সামনে। বললেন, আমি হরফ তৈরি করে দিব। হরফপিছু পড়বে এক টাকা চার আনা।
হাতে স্বর্গ পেলেন কেরি। বাঙালি বিশ্বকর্মা পঞ্চানন কর্মকারকে নিয়ে যাত্রা শুরু করল শ্রীরামপুর মিশন প্রেস, যার ফলাফল অনবদ্য, অনন্য। শুধু পঞ্চানন নন, জামাতা মনোহরও যোগ দিয়েছিলেন হরফ তৈরির কাজে। মনোহর পুত্র কৃষ্ণ মিস্ত্রিও ছিলেন নিপুণ শিল্পী। মনোহর ১২৪৫ বাংলা সনে নিজের যন্ত্রালয় স্থাপন করেছিলেন। সেখান থেকে প্রতিবছর একটি করে বাংলা পঞ্জিকা প্রকাশিত হতো। পঞ্জিকার সব ছবি তিনি নিজে আঁকতেন আর ব্লকও তৈরি করতেন নিজেই। মাত্র তেতাল্লিশ বছর বয়সে কলেরায় মারা যান কৃষ্ণচন্দ্র। তাঁর দুই ভাই রামচন্দ্র আর হরচন্দ্রও ছিলেন দক্ষ কারিগর। গেল শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত শ্রীরামপুরে ওদের ছাপাখানা সক্রিয় ছিল। উনিশ শতকে পঞ্চাননের উত্তরপুরুষেরা তৈরি করেছিলেন হরফ ঢালাইয়ের কারখানা, নাম, অধর টাইপ ফাউন্ড্রি।
শ্রীরামপুরের পরে
শ্রীরামপুরের ছাপাখানার পরেই ১৮০২ সালে গিলখ্রিষ্ট শুরু করেন হিন্দুস্তানি প্রেস। ১৮০৫ সালে ম্যাথু ল্যাম্পসডেন প্রতিষ্ঠা করেন পার্শিয়ান প্রেস। ১৮০৭ সালে খিদিরপুরে বাবুরাম প্রতিষ্ঠা করেন সংস্কৃত প্রেস। এভাবে উনিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে দেখা যায়, কলকাতার পাড়ায় পাড়ায় ছাপাখানাÑকলুটোলায় চন্দ্রিকা যন্ত্রালয়, বহুবাজারে শ্রীলেবেন্ডার সাহেবের ছাপাখানা, মীরজাপুরে মুনশি হেদাতুল্লার ছাপাখানা, পাশেই আবার সম্বাদ তিমির নাশক যন্ত্রালয়। কেবল ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের প্রয়োজনীয় বইপত্র ছাপার জন্য কমপক্ষে তিনটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। এ ছাড়া শাঁখারীবাজারে বদনপালিতের প্রেস, শোভাবাজারে বিশ্বনাথ দেবের প্রেস ইত্যাদি। কলকাতার বটতলা দেখতে দেখতে জমজমাট। গদ্য-পদ্য কত কত বই যে ছাপা হয়েছে উনিশ শতকের কলকাতায়! সচিত্র ও বিচিত্র সে সম্ভার।
পূর্ববঙ্গে ছাপাখানা
তখনকার পূর্ববঙ্গে প্রথম ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হয় রংপুরে, বার্তাবহ যন্ত্র, ১৮৪৮ সালে। এখান থেকে রংপুর বার্তাবহ নামের সংবাদপত্র প্রকাশিত হতো। রংপুর পরগনার জমিদার কালীচন্দ্র রায়ের অর্থানুকূল্যে প্রকাশিত হতো পত্রিকাটি। এর সম্পাদক ছিলেন গুরুচরণ রায়। রংপুরের পর ঢাকার ছোট কাটরায় প্রতিষ্ঠিত হয় একটি প্রেস, পরে এর নাম হয় ঢাকা প্রেস। এখান থেকে দ্য ঢাকা নিউজ পত্রিকা প্রকাশিত হতো। ১৮৬০ সালে ঢাকায় বড় আঙ্গিকে একটি বাংলা ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। এর পরিচিতি ছিল বাঙ্গালা যন্ত্র নামে। এটি প্রতিষ্ঠায় ব্রজসুন্দর মিত্র, ভগবান চন্দ্র বসু ভূমিকা রেখেছিলেন। ঢাকার সাহিত্যচর্চায় এটি বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল।
দীনবন্ধু মিত্রের নীল দর্পণ ছাপা হয়েছিল এই বাঙ্গালা যন্ত্র থেকে। ঢাকার প্রথম সাহিত্য পত্রিকা কবিতাকুসুমাবলীও এই প্রেস থেকেই ছাপা হয়। ঢাকা প্রকাশ ছিল সে যুগে বিখ্যাত সংবাদ সাময়িকী। এর অফিসও ছিল বাঙ্গালা যন্ত্রের কার্যালয়ে। ১৮৬৬ পর্যন্ত ঢাকায় মাত্র তিনটি ছাপাখানা ছিল। তবে ফরিদপুরে ছিল একটি প্রাচীন ছাপাখানা। সেখান থেকে প্রকাশিত হতো অমৃতবাজার পত্রিকা। ১৮৭০-এর মধ্যে অবশ্য ঢাকায় আরও ৬টি মুদ্রণ যন্ত্র স্থাপিত হয়েছিল।
উনিশ শতকের শেষ আধা শতকে বাংলাদেশের সর্বত্রই ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা পেতে থাকে। রাজা বা জমিদারেরা ছিলেন এগুলোর পৃষ্ঠপোষক।
দিন যত গেছে আধুনিক হয়েছে যন্ত্র, তবে বেশি পরিবর্তন হয়েছে বাংলা হরফের। হরফ ক্রমাগতই সুন্দর ও সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়েছে। বাংলা হরফকে সুষম করতে যেমন পঞ্চানন কর্মকারের ভূমিকা আছে আবার বর্ণমালাকে সুন্দরভাবে সেজে উঠতে ভূমিকা রেখেছেন ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। আর ওই দুই ক্ষেত্রেই ছাপযন্ত্রের ভূমিকা অনবদ্য। আরও স্বীকার করে নেওয়া ভালো, ভাষাকেও গীতল, সুমধুর আর শ্রুতিমধুর করতে ছাপযন্ত্রের ভূমিকা আছে।